ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নারীর অগ্রযাত্রা এবং আমাদের ভাবনা

বিনয় দত্ত | প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আমাদের দেশের অর্থনীতিতে কর্মজীবী নারীর অবদান অপরিসীম। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতায় কাজ করে যাচ্ছেন এবং আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ঘরগৃহস্থালীর কাজ থেকে শুরু করে গোটা দেশ চালানোর কাজে আমাদের নারীরা কাজ করছেন সফলতার সাথে। নারী যে দশভুজা, তার প্রমাণ প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষণে তাকে দিতে হচ্ছে। একজন কর্মজীবী নারীকে পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে দ্বিগুণ কাজ করতে হয়। একজন নারীকে অফিসের কাজ শেষ করে আবার বাসার কাজ এবং আবদার দুটোই সমাধা করতে হয়।

কোন ক্ষেত্রে নেই আমাদের নারীরা? হোটেল, সিমেন্ট, রেস্টুরেন্ট, সিরামিকস, চাতাল, বৈদ্যুতিক, নিরাপত্তাকর্মী, ইটভাটা, নির্মাণ, চা শ্রমিক, গৃহকর্মী, পোশাক খাত থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই নারীর সামাজিক অবদান যেমন অনেক প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক অবদানও সুদৃঢ়।

সুউচ্চ পাহাড়ে তীব্র প্রতিবন্ধকতার মধ্যে যেমন আমাদের নারীরা নিজেদের অবস্থান গড়ে নিয়েছেন তেমনি ভয়ানক চ্যালেঞ্জিং পেশা যেমন ট্রেন চালনা থেকে শুরু করে নারী বৈমানিক হিসেবে নিজেদের দক্ষতা ও মেধার সাক্ষর রেখেছেন। বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে আরোহণকারী বাংলাদেশের নিশাত মজুমদার, প্রথম নারী ট্রেন চালক বাংলাদেশের সালমা খাতুন কিংবা এমআই-১৭ হেলিকপ্টার উড্ডয়নকারী বাংলাদেশের নারী বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না-ই-লুৎফির নাম এখন আমাদের সবারই জানা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য অনুযায়ী, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রমবাজারে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। অর্থাৎ একজন নারীকে ঘরের কাজের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমকক্ষীয় হয়ে কাজ করে যেতে হয়।
জরিপ মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৯১ লাখ।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটিতে। অর্থাৎ এক অর্থবছরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে নয় লাখ। অন্যদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কর্মজীবী পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৩১ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের শ্রমশক্তিতে কর্মজীবী পুরুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ কোটি ৩৫ লাখ। অর্থাৎ এক বছরে শ্রমশক্তিতে পুরুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে মাত্র চার লাখ।

২০১৫ সালে বেসরকারি একটি গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে, নারীরা প্রতিদিন ঘর-গৃহস্থালীর ৪৫-৪৬ ধরনের কাজ করে থাকেন। একজন নারীকে গড়ে ১৬-২০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। পরিবারিক কাজের ৮০ শতাংশই নারীরা সমাধা করেন। বাংলাদেশের নারীর কাজের অর্থনৈতিক মূল্য হিসাব করলে দেখা যায়, বছরে তা দাঁড়ায় ১১ লাখ কোটি টাকার বেশি।

নিরাপত্তা এবং বেতন বৈষম্যের কথা মাথায় রেখেও নারীরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। এই সকল অগ্রগতি তখনই থেমে যায় যখন নারীকে অন্য পুরুষের দ্বারা শ্লীলতাহানির শিকার হতে হয়। একজন নারীকে বাসা থেকে বের হয়ে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে কাজ শেষ করে আবার বাসায় ফিরে আসার পথে অনেকবার ভিন্ন কৌশলে শ্লীলতাহানির শিকার হতে হয়। কখনো যৌন, কখনো কটুক্তি, কখনো ধর্ষণ আবার কখনো ধর্ষণের পর মৃত্যুর মতো ভয়ানক থাবার সামনে প্রাণ হারাতে হয় নারীকে।

২.
সম্প্রতি খাগড়াছড়ির দীঘিনালার নয়মাইল এলাকায় নিজ বাড়ির কাছেই নৃশংসভাবে ধর্ষণ করা হয় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী পুনাতি চাকমা কৃত্তিকাকে। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষণের পর পুনাতিকে খুব বাজেভাবে ভাবে হত্যা করা হয়। দশ বছরের এই শিশুটির বাবা নেই। মা তাদের একমাত্র উপার্জক্ষম। উচ্ছ্বলতা ছিল শিশুটির নিত্যসঙ্গী। সকল উচ্ছ্বলতা থামিয়ে পুনাতি এখন অজানাতে।

ধর্ষণ শব্দটা শুনলে আমার মধ্যে কেমন যেন অনুভূত হয়। এই অনুভূতি আমি কাউকে প্রকাশ করতে পারি না। নিজের মধ্যে চেপে রাখতেও পারি না। কখনো দিনে, কখনো রাতে, কখনো জনসন্মুখে, কখনো আড়ালে, কখনো পার্টিতে, কখনো বাসে, কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রটোকলে, কখনো সামরিক নিরাপত্তার মধ্যে, কখনো সুস্থ স্বাভাবিক নারী-শিশু, কখনো অসুস্থ নারী-শিশুকে, কখনো পরিণত বয়স হওয়ার আগে, কখনো বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার প্রাক্কালে নারী বা শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। এই ধর্ষণ থামছে না। ক্রমশ বাড়ছে।

কখনো ইয়াসমিন, কখনো রূপা, কখনোবা সোহাগী জাহান তনু, জাকিয়া আক্তার চম্পা, ফাতিমা আক্তার ইতি যেই নামই হোক এরা কেউই ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাইনি। এই সমাজে আমরা প্রতিটা দিন পার করছি আর নতুন করে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার কাছাকাছি অবস্থান নিচ্ছি। আমরা যতই আধুনিক হই না কেন আমরা আমাদের নিজেদের মনকে আধুনিক করতে পারিনি। আমরা পারিনি এই সমাজ থেকে অসংগতি দূর করতে, আমরা পারিনি আমাদের মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে, মোটা দাগে বলতে গেলে আমরা পারিনি নারী ও শিশু ধর্ষণ বন্ধ করতে। এর দায় আমাদের সকলের।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই ৬২ মাসে সারা দেশে ১ হাজার ১৪৮ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। গড়ে প্রতি মাসে ১৫ জন নারী লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। ১৮ জনের বেশি নারী গড়ে প্রতি মাসে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গত ছয় বছরে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে প্রাণ গেছে ১০৬ নারীর। এর মধ্যে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন করা হয়েছে ৩৩ জন নারীকে।
পরিসংখ্যানে আরও জানা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই সময়ে সবচেয়ে বেশি নারী লাঞ্ছনার শিকার হয় ২০১৫ সালে। সেই বছর ২০৫ জন নারী লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। শুধু যে রাজধানীতে যৌন হয়রানী, নারী লাঞ্ছনা, নারী ধর্ষণ ঘটছে তা নয়। ঢাকার বাইরে গ্রাম অঞ্চলেও এখন অহরহ যৌন হয়রানি, নারী লাঞ্ছনা, নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধর্ষণের ঘটনায় আমরা সরব হয়ে উঠি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যম পর্যন্ত সরব থাকে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে। একসময় নতুন ঘটনা বা ইস্যু এসে সেই ধর্ষণের ঘটনাকে হারিয়ে যেতে সহায়তা করে। নারী ও শিশু ধর্ষণে যে পরিমাণ মামলা হয়েছে তার সুরাহা হয়েছে খুবই ক্ষীণ। বিভিন্ন কারণে ধর্ষণের আসামীরা খালাস পেয়ে যায়।

রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি, তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতা ও সাক্ষ্যগ্রহণের সময় ভিকটিমকে হয়রানির কারণেই ধর্ষণ মামলার বিচার হয় না। প্রথমত বিচার হয় না, দ্বিতীয়ত বিচারের বাস্তবায়নেও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ধর্ষণ মামলার আসামীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় না।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির কর্ণধার সালমা আলী জানান, নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এরমধ্যে নারী ও শিশু ধর্ষণ মামলার নেয়ার ব্যাপারে পুলিশের অসহযোগিতাপূর্ণ আচরণ অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন এই আইনজীবী।

৩.
একদিকে নারী উন্নয়ন, অপরদিকে নারীর অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা যৌন হয়রানি, নারী লাঞ্ছনা ও নারী ধর্ষণ। নারী ধর্ষণ কমাতে না পারলে নারী উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা থমকে যাবে। একজন নারী শিশু যখন ছোট বয়সে এইধরনের একটি ঘটনার সম্মুখীন হয় তখন তার স্বপ্নের সকল সিঁড়ি সে নিজেই ভেঙ্গে দেয়। এর জন্য নারী শিশুটি দায়ী নয়, দায়ী আমাদের কুৎসিত মন, কু-চিন্তা, সঠিক মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ না হওয়া।

একশ্রেণির সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী সব সময় চেয়েছে নারীরা যেন বাসায় বন্দী থাকে, তাদের পদদলিত হয়ে এক কোণে দিনাতিপাত করে। এই সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী কখনোই নারী মুক্তি, নারীর অগ্রগতি বা নারী স্বাধীনতাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তারা বিভিন্ন অজুহাতে নারীকে আটকে রাখার চেষ্টা করেছে এবং করছে। এরাই নারীকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ফতোয়া দিয়ে নিজেদের আলাদা করার চেষ্টা করেছে।

এরা প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণকে মেনে নিতে পারেনা, পঞ্চম শ্রেণির পর নারীর পড়াশোনার প্রয়োজন নেই বলে সহাস্যে বলে বেড়ায়, রাতবিরাতে কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে যাওয়া নারীদের এরাই বিচারের মানদণ্ডে ফেলে মুখের কটুক্তি দিয়ে বিচার করে, নারীর পোশাক-আশাকে বাধ্যবাধকতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে, নারীর উচিত অনুচিত এরাই নির্ধারণ করে। এদের সমূলে উৎপাটন করতে আমাদের সকলেরই এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের অবস্থান থেকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মাধ্যমে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করতে হবে। তবেই নারী মুক্তি সম্ভব।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন