ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সড়কে মড়ক : সমাধান কোথায়?

বিনয় দত্ত | প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

যে হারে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে, প্রতিক্ষণে সড়কে মানুষ মারা যাচ্ছে তাতে সড়কের অপর নাম মৃত্যুফাঁদ বলা চলে। এই মৃত্যুফাঁদ বড়ই লোভী, যখন যাকে যেভাবে পাচ্ছে তাকে সে অবস্থায় গ্রাস করে নিচ্ছে। হোক সে নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, সুস্থ, অসুস্থ। গ্রাস করার প্রক্রিয়াও বড়ই অদ্ভুত। কখনো মৃত্যু দিয়ে, কখনো পঙ্গুত্ব দিয়ে।

আমাদের দেশে শহরের সড়ক হোক বা মহাসড়ক হোক কারণে অকারণে মানুষ মারা যায়। তার সবচেয়ে বড় কারণ হল আমাদের সড়ক ব্যবস্থা বা ব্যবস্থাপনা নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় সড়কে চলা যানবাহনগুলো, নিরাপদ নয় যানবাহন চালানো ড্রাইভারগুলো। শুধু ড্রাইভার বা যানবাহন নয়, সড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের অনেক বেশিমাত্রায় সচেতনতা জরুরি।

আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থা বা ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে আনা কোনো বিষয় নয়, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণে আনার সদিচ্ছা আমাদের আছে কি না তাই আগে দেখতে হবে। সড়ক ও পরিবহন খাতটিকে আমরা শুরু থেকেই এমন একজনের নিয়ন্ত্রণে রেখেছি যিনি নিজের ইচ্ছামতো সবকিছু দেখভাল করেন।

কখনো তার এক মুহূর্তের নির্দেশে সারাদেশে পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়, কখনো চালক বা ড্রাইভারদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি নিজের মন মতো সিদ্ধান্ত নিতে পিছ পা হন না। তিনি আমাদের মহান নেতা শাহজাহান খান। যার অপার ক্ষমতা। যার দয়ায় আমরা এখনো সড়কে চলাচল করতে পারছি!

আবদুল করিম রাজীব, দিয়া খানম মিম, রাজীব হোসেন, রোজিনা, শিশু আকিফা, এসআই উত্তম সরকার এরা সবাই সড়কে দুর্ঘটনার কারণেই নিহত হন। কেউ সাথে সাথে কেউবা ধুঁকে ধুঁকে মারা যান। তাছাড়া নামে বেনামে অনেক লোক প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। এইরকম অসংখ্য মৃত্যুর তথ্য দিয়ে শেষ করা যাবে না।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের তথ্যমতে, সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ৬৪ জনের মৃত্যু হয়। প্রতি বছর নিহত হন ২৩ হাজার ১৬৬ জন। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া এই ৬৪ জন কারো বাবা, ভাই, বোন, মা, সন্তান বা আত্মীয়স্বজন। ‘বাংলাদেশ হেলথ ইনজুরি সার্ভে-২০১৬’ শীর্ষক এক জরিপের তথ্যমতে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক ক্ষতি আরো বেড়ে যায় পঙ্গুত্ব ও চিকিৎসা ব্যয়ের চাপে।

সড়ক দুর্ঘটনা কমতো যদি গোটা ঢাকা শহরের সকল পরিবহন কোম্পানিগুলো একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হত। এইখানে তা হয় না, প্রতিটি রুটে আলাদা আলাদা মালিক পক্ষ বাস নামায়। আবার একটি বাসের তিনজন মালিকও পাওয়া যায়। ফলে একেক মালিকের আলাদা শর্তে বাস পরিচালিত হয়। মূলত মালিকদের বেঁধে দেওয়া টার্গেটের কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে গিয়েছে।

মালিকপক্ষ সারাদিন একটি বাস থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বেঁধে দিয়ে বাকিটা ড্রাইভার, হেলপার, কন্ডাক্টরের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে বলেন। তখনই ড্রাইভাররা নিজেদের টার্গেট পূরণের জন্য একটি বাসের সাথে আরেকটি বাসের প্রতিযোগিতা শুরু করে। আর এই প্রতিযোগিতায় নেমে আসে অকাল মৃত্যু, পঙ্গুত্ব সহ অনেককিছু।

পিপিআরসি ও ব্র্যাক সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ে একটি যৌথ গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এরমধ্যে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন এবং দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালকদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ও অপ্রতুল শাস্তির বিধান সবচেয়ে বেশি দায়ী। এইসব কারণে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বিশাল অঙ্কে ঠেকেছে।

দুই.
কোনটি সড়ক দুর্ঘটনা আর কোনটি সড়কে খুন এই দুই মিলিয়ে ফেলে আমরা মনে হয় ভুল করছি। সাইদুর রহমান পায়েলের ঘটনাটা সড়কে খুন। হানিফ পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব-৯৬৮৭ নম্বরের বাস থেকে সাইদুরকে ফুলদী নদীতে ফেলে দেয় বাসকর্মীরা। পরবর্তীতে তদন্ত রিপোর্টে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মোঃ জায়েদুল আলম বলেন, ‘পেটের পানিই প্রমাণ করে জীবিত সাইদুর রহমান পায়েলকে খালে ফেলা হয়েছিল।’

ঘটনাটি শোনার পর আমি হতবাক হয়ে যাই। বাস চালক এবং হেলপারের কত বড় সাহস হলে তারা এইধরনের কাজ করতে পারে। এইটা কোনোভাবেই দুর্ঘটনা নয়। এইটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

পায়েলের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৭ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরতলির সিটি গেট এলাকায় হেলপারের সাথে কথা কাটাকাটি হওয়ায় লুসাই পরিবহনের চলন্ত বাস থেকে রেজাউল করিম নামের এক যুবককে ফেলে দেয়া হয়। পরবর্তীতে রেজাউল মারা যায়।

পায়েলের ঘটনার পর রেজাউলের ঘটনাটা শুনে আমি ভয়ানক বিস্মিত হয়ে পড়েছি। আমরা সবাই কি তাহলে পরিবহন শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছি? পরিবহন শ্রমিকরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাবে আমরা সবাই নিশ্চুপে বসে দেখব? এইটা সম্ভব?

এইসব হত্যাকাণ্ডের যদি কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি না হয় তবে পরিবহন ও সড়ক খাতে কখনোই শৃঙ্খলা আসবে না। পরিস্থিতি চরমে পৌঁছে যাবে।

শুধু সাইদুর রহমান পায়েল বা রেজাউল করিম নয় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মিমের ঘটনাটিও একটি হত্যাকাণ্ড। দুইটি বাসের রেষারেষিতে কেন কোমলমতি সন্তানরা মারা যাবে? যে জাবালে নূরের (ঢাকা মেট্রো ব-১১৯২৯৭) পরিচালক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের শ্যালক মোঃ নান্নু মিয়া, তিনি কেন শাস্তির আওতায় আসবেন না? নান্নু মিয়ার একক প্রভাবে জাবালে নূর দাপটের সাথে সড়কে চলেছে এতোদিন। এখন দায় নেয়ার বেলায় শুধু সেই নিরীহ বাসচালক আর হেলপার, এইটা কোনো নিয়ম হতেই পারে না।

গোটা পরিবহন খাতটিকে জিম্মি করে রেখেছে নান্নু মিয়াদের মতো গুটি কয়েক লোক। নান্নু মিয়ারাই অধিক লোভের কারণে লাইসেন্সবিহীন চালক গাড়িতে বসায়, অশিক্ষিত লোকজন ধরে এনে গাড়ি চালাতে সাহস জোগায়, আর যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন ধামাচাপা দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। মূলত এদের কারণেই আজকে সড়কে মড়ক লেগে আছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্ঘটনাগুলোর ৯০ ভাগই ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত গতি। আর বেপরোয়া চালকের কারণে ঘটে ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা।

৩.
পৃথিবীর কোথাও এইরকম বিশৃঙ্খলভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় না। একমাত্র আমাদের দেশেই এইধরনের অসুস্থ মানসিকতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জার্মানীর গোটা শহরে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে সড়ক ও পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রিত হয়। বরং সেই দেশে যোগাযোগ খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য সরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ ও নজরদারি করা হয়। আর আমাদের দেশে ঘটে তার উল্টো ঘটনা।

আজকে যে কোমলমতি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা সে রাজপথে নেমে আন্দোলন করছে। এই আন্দোলন কাদের বিরুদ্ধে? তার দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে। কেন এই আন্দোলন? কারণ তার সহপাঠীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি পায়েল, রেজাউল, রাজীব ও মিমের ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ডই বলবো।

এইসব শিক্ষার্থী যারা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে তাদের মনে কি ধরনের প্রভাব পড়েছে আমি তাই ভাবছি। ভবিষ্যতে এরা কাউকেই মানবে না। কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও হবে না। কারণ আমাদের প্রশাসন তাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আমাদের সড়ক ও পরিবহন খাতসহ গোটা যোগাযোগ ব্যবস্থা তাদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। এই দায় কার? শির্ক্ষার্থীদের আন্দোলনে গোটা যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে ছিল। এই ক্ষতি কার?

এই সময়ের ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত মেধাবী এইটা আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি। যদি তাদের আমরা সঠিকভাবে দিক নির্দেশনা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করতে না পারি তবে তাদের বিপথে যাওয়ার দায় আমাদেরকেই নিতে হবে। আমরা যেন সেইদিনের জন্য প্রস্তুত থাকি।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
[email protected]

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন