মহীরুহের বিদায়
মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। মহাকালের সেই অমোঘ নিয়মে চলে গেলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার দিকপাল পুরুষ গোলাম সারওয়ার। তার মৃত্যু সংবাদপত্র জগতের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
গত সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ২৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। সবশেষ দৈনিক সমকালের সম্পাদক ছিলেন গোলাম সারওয়ার। দীর্ঘদিন ধরে নিউমোনিয়া ও ফুসফুস সংক্রমণ ছাড়াও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। ৪ আগস্ট উন্নততর চিকিৎসার জন্য তাকে নেয়া হয় সিঙ্গাপুরে। সেখানে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় তার। কিন্তু হঠাৎ রক্তচাপ কমে গেলে সোমবার বিকেলেই তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।
১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন সাংবাদিকতার মহীরুহ গোলাম সারওয়ার। সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেন ১৯৬৩ সালে দৈনিক পয়গম দিয়ে। এরপর দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। যুগান্তর, সমকালের মতো শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন গোলাম সারওয়ার৷
সংবাদপত্র জগতে এক অবিসংবাদিত নাম ছিল গোলাম সারওয়ার। একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা পরবর্তীকালে কলমযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে আকাশস্পর্শী উচ্চতায় নিয়ে যান। পেশাগত দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি।
দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় জড়িত ছিলেন সাংবাদিকতার সাথে। আমৃত্যু ভালোবেসে গেছেন সাংবাদিকতাকেই। শাসকের রোষ কষায়িত লোচন কিংবা প্রলোভনের স্বর্ণমৃগ তাকে টলাতে পারেনি। অসামান্য পেশাদারির মধ্য দিয়ে সংবাদপত্র শিল্পকে করে গেছেন সমৃদ্ধ। সংবাদপত্র শিল্পের আজকের যে অবস্থান, তার পেছনেও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন তিনি।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি জড়িত ছিলেন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডেও। ছড়াকার ও গীতিকার হিসেবেও খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার ছড়ার বই ‘রঙিন বেলুন’। এছাড়া তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘সম্পাদকের জবানবন্দি’, ‘অমিয় গরল’, ‘আমার যত কথা’, ‘স্বপ্ন বেঁচে থাক’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন তিনি। মুক্তচিন্তার প্রকাশ থাকতো তার লেখনিতে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা ছিল তার আমৃত্যু। এই অগ্রসর মানুষের বিদায় সংবাদপত্র শিল্পে যে শূন্যতা সৃষ্টি করবে তা পূরণ হওয়ার নয়।
সকলের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বিদায় নিলেন গোলাম সারওয়ার। তিনি চলে গেলেন কিন্তু রেখে গেছেন কর্মময় এক বর্ণাঢ্য জীবনপঞ্জি। আগামী প্রজন্মের পাথেয় হিসেবে যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক এটাই আমাদের প্রার্থনা।
এইচআর/আরআইপি