এই দেশ কার
নিলাদ্রির একটা মেসেজ পড়ে লেখাটি শুরু করি। তিনি লিখেছেন, `ইতিমধ্যে একবার আমাকে ফলো করেছে, এটা টের পেয়ে আমি ঢাকা ত্যাগ করেছি। জব শিফট করে ঢাকার বাইরে এক অজপাড়াগাঁয়ে চলে এসেছি। এখানে এসে আমি অনেকের সাথে অনলাইনে যোগাযোগ করেছি বাইরে যাওয়ার জন্যে, সত্য কথা বলতে আমি অনেক বেশি আতঙ্কে আছি। আমি দেশ ছাড়তে চাচ্ছি, যদি কোনো দিক দিয়ে কিছু করা সম্ভব না হয়, তাহলে ঈদের পরই ভারত চলে যাবো।`
নিলাদ্রি ভারতে বা দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পাননি। তাকে খুন করা হয়েছে। নিজের ঘরের ভেতর। তার স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। তাঁর আক্ষেপ এই দেশ কী তার নয়?
ধারণা করা হচ্ছে নিলাদ্রি হত্যাকাণ্ডের পর দেশে এখন সবেচেয়ে বেশি আতঙ্কে আছেন ব্লগাররা। আছেন মৃত্যু ভয়ে। বিশেষ করে তালিকভুক্ত ৮৪ জন। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজত ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির আগে ব্লগারদের এই তালিকা করা হয়েছিল। হেফাজতের সঙ্গে আলোচনার অংশ হিসাবে ওই বছরের ১৩ মার্চ সরকার নয় সদস্যের কমিটি গঠন করে। এরপর ৩১ মার্চ কমিটির তৃতীয় বৈঠকে আনজুমানে আল বাইয়্যিনাত নামের একটি সংগঠন `নাস্তিকদের লিস্ট` শিরোনামে ৫৬ জনের একটি তালিকা দেয়। একই সময়ে ৮৪ ব্লগারের একটি তালিকা প্রকাশ করে ফেইসবুকগ্রুপ বাঁশের কেল্লা। এই তালিকায়ও আল বাইয়্যিনাতের ৫৬ জনের নাম ছিলো।
তালিকায় কারো কারো সঠিক নাম ছিলো। কারো কারো ছদ্মনাম। অনেকেই ছদ্মনামে নিজের মতপ্রকাশ করতেন। মুক্তমনা ব্লগের বরাত দিয়ে প্রথম আলো জানাচ্ছে, অনন্ত বিজয়কে হত্যার সময় তাঁর মুঠোফোন নিয়ে নেয় খুনিরা। সেখানে ফেইসবুক চ্যাটের মাধ্যমে সব ছদ্মনামী ব্লগারের পরিচিতি বের হয়ে আসে।
আতঙ্কিত ব্লগারদের দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন। তিনি লিখেছেন, এক দেশ গেলে আরেক দেশ পাওয়া যাবে। জীবন গেলে জীবন পাওয়া যাবে না। গত ৮ মাসে চারজন ব্লগার খুন হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তসলিমার কথা যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ মনে হতে পারে । কিন্তু যে পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
একের পর এক ব্লগার হত্যা। হত্যার পর একটি গোষ্ঠির দায় স্বীকার এবং দোষীদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো সরকারি তৎপরতার অভাব, জনমনে নানা অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে।
এমনিতেই অস্বাভাবিক মৃত্যু মানুষের মনে বিষাদের ছায়া ফেলে। তার ওপর একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা এবং পরে উল্লাস জানানো সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধকে হালকা করে দিতে পারে। বিষয়টিকে নাস্তিক বা ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠির পরষ্পরের বিরোধিতা হিসাবে চিহ্নিত করে চুপ থাকার সুযোগ নেই। সরকারের উচিত হবে, এখনই এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধানে দেওয়া আছে। আটটি বিধিনিষেধ সাপেক্ষে। এর আওতায় থেকে দেশের সব মানুষ মনখুলে কথা বলতে এবং হাত খুলে লিখতে পারবেন। তাদের কথা যতক্ষণ আইনের ভেতরে থাকবে ততক্ষণ ঠিক আছে। আইনের বাইরে গেলে লেখক বা ব্লগার সবার জন্য আইন সমান গতিতে চলা উচিত। তাদের সাজার আওতায় আনা উচিত।
আবার মতের মিল হলো না বলে, কিংবা লিখে বা বলে অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া সমর্থন পেতে পারে না। রাষ্ট্রীয় আইনে হত্যা একটি মারাত্মক অপরাধ। প্রমাণ সাপেক্ষে এর জন্য মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। অর্থাৎ আইনসঙ্গতভাবে একজনকে মেরে অন্যদের হুসিয়ার করে দেওয়া, একই ধরনের অপরাধে একই পরিণতি সম্ভাব্য অপরাধীরও হতে পারে। কিন্তু কোনো নাগরিক প্রাণ সংহার করার অধিকার সংরক্ষণ করে না। করলে, তা অনেক বড় বিচ্যুতি। আইনের শাসনের প্রতি অনেক বড় হুমকি।
রাজনীতি, জনমত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় বিশ্বাস বিবেচনায় না এনে নিলাদ্রি হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ করা যাক। কী পাই আমরা। একজন মানুষ প্রাণভয়ে আছে, থানায় যাচ্ছে, পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলো না। নিজের ঘরে , আপন মানুষদের কাছাকাছি তাকে মেরে ফেললো কয়েকজন। যারা হত্যা করলো তারা সংগঠিত। নির্মম। কথায় বলে বাড়ির কাছে পিঁপড়ার শক্তি বেশি। এক্ষেত্রে বাস্তবতা ভিন্ন দেখা গেলো।
দেশে `নাস্তিক` চিহ্নিত করে মেরে ফেলার লোক আছে, প্রমাণ হলো। সেন্সর না করে ব্লগিং করা যাবে না, বুঝা গেলো। এই দুই উপাদান আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক মূল্য রাখে। আন্তর্জাতিক মহল নড়েচড়ে বসতে পারে। সরকারের যথেষ্ট বিব্রত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এসবের বাইরে দেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠি আছে, যারা নেট সার্ফিং করে না। আবার সব ধর্মের মানুষকে ভাই ভাই মনে করে। উগ্রচিন্তার সঙ্গে যাদের পরিচয় নেই। তাদের জন্য কী বার্তা দেবে এই হত্যাকাণ্ড?
মানুষের জীবন অমূল্য । প্রাণ কেউ সৃষ্টি করতে পারে না। সদাশয় সরকারের কাছে তাই আবেদন, নাগরিকের জীবন রক্ষায় দায়িত্ব সরকারের প্রথম কর্তব্য বিবেচনা করুন।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, দীপ্ত টিভি।
এইচআর/পিআর