মা কী করে বইবে এই বেদনাভার!
আমার বড় বোনের তিনটি ছেলেমেয়ে। আরো একটি থাকতে পারতো। কিন্তু বোনের তৃতীয় সন্তানটি গর্ভাবস্থার সাত মাস বয়সে মাতৃগর্ভেই মারা যায়। অক্সিজেনস্বল্পতাই ছিল মূল কারণ। স্বামী, তিন সন্তান নিয়ে বোনটির পরিপূর্ণ সংসার। তবু রোজ যখন আপুর সঙ্গে আমার কথা হয়, সে তার পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মৃত্যুবরণ করা সন্তানটির কথা মনে করে কাঁদে। আপু কাঁদে, ফোনের ওপাশ থেকে তার ভারী হয়ে ওঠা কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। অসময়ে চলে যাওয়া সেই শিশুটিকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছে, আপু তার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে কখনো সেদিকে তাকাতে পারে না। তার কলিজা ছিঁড়ে যায়, বুক ভেঙে আসে। একজন মায়ের এই কষ্ট আমি যতটুকু অনুভব করতে পারি, তাতে আমার চোখ ভিজে আসে, দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয়। আমার বোনের সন্তানটির এই অসময়ে চলে যাওয়াটা একটি দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে কারো কোনো হাত ছিল না। আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে যখন দেখা গেল শিশুটি মৃত অবস্থায় মাতৃগর্ভে ভাসছে, তখন মানুষ হিসেবে আমাদের কার-ই বা কী করার ছিল!
যে সন্তানটির সঙ্গে তার মায়ের এক পলক দেখা হয়নি, মা যে সন্তানটিকে একটিবারের জন্যও কোলে তুলে নিতে পারেনি, যে সন্তানের সঙ্গে মায়ের কোনো স্মৃতিই নেই, সেই সন্তানের জন্যই তার মা প্রায় প্রতিদিনই চোখের পানি ঝরায়। একজন মানুষ পৃথিবীর যার কাছে যা-ই হোক না কেন, মায়ের কাছে সে কী, তা শুধু একজন মা-ই ভালো করে অনুভব করতে পারেন। পথে-ঘাটে দুই-পাঁচ টাকা ভিক্ষা চাইতে আসা যে শিশুটিকে আমরা দুর দুর করে তাড়িয়ে দেই, যাদের ময়লা পোশাক আর নাক বেয়ে নেমে আসা সর্দি দেখে আমরা ঘৃণায় মুখ ফেরাই, তাদের মায়েরা তাদের সেই সর্দিমাখা মুখেই পরম যত্নে ভাতের লোকমা তুলে দেন, রাতে ঘুমের সময় হলে জীর্ণ কাঁথায় জড়িয়ে এদেরকে বুকের কাছে রাখেন তাদের মায়েরাই। সিলেটের রাজন কিংবা খুলনার রাকিব কার কাছে কী, সেদিক আমরা না-ই বা বিবেচনায় নিলাম। একবার একটু ভেবে দেখি, তারা তাদের মায়ের কাছে কী ছিল!
যে রাজন তরকারি বিক্রি করে পরিবারের জন্য চাল কিনে নিতে এসেছিল, যে রাকিব পরিবারের চাকা সচল রাখতে গ্যারেজে কাজ করতে এসেছিল, তাকে হত্যা করে মায়ের কোলে ফেরত পাঠাবার আগে খুনিরা কি একবারও তার মায়ের মুখ মনে করে দেখেছে! যে অমানুষেরা পৈশাচিক উল্লাসে মেতে এদের হত্যার উৎসবে শামিল হয়েছিল, তাদের কি মা নেই! তারা কি শিশুবয়সে মায়ের কোলে চড়ে কোনোদিন ঘুমপাড়ানি গান কিংবা রূপকথার গল্প শোনেনি! তাদের পরিবার, সন্তান কিছুই কি নেই! তারা কি কোনোদিনই কোনো মানুষের ভালোবাসা পায়নি! রাজন, রাকিবকে যারা হত্যা করেছে ঘৃণা প্রকাশের কোনো ভাষাই তাদের জন্য যথেষ্ট হতে পারে না। সচেতন নাগরিক হিসেবে তাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরা যথারীতি আমাদের দায়িত্ব পালন করবো। টকশোতে চায়ের কাপে ঝড় উঠবে, দৈনিক পত্রিকা গুলোর কাটতি বাড়বে, ফেসবুকে তোলপাড় হবে, নব্য ছড়াকারের দুর্বল ছন্দেও প্রকাশ হবে প্রতিবাদের মৃদুস্বর। আমরা যারা বেশি আবেগী তারা আরো দু-চার দিন বেশি মনে রাখবো রাজন, রাকিবকে। তারপর ভুলে যাবো। নতুন কোনো অমানবিকতায় চাপা পড়বে অতীতের দুর্ধর্ষ এইসব অমানবিকতা। কিন্তু রাজনের মা? রাকিবের মা? নিজের রক্ত-মাংসে গড়ে ওঠা সন্তানের এমন করুণ মৃত্যুর কষ্ট তারা কেমন করে বয়ে বেড়াবেন? যে অমানুষেরা জীবন্ত দুটি মানবশিশুকে হেসেখেলে মেরে ফেলল, সব বিচার, সব আইনের বাইরে গিয়ে জনতার অাদালতে তাদেরকেও যদি এভাবেই হেসেখেলে মেরে ফেলা হয়, তবুও তো রাজন, রাকিবের মায়েদের দুঃখ এতটুকু কমবে না!
চার বছর হয়ে গেছে, তবু আমার বোন তার গর্ভাবস্থার সাত মাস বয়সে মরে যাওয়া সন্তানটির জন্য এখনও প্রতিদিন কাঁদে। আমি জানি, বাকি জীবনটাও সে একই রকমভাবে কাঁদবে। আর রাজন-রাকিবের মায়েরা? তাদের হাহাকার ধারণ করার মতো এত বাতাস কি এই বাংলায় আছে! এই সন্তানহারা মায়েদের অভিশাপ এই জাতি কী দিয়ে মোচন করবে! মায়ের কান্না কি কখনো থামে!
লেখক : সাংবাদিক
এইচআর/পিআর