ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

গাজীপুর সিটি নির্বাচন ও নাগরিক প্রত্যাশা

সুভাষ সিংহ রায় | প্রকাশিত: ১০:০৫ পিএম, ২৫ জুন ২০১৮

২৬ জুন গাজীপুর সিটি নির্বাচন, গাজীপুরবাসীর বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচন। বলা যায়, নির্বাচন নিয়ে পানি কম ঘোলা হয়নি। তাই এই নির্বাচনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে একটা বড় নির্বাচন। ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৪২৫, পুরুষ ও নারী ভোটার প্রায় সমান সমান, পুরুষ ভোটার মাত্র ১৮ হাজার বেশি। যদিও স্থানীয় সরকারের একটি নির্বাচন, তবুও তা মার্কার নির্বাচন।

আওয়ামী লীগের গুণের কথা জানেন সর্বজন কিন্তু স্বীকার করেন কতজন? শেখ হাসিনার সরকারে আগে সিটি কর্পোরেশনগুলোর কোনো সমন্বিত আইন ছিল না। একেক সিটি কর্পোরেশন এক এক আইন দ্বারা পরিচালিত হত। এখন একই আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ আইন, উপজেলা পরিষদ আইন, জেলা পরিষদ আইনও তৈরি করা হয়েছে। ২০১৩ সালে সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ আরো ছয় মাস থাকলেও নিদিষ্ট সময়ের আগে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করলেও সুশাসনের জন্যে নাগরিকরা ধন্যবাদ দেননি।

সুযোগ পেলেই বিদগ্ধজনেরা আওয়ামী লীগের খুঁত ধরার চেষ্টা করেন। এখনও কেউ কেউ মনে করেন আওয়ামী লীগ যেন নিজে হেরে যেয়ে অন্যকে ক্ষমতায় বসায়। যদিও তাদের কেউ কেউ স্বীকার করে থাকেন, আওয়ামী লীগের সাথে অতীতে ভালো আচরণ করা হয়নি। ১৯৭৮ সালের তখনকার ঢাকা সিটি মেয়র হওয়ার কথা আওয়ামী লীগ নেতা পুরনো ঢাকার জনাব ফজলুল করিম। তখন ঢাকায় মোট ৫০টা ওয়ার্ড ছিল। নিয়ম ছিল ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলাররা মেয়র নির্বাচন করবে। আওয়ামী লীগ নেতা ফঝলুল করিম মেয়র হবেনই কেননা তার পক্ষে ৩৬ জন কমিশনার। কিন্তু ভোটের আগের দিন ১২ জন সরকারি কর্মকর্তাকে ভোটার বানানো হলো। এবং ভোটের দিন বলা হল কোনো গোপন ব্যালেটে ভোট হবে না। হাত তুলে ভোট দিতে হবে; এবং ২০ জন কমিশনার (তারা সবাই আওয়ামী লীগর নেতা ) ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হলো না। সেভাবেই মেয়র হয়েছিলেন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। আবার আসি ৯০ পরবর্তী সময়ে, বিএনপি’র শাসন আমলে ১৯৯২ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে কি আচরণটাই না করা হয়েছে। তখনকার ঢাকার ৯০টা ওয়ার্ডের মধ্যে প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে গড়ে ১,০০০ করে ভুয়া ভোট দেওয়া হয়েছিল, কম করে ৯০,০০০ ভুয়া ভোট যোগ করা হয়েছিল ।

সেসময়টাতে নির্বাচন কমিশনে জাকারিয়া, জকরিয়ারা ছিলেন, বিএনপির ভোট তারাই তৈরি করে দিতেন; তখন সুশাসনের জন্যে নাগরিকরা সোচ্চার ছিলেন না। ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মহম্মদ হানিফকে নির্বাচিত হওয়ার পরও দুই মাস পরে শপথ নিতে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন চৌধুরী’র বিজয়ের ফলাফল উল্টে দেওয়ার কী চেষ্টাই না হয়েছে! আর সর্বশেষ খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে কারচুপির কথা বলা হয়েছে। মুদ্রিত মাধ্যমের দু’একটিতে বলা হয়েছে কয়েকটি কেন্দ্রে (৫/৬টি কেন্দ্র ) অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে; কিন্তু ৫ বা ৬টি কেন্দ্রের ভোট সমগ্র ভোটের ০.০১৭৩ শতাংশ ভোট। তাহলে এই ০.০১৭৩ শতাংশ ভোট গোটা নির্বাচনী ফলাফলে কোনো প্রভাব ফেলে কি-না?

যে দল দেড় দু’হাজার পোলিং এজেন্ট দিতে পারে না সেই দলই অবাধ গণমাধ্যমের সুযোগ নিয়ে শুধু অভিযোগ করছে আর অভিযোগের রাজনীতি করে যাচ্ছে। এই দল প্রকারান্তে একটি ‘জাতীয়তাদী অভিযোগকারী দল ’এ পরিণত হয়েছে। এই দলটি শুধু ২০১৩-২০১৪ আগুনসন্ত্রাসের সময়কার দাঙ্গাবাজ কর্মীদেরই পোলিং এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। বিএনপি’র ভুল রাজনীতির কারণে ভদ্র শান্ত আদর্শে প্রাণিত কর্মীদের একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। যেটার প্রমাণ খুলনা সিটি নির্বাচনে পাওয়া গেছে, খুলনা বিএনপি’র সাবেক মেয়র মণি সাহেব এবং তার সমর্থকদের কোনো নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি দাগি আসামিদের নির্বাচনী প্রচার এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করতে দিতে পারে কি-না? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই গণমাধ্যমের বিকাশ , গণমাধ্যম নির্বাচনেও গুরুত্ব দায়িত্ব পালন করে থাকে। গণমাধ্যম নিশ্চয়ই জানে, দুর্জনের ছলনার অভাব হয় না। নৌকার ব্যাজ ধারণ করে ভোট কেন্দ্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে তার যথেষ্ট উদাহরণও আছে ।

বিএনপি, জামাত বিএনপি’মনা বিশিষ্ট নাগরিকরা আশা করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেন বিরোধীদের সাথে যেন খুব ভালো আচরণ করে। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বিদগ্ধজনেরা অনেক অনেক ভালো প্রত্যাশা করেন। বঙ্গবন্ধু’র হত্যাকাণ্ডের পর ঘোর অমানিশার অন্ধকারের কথা নাই বা বললাম। তখন ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে বিদগ্ধজনেরা সোচ্চার হননি।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমেদ এর লেখা ‘বিএনপি সময়–অসময়’ থেকে পাঠক জানতে পারবেন কি দুর্গমগীরি কান্তার মরুপথ আওয়ামী লীগকে পাড়ি দিতে হয়েছে। সেই বই থেকে উৎকলন করছি ‘মৃত মুজিবকে মোকাবেলা করার জন্য ৪ আগস্ট (১৯৭৬) ইতিপূর্বে জারি করা রাজনৈতিক দলবিধি সংশোধন করা হয়। প্রথমে জারি করা দলবিধিতে ছিল, ‘ক্ষতিকর কার্যকলাপে’ লিপ্ত কোনো সংগঠনকে নিবন্ধন দেওয়া হবে না। ৪ আগস্টের সংশোধনীতে ক্ষতিকর কার্যকলাপের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ১০ উপদফার উল্লেখ করা হয়। ১০ নম্বর উপদফায় বলা হয় : ‘কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি বা উৎসাহিত করিতে পারে বলিয়া সম্ভবনা রহিয়াছে।’

বোঝাই যায় সেই সময় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটা কেমন ছিল। কেননা তখনতো বহুদলীয় গণতন্ত্রের বটিকা খেয়ে নেশায় বুদ হয়েছিলেন। কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান সেসময় লিখেছিলেন, ‘দাসত্বের খোয়ারি নেশা অত সহজে কাটে না’। আওয়ামী লীগের বক্তৃতা প্রেস বিজ্ঞপ্তিও পত্রিকাগুলো ছাপতে চায়তা না। আর আগুন সস্ত্রাসের সময়কালে যুদ্ধাপরাধীদের দল ‘জামায়ত-এ-ইসলাম’ কোনো পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি না পাঠালেও তাদের ওয়েব সাইট থেকে সংবাদ নিয়ে কোনো গণমাধ্যম তা প্রচার করেছিল। ঘোর দুর্দিনেও আওয়ামী লীগ তার জন্মসূত্রে পাওয়া সংগ্রামী চেতনা থেকে বিন্দু সরে আসার চেষ্টা করেনি। আওয়ামী লীগ নিজের ক্ষতি সাধন করে জাতীয় ঐক্যের রাজনীতির পথ দেখিয়েছে। নির্যাতন-নিপীড়নের কথা ভুলেও আওয়ামী লীগ মিলে মিশে চলার চেষ্টা করেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কথা একটু ভেবে দেখি না কেন? বিএনপি কেন, দেশের কেউ তখন ভাবেননি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে না। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বেশি ভোট পেয়েও ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়েছিল।

কারা ষড়যন্ত্র করেছিল, কীভাবে করেছিল সেটা অনেক বড় আলোচনা। যাহোক আওয়ামী লীগের জন্যে ছিল সেটা বড় রকমের ধাক্কা। তারপরও আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। কত অপমান না করা হয়েছে, ১৯৯১ এর জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনার ক্রমিক নম্বর ছিল ছয়। এমনকি বঙ্গবন্ধু’র হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কত জটিল পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল তা এখন ভেবে দেখেন না। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বেশি ভোট পেয়েও ক্ষমতায় যেতে না পারলেও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা থেকে একবিন্দু সরে আসেনি।

আমাদের দেশের কেউ কেউ হঠাৎ করে বিশুদ্ধবাদী হতে চায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তাদের বিশুদ্ধবাদিতার যেন অন্ত নেই। তারা সকল কাজেই আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ভালটায় প্রত্যাশা করে; অথচ আওয়ামী লীগের সামান্য ত্রুটি নিয়ে আকাশ বিদীর্ণ করে। বিদগ্ধজনেরা কি ভেবে দেখেছেন, এই অচলাবস্থা কোথা থেকে শুরু। ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা ২ আসনের উপনির্বাচন শুধু আওয়ামী লীগ কেন সমগ্র বাংলাদেশ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ মনে করেছিল মাগুরা উপনির্বাচনে তাদের পরাজয়ের পেছনে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কারসাজি ছিল।

নির্বাচন কমিশন অভিযোগের নামকাওয়াস্তে তদন্ত করে। সেসময় পুনরায় মাগুরা উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হয়েছিল। তখনকার আওয়ামী লীগের বক্তব্য কতটা সঠিক ছিল, সেটা বোঝা যায় সেই প্রধাননির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ চৌধুরী পরবর্তী জামাত বিএনপি ঘরণার অন্যতম বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রকাশ্যে দেখা গেছে।

একবারও কি ভাবা হয় খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ভোটাররা কেন বিএনপি’র প্রার্থীকে ভোট দেবে? বিএনপি’র মেয়র থাকা অবস্থায় খুলনাবাসী কি নাগরিক সুবিধা পেয়েছিলেন। এ কথা সর্বজনবিদিত আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জন্যে ভাবেনি এবং কিছুই করেনি। বরংচ খুলনা মহানগরকে সন্ত্রাসের নগরীতে পরিণত করেছিল। বিএনপি’র লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীরা হুমায়ুন কবীর বালু, মানিক সাহার মতো প্রথিতযশা সাংবাদিকদের হত্যা করেছিল। মঞ্জুরে ইমাম এর মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদকে জামাত বিএনপি’র শাসন আমলে হত্যা করা হয়েছে। তাই স্বাভাবিক কারনে খুলনার জনগণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেই বেছে নিয়েছে।

গাজীপুরের মানুষ সবসময় আওয়ামী লীগের সাথে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনায় থাকলে গাজীপুরের মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন হয়। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনের সময় ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। হাইতির ভূমিকম্পের ছবি মোবাইলে ধারণ করে বিশেষকরে নারী ভোটারদের বলা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার ৫ মে শাপলা চত্বরে হাজার হাজার আলেম হত্যা করেছে। এটা যে একেবারেই মিথ্যা ছিল তা গাজীপুরবাসীর বুঝতে বাকি নেই। গাজীপুরেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়, গাজীপুরবাসী সেই ঐতিহ্যধারণ করে, গাজীপুরবাসী শান্তি চায়, গাজীপুরবাসী উন্নয়ন চায়, তাই তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বেছে নেবে। আমাদের দেশের বিদ্যার জাহাজরা যাই বলুক না কেন।

# পুনশ্চ : রাস্তায় গোপাল ভাঁড়ের সঙ্গে দেখা তার এক পরিচিত লোকের। ওই লোকের সঙ্গে ছিল আরও একজন। সে তাকে গোপালের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললো, ‘এই ভদ্রলোককে চেনো? এর নাম বিদ্যাচরণ পণ্ডিত। একেবারে বিদ্যার জাহাজ। তোমার মতো গবেট নন।’ গোপাল এতে করে মোটেই বিচলিত হলো না। বেশ শান্তভাবেই বলল, ‘বিদ্যার জাহাজকে রাস্তায় রেখেছেন কেন? জলে ভাসিয়ে দিলেই তো ভালো হয়।’

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এসএইচএস/আরআইপি

আরও পড়ুন