কালোবাজারির পকেটে কত টিকিট!
বারান্দা থেকে সাইকেল বের করতে দেখে তাসিন মিয়া জানতে চাইল-
: আব্বু, কোথায় যাচ্ছ?
: কমলাপুর।
: কী জন্য!
: ট্রেনের টিকিট কাটতে।
: আমিও তোমার সঙ্গে যাব।
: আমার সঙ্গে যাবা মানে? নীরবে বিছানায় শুইয়া থাক।
: আমি যাব।
: কী যন্ত্রণা! আরে মিয়া, আমি কী প্রাতঃভ্রমণে যাইতেছি? ইস্টিশনে হাজার হাজার মানুষ মাছির মতো ভনভন করতেছে। এই ভিড়ের মধ্যে তুমি সেখানে যাইয়া কী করবা?
তাসিন মিয়া দেখল, এভাবে কাজ হবে না। সে বিকল্প পথ ধরল। হেড অফিসের অনুমোদন পাওয়ার জন্য কাঁদো কাঁদো গলায় চেঁচিয়ে উঠল-
: আ-ম-মু!
ছেলের হাহাকার শুনে তাসিনের আম্মা শোবার ঘর থেকে এক লাফে ডাইনিং রুমে চলে এলো। তারপর চোখ কচলাতে কচলাতে বলল,
: কী হইছে!
তাসিন মিয়া উঃ উঃ করে বলল-
: আমি আব্বুর সঙ্গে যাব।
তাসিনের আম্মা হাফ কিলোমিটার লম্বা একটা হাই তুলে ঘুম জড়ানো গলায় আমার দিকে ফিরে বলল-
: পোলাপান মানুষ। যাবার চাইতেছে যখন, লইয়া যাও।
: কেমনে লইয়া যাব!
: কেমনে লইয়া যাবা মানে? তোমারে কী কান্ধে কইরা লাইয়া যাইতে বলছি? সাইকেলে কইরা লইয়া যাবা! কোনো অসুবিধা আছে?
মাথা নেড়ে বললাম-
: জি না।
অর্ডার পাস হওয়ার পর তাসিন মিয়া এক নিমিষে জুতা-মোজা পরে রেডি। বারান্দায় স্ত‚প করে রাখা জিনিসপত্র হাতড়াচ্ছি দেখে তাসিনের আম্মা অবাক হয়ে জানতে চাইল-
: কী খোঁজ?
: দড়ি।
: দড়ি! দড়ি দিয়া কী করবা তুমি?
: ইস্টিশনে মানুষের গিজগিজা ভিড়। এই ভিড়ের মধ্যে তাসিন মিয়া যদি হারাইয়া যায়! সেইজন্য দড়ি লইয়া যাইতেছি। দড়ির এক মাথা তাসিনের কোমরে বান্ধা থাকবে, আরেক মাথা আমার কোমরে। এর ফলে হারাইয়া যাওয়ার কোনো চান্স থাকবে না।
পরিকল্পনা শুনে তাসিনের আম্মার চোখ থেকে ঘুম-ঘুম ভাব উবে গেল। সে সরোষে বলে উঠল-
: তুমি আসলেই একটা আজাইরা কামের হেডমাস্টর। ছেলের কোমরে দড়ি বাইন্ধা স্টেশনে ঘুইরা বেড়াবে- ইঃ! কী বুদ্ধিটা বাইর করছে। শোন, তুমি সারাক্ষণ ওর হাত ধইরা থাকবা। এক সেকেন্ডের জন্যও হাত ছাড়বা না।
: জি, আইচ্ছা...
সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হলাম। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার মতো রাতের অতল আঁধার থেকে নতুন একটি দিনের জন্ম হচ্ছে। রাস্তা মৃত অজগরের মতো নিথর। চিরচেনা ঢাকার এ এক ভিন্ন রূপ। ভিন্ন আমেজ। এ আমেজ গায়ে মেখে কোনোরকম বিরতি ছাড়া একটানে কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।
স্টেশন জনারণ্য। বিশাল লম্বা লাইন। পোশাকের দোকানে সাজিয়ে রাখা প্লাস্টিকের অনড় মূর্তির মতো কেউ বুক চিতিয়ে, কেউ কাত হয়ে, আবার কেউ ঝিম ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। লাইনের লেজ খুঁজতে গিয়ে মাথা খারাপ হওয়ার দশা। হায় সোবাহান আল্লাহ! মনে হচ্ছে, ঈদের আগে এই লাইনের চান্দি পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে না। এখন উপায় কী?
এরকম অবস্থায় মানুষ ফ্যান্টাসি ধরনের চিন্তাভাবনা করতে পছন্দ করে। আমিও সেরকম ভাবনায় আক্রান্ত হলাম। কল্পনায় দেখলাম- পূর্বপরিচিত ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার ইয়াসিনকে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাহিনী নিয়ে স্টেশনে হাজির হয়েছে। সে তার অস্ত্র উঁচিয়ে হঠ যাও- হঠ যাও বলতেই পুরো স্টেশন ফাঁকা। এখন আর টিকিট কাটতে কোনো সমস্যা নেই।
হঠাৎ লোকজনের হট্টগোলে ইয়াসিন ফ্যান্টাসির জাল ছিন্ন হয়ে গেল। বিসিক আয়োজিত এক মধুমেলায় মৌচাষী মকবুলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমার কাছে তার কোনো ফোন নম্বর নেই। তাতে কী? ফ্যান্টাসির কারবারে বাস্তবে কোনো কিছু থাকার প্রয়োজন নেই। মৌচাষী মকবুলকে ফোন করলাম।
কিছুক্ষণ বাদে কয়েক বাক্স মৌমাছি নিয়ে মকবুল স্টেশনে হাজির হয়ে গেল। বাক্স থেকে মৌমাছিগুলো অবমুক্ত করতেই লাইন ভেঙে মানুষজন বেদিশা হয়ে দৌড় দিল। এবার ফাঁকা স্টেশনে গোল্লাছুট খেলতে খেলতে টিকিট কাটলেও বাধা দেয়ার কেউ নেই।
নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত এক পুলিশ বাঁশিতে পুরুৎ-পুরুৎ হুইসেল বাজাতেই মকবুল-ফ্যান্টাসি ধোয়াশার মতো মিলিয়ে গেল। ধাতস্থ হয়ে ভাবলাম- ধুর! কিসের ইয়াসিন, কিসের মকবুল! নিজের কব্জির জোরই বড় জোর। এবারের ফ্যান্টাসি পর্বে হাতের কব্জি উঁচিয়ে নিজেকে গালকাটা আলালের ছোটভাই পিস্তল দুলাল বলে ঘোষণা করলাম। কল্পনার চোখে দেখলাম- ঘোষণা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ং স্টেশন ম্যানেজার টিকিট হাতে আমার সামনে খাঁড়া।
তাসিন মিয়ার ডাক শুনে সম্বিত ফিরল। হাজার মানুষের ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করলাম- কল্পনার সঙ্গে বাস্তব জগতের আসলেই যোজন-যোজন ফারাক। কল্পনায় আমি আলাল, দুলাল, পিয়ারিলাল- অনেক কিছুই হতে পারি।
ঝুক্কুর-ঝুক্কর ট্রেনকে উষ্টা মেরে প্লেনে চড়ে বাড়ি চলে যেতে পারি। কিন্তু বাস্তবে ঈদের আগে ট্রেনে বাড়ি যেতে হলে আমাকে অবশ্যই টিকিট জোগাড় করতে হবে। শেষমেষ স্টেশনে দায়িত্ব পালনরত এক কর্মকর্তার শরণাপন্ন হলাম। তার কাছে নিজের পেশাগত পরিচয় দিয়ে বললাম-
: ভাই, আমারে মমিসিংয়ের কয়েকটা টিকিটের বন্দোবস্ত কইরা দেন।
ভদ্রলোক গভীর আগ্রহ নিয়ে আমার যাত্রার তারিখ জানতে চাইলেন। আমি তারিখ বলতেই তিনি উফ্ বলে চেয়ারে নেতিয়ে পড়লেন। দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে আস্তে করে জানতে চাইলাম-
: ভাই! কী হইল আপনের!
ভদ্রলোক মুখ দিয়ে ফোঁস করে দম ছাড়লেন। তারপর বললেন-
: বিষয়টা আমার জন্য খুবই দুঃখজনক। ওই তারিখের সব টিকিট তো এরইমধ্যে বিক্রি হইয়া গেছে। আমি খুবই দুঃখিত...
ভদ্রলোকের ব্যবহারে বাপবেটা মুগ্ধ হয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। টিকিট না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে প্লাটফরমে এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি- এমন সময় এক লোক ফিসফিস করে বলল-
: স্যার, টিকিট লাগবে?
হ্যাঁসূচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে নির্ধারিত তারিখ ও গন্তব্যের কথা বললাম। লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে টিকিটের বান্ডেল বের করতেই আমি আমার ছেলের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বাংলাদেশকে দেখতে পেলাম। এরপর আর দেরি করলাম না। লোকটার ঘাড়ে ধরে টানতে টানতে উক্ত কর্মকর্তার সামনে হাজির হয়ে বললাম-
: একটু আগে আপনি বললেন- সব টিকিট বিক্রি হইয়া গেছে। অথচ দেখেন, এই কালোবাজারির পকেটে কত টিকিট!
ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন-
: চারপাশের পরিবেশ, রাজনৈতিক কালচার- সবই তো বোঝেন ভাই; যেহেতু আপনি একজন কবি।
সংশোধনী দিলাম-
: কবি নই, সাংবাদিক।
দেখলাম, তিনি খুবই ওস্তাদ লোক। আমার কথায় একটুও বিব্রত না হয়ে বললেন-
: ভাই, সাংবাদিকরা হইল বড় কবি। তারা যেভাবে শব্দের পরে শব্দ সাজায়...
: আপনি ভুল বললেন, সাংবাদিকরা শব্দ সাজায় না; তারা সত্য ঘটনার বর্ণনা দেয়।
চাপাচাপি করায় ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত রেলওয়ে পুলিশকে খবর দিলেন। টিকিট কালোবাজারির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন-
: এর কঠিন শাস্তি হবে; আপনি নিশ্চিত থাকুন।
ভদ্রলোকের কথায় সংশয়মুক্ত হতে পারছিলাম না। এ সময় তাসিন বলল-
: কালোবাজারিকে না ধরে আমরা যদি তার কাছ থেকে টিকিট নিয়ে নিতাম, তাহলে এত ঝামেলা হতো না!
ছেলের মাথায় হাত রেখে বললাম-
: কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন তুমি অবস্থান নিবা, তখন কিছু না কিছু ঝামেলা পোহাতেই হবে। এখন বল, কোনো অন্যায় ঘটতেছে দেখার পরও ঝামেলার ভয়ে তুমি পিছাইয়া যাবা?
: না।
: ভেরিগুড। আমি তোমারে স্যালুট জানাইলাম।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/আরআইপি