জিয়ার মরণোত্তর বিচার ও বীর তাহের
এবারও প্রায় নিরবে-নিভৃতে কেটে গেছে দিনটি । প্রতি বছরই এমন হয়। এবার আমার কাছে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে শুধু একটি কথায়। জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুর বক্তব্য- জিয়ার মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত। এটাও সম্ভবত পুরোনো দাবি। আদালতের রায়ের পরই এই দাবি তোলা হয়েছিলো। তবে তাতেই বা কি? এখনকার ছেলেমেয়েরাতো এটাও জানেনা যে, কেন জিয়ার বিচার হতে হবে। যাহোক এবারও কোনো কোনো পত্রিকায় ছোট করে তাহেরের ফাঁসির খবর ছাপা হয়েছে। কোনো কোনো মিডিয়ায় এ বিষয়ে কার্যত একটি বাক্যও ছিলোনা। কে জানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কেন ফাঁসিতে ঝুলতে হলো? কে জানে কেন একজন পঙ্গু মানুষকে বিনা বিচারে ফাঁসি দেয়া হয়?
এবারের ২১ জুলাইতে দুয়েকটি টিভি চ্যানেল টক শোর আয়োজন করেছে। প্রধানত তাহের পরিবারের সদস্যরা বা জাসদের নেতারা তাহের সম্পর্কে কথা বলেছেন। জাসদ তার রুটিন আলোচান সভা করেছে। দুএকজন সাধারণ মানুষও তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তবে বাস্তবতা হলো; ২১ জুলাই, ৭ নভেম্বর বা ১৪ নভেম্বর; কোনোটাই এই জাতির নজরে পড়ে না। কারও নজরে পড়ার কোনো লক্ষণও দেখিনি এই দিনগুলো সম্পর্কে। মনে হয়েছে, কে খবর রাখে নেত্রকোণা জেলার শ্যামগঞ্জের এক অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে তাহেরকে। ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর জন্ম নিয়েছিলো এই শিশু তাহের। সেই তাহেরের হাতে জন্ম নিয়েছিলো পচাঁত্তরের বিপ্লবী ৭ নভেম্বর। এই বিপ্লবীকে জিয়াউর রহমান আটক করে একতরফা গোপন বিচার করে ফাঁসি দিয়েছিলো। ২১ জুলাই তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। ৭ ভাই ও ৪ বোনের সেই পরিবারটি পুরোটাই মুক্তিযোদ্ধা। তাহের ছাড়াও এই পরিবারে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া আরও তিনটি বীরত্বের খেতাব।
এই পরিবারটির কথা যদি নাও বলা হয় তবে তাহেরকে ভুলে যাওয়া এই জাতির পক্ষে কোনোভাবেই উচিত নয়। বিশেষ করে ২১ জুলাই। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি। এবারও আমরা একুশে জুলাই স্মরণ করিনি। জুলাই মাসের এই একুশ তারিখে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে পচাঁত্তরের পনেরোই আগষ্ট থেকে হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয় তাহের হয়ে ওঠেন তার নির্মম বলী। তবে ইতিহাসের চাকা কেবল উল্টো গতিতেই চলে না। একদিন সেই চাকা সঠিক পথে চলে এবং সত্য তার শত সহস্র বাধা অতিক্রম করে আত্মপ্রকাশও করে। তেমনটিই ঘটেছে কর্নেল তাহেরের ক্ষেত্রেও।
সেজন্যই ২০১১ সালের মার্চ, একুশে জুলাই এবং ২০১৩ সালের মে বা ২১ জুলাই একটু ভিন্ন মাত্রার ছিলো। ১১ সালের মার্চে দেয়া দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জিয়ার হাতে নিহত তার ভাষায় ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ তাহের একজন মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে আদালতের স্বীকৃতি পান। ২০১৩ সালে সেই রায়টির পুরোটা প্রকাশিত হয় যাতে জিয়াকে তাহেরের ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১১ সালেই আদালত তাহেরকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছিলো। সেই বছর ২২ মার্চ ২০১১ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত জিয়াকে শহীদ তাহেরের ঘাতক বলে প্রথম চিহ্নিত করেছে এবং শহীদ কর্নেল তাহেরকে দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ২০১৩ সালের মে মাসে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপিতে তারই বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে এবং জাতি তাহের হত্যার আদ্যোপান্ত বিস্তারিতভাবে জানতে পেরেছে। লাল সালাম কমরেড তাহের।
আমাদের জাতীয় জীবনের এক ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে, স্বাধীনতা ঘোষণার মাস মার্চে দেয়া এই রায়কে এই জাতির পরম পাওনা বলেই মনে করা হয়েছে । মনে করতে হবে, ইতিহাসের আরও একটি কলঙ্কময় অধ্যায়ের গহ্বর থেকে মুক্তি পেলাম আমরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনের বিচার ও ফাঁসির রায় কার্যকর করার পর, জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসন নিয়ে দেয়া সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের ঐতিহাসিক রায় এবং সবশেষে তাহের হত্যা মামলার এই রায় আমাদেরকে ইতিহাসের পাতার সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো হিসেবে দেখার সুযোগ করে দিলো। যারা আমাদের পায়ের পাতাটি উল্টো দেখেছেন তারা এবার সোজা পায়ে হাঁটুন।
যারা পচাঁত্তর দেখেননি, যারা সেই বছরের পনেরোই আগস্ট, তিন নভেম্বর এবং সাতই নভেম্বর দেখেনি, যাদের স্বজনরা জিয়ার হাতে খুন হয়নি, যারা নিজেরা বা যাদের নিকট আত্মীয়রা জিয়ার কারাগারে থাকেনি বা তখনকার সামরিক গোয়েন্দাদের হাতে নির্যাতন সহ্য করেনি, আশা করি এখন তারাও স্পষ্ট করে চিনতে পারবেন ইতিহাসের খলনায়ক কে, আর প্রকৃত দেশপ্রেমিক কে। ধারণা করি, জিয়ার প্রকৃত চেহারাটা জাতি এখন দেখতে পাবে। কর্নেল তাহেরের ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ার হোসেন গত ২২ মার্চ ১১ রাতে এটিএন নিউজে, ২১ জুলাই ১৩ একাত্তর টিভিতে জিয়ার ক্ষমতা দখলের পর থেকে সামরিক শাসনের আড়ালে কিভাবে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গোপন বিচার এবং ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে সেই লোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন।
তিনি বিবরণ দিয়েছেন, কিভাবে তাহেরর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। একইভাবে গত ২১ জুলাই ১৩ এক আলোচনায় একজন বিচারপতি দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আর একটি মানুষের নাম নিতে হলে সেটি হতে হবে কর্ণেল তাহের। বিচারপতি মহোদয় আরও একটি কথা বলেছেন। সেটি হচ্ছে; তাহের ছিলেন এদেশের দরিদ্র, শোষিত জনগণের বন্ধু। তিনি শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। কেউ যদি তাদের সেই কথাগুলো শুনে থাকেন তবে নিশ্চিতভাবেই এটি অনুভব করবেন যে, ইতিহাস বড় নির্মম। সত্য বড় কঠিন। খুব সহজে এই সত্যকে মোকাবেলা করা যায় না। ইতিহাসের শিক্ষা হলো মিথ্যা দিয়ে সত্যকে খুব বেশি দিন ঢেকেও রাখা যায় না।
এটি সত্য যে, এদেশের কটি মানুষ তাহেরের নাম জানে। পচাঁত্তরের পর জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্মের কাছে একটি বিস্মৃত নাম তাহেরের। তারা কেবল জিয়ার নাম জানে। সেটিও তাহেরের ঘাতক হিসেবে নয়- জাতীয় বীর হিসেবে। তারা এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আর কোনো সেক্টর কমান্ডারের নামও ভালোভাবে জানে না। তাদের ধারণা, একজন মেজর জিয়া রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা বাক্য পাঠ করলো এবং দেশটা স্বাধীন হয়ে গেলো। তারা এটি বোঝে না যে, এতে ২৫ শে মার্চ রাতের আগে বা পরেও দেশের লক্ষ কোটি মানুষের অবদানকে মুছে ফেলা হয়েছে। জাতির জনকের নাম তারা ভুলাতে পারেনি- কারণ তার একটি বিশাল রাজনৈতিক দল আছে। চেষ্টা করা হয়েছিলো সেটিও মুছে ফেলার। কিন্তু বাপের বেটি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের জন্য সেটিও করা হয়ে ওঠেনি।
তাহেরের তেমন রাজনৈতিক দল ছিলো না। তার রাজনৈতিক দল জাসদকে জিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ করে টুকরো টুকরো করে ছেড়েছে। জিয়া জাসদের নেতাদেরকে জেল খাটিয়েছে, তাহেরের মতোই বিনা বিচারে আটক করেছে বা খুন করেছে। নিদেন পক্ষে নির্যাতন করেছে। সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধার ঘাতক জিয়ার রোষাণল থেকে মুক্তিযোদ্ধানির্ভর জাসদ তাই নিজেকে রক্ষাও করতে পারেনি। এমন একটি বিশ্বাসঘাতকতাকে হজম করার ক্ষমতাও জাসদের ছিলো না। ফলে দিনে দিনে জাসদ একটি অতি ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়, বিভক্ত হয় এবং জিয়ার অত্যাচারে-নিপীড়নে বিপর্যস্ত জাসদ কর্মীদের বেশির ভাগ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এদের কেউ কেউ যোগ দেয় জাতীয় পার্টিতে। কেউ বা যোগ দেয় আওয়ামী লীগে। কেউ কেউ এখনও জাসদ-বাসদের পতাকা নিয়ে রাজনীতি করে। কেউ যে জিয়ার দলে যোগ দেয়নি তা-ও নয়। শাহজাহান সিরাজ বা আব্দুস সালাম জাসদের দুই বড় নেতা ছিলেন। তারা এখন বিএনপি করেন। জাসদ নেতা মাহমুদুর রহমান অাওয়ামী লীগ হয়ে এখন নাগরিক ঐক্য করছেন।
কেউ যদি আজ ইতিহাসের পাতা থেকে সেই তাহেরকে খোঁজে বের করেন যিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন এবং নিজের রক্ত দিয়ে, একটি পা খুইয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলেন তবে তারা অন্তত তাহেরের আদালতের জবানবন্দী এবং জেলখানা থেকে পাঠানো তার শেষ চিঠিটা পাঠ করবেন। আমি তার বক্তব্যের একটি অনুচ্ছেদ এখানে তুলে ধরছি- “আমি যখন একা থাকি তখন ভয়-লোভ লালসা আমাকে চারদিক থেকে এসে আক্রমণ করে। আমি যখন আপনাদের মাঝে থাকি তখন সমস্ত ভয় লোভ লালসা দূরে চলে যায়। আমি সাহসী হই-বিপ্লবের সাথী রূপে নিজেকে দেখতে পাই। সমস্ত বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করার এক অপরাজেয় শক্তি আমার মধ্যে কাজ করে। তাই আমাদের একাকিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আমরা সবার মাঝে প্রকাশিত হতে চাই। সেজন্যই আমাদের সংগ্রাম।” পয়ত্রিশ বছর পর ২০১১ সালে সেই অপরাজেয় তাহের আরেকবার জয়ী হলেন।
যারা বাঙালি জাতির মাঝে বীর খোঁজে পান না, তাদেরকে অনুরোধ করছি, আদালতের রায়ে শহীদের সম্মান পাওয়া তাহেরের জীবনীটা একটু পাঠ করে দেখুন। ইন্টারনেটেই পাবেন তার ইহিতাস।
মরহুম জিয়াউর রহমান এতোদিন পর্যন্ত সামরিক শাসন, সংবিধান লঙ্ঘন এবং দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্যই অভিযুক্ত হয়ে আসছিলেন। জাসদের ঘাড়ে চড়ে কর্নেল তাহেরের সাথে বেইমানি করে সিপাহী জনতার বিপ্লবের নামে স্বৈরশাসন কায়েম করেও তাকে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারকারী বলে প্রচার করা হতো। এই প্রচারের তেমন কোনো কার্যকর বিরোধিতা কারও পক্ষেই করা সম্ভব হচ্ছিলো না। জিয়ার বিপক্ষের বক্তব্যগুলোও প্রধানত ছিলো রাজনৈতিক। মূলত আওয়ামী লীগ শিবির থেকে অভিযোগগুলো তোলা হতো বলে অনেক নিরপেক্ষ মানুষ মনে করতো যে, আওয়ামী লীগ জিয়াকে কলঙ্কিত করার জন্যই এসব কথা বলে থাকে। জিয়ার হাতে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত জাসদ এতো বড় দল নয় যে, তারা তাদের মনের কষ্টের কথাও বলতে পারে। সম্ভবত এই কারণেই দেশে জিয়ার ভক্তের সংখ্যা কমেনি। সেই যে পচাঁত্তরে আওয়ামী লীগ বিরোধী, পাকিস্তান পন্থী, মুসলিম বাংলার ধারক, আলবদর-রাজাকার বা তাদের দোসররা জিয়ার সাথে আঁতাত করে নতুন রাজনৈতিক প্লাটফরম তৈরি করে সেই ঐক্য সাইত্রিশ বছরেও ভাঙেনি। এমনকি ৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগও জিয়ার লিগ্যাসিতে সামান্যতম আচড় রাখতে পারেনি। জিয়ার গায়ে কালো দাগ ফেলাতো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার করাই তখন শেষ করা সম্ভব হয়নি। জননেত্রী শেখ হাসিনা কোনোমতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার কার্য শুরু করে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন মাত্র। এরপর দোর্দণ্ড প্রতাপে আবার জিয়ার লিগ্যাসি ক্ষমতায় বসে। আবারও পাল্টানো হয় ইতিহাস। আবারও নায়ক হয়ে বসেন মরহুম জিয়াউর রহমান।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান কেবল একটি নাম নয়। তিনি নিজেই একটি কুপ্রতিষ্ঠান। তার ইন্সটিটিউশনকে বরং অপপ্রতিষ্ঠান বললে বোধহয় সঠিক অভিধা প্রদান করা হবে। তিনি তেমন একটি অপপ্রতিষ্ঠান, যা থেকে বাংলাদেশের জন্মকে উল্টো খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী-ঘাতক-দালাল বা পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকদের পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিনাবিচারে বা পাইকারীভাবে হত্যা করা বা পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনানায়কদের দুরভিসন্ধির সাথে যুক্ত থাকা; এসবতো আছেই উপরন্তু, বাংলাদেশের জাতিরজনককে হত্যা করা ও দেশের জন্মকে পাকিস্তানের কাঠামোতে ফেরৎ নেবার সকল প্রয়াসের সাথেই তিনি ও তার ইন্সটিটিউশন যুক্ত।
অনেকেই এটি নিশ্চিতভাবেই মনে করেন যে, ৭৫ সালে জাতির জনককে যে হত্যা করা হয়, যার বেনিফিসিয়ারি তার দলসহ তিনি নিজে, সেই খবরও জিয়া আগে থেকেই জানতেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে যা যা ঘটেছে তার পুরো বিবরণ এখনও সাধারণ মানুষ জানে না। সামরিক আদালতে বিচারের নামে প্রহসন করে কতো মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে বা মুক্তিযোদ্ধাদের কতোজনকে ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের সাথে যুক্ত বলে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তারও বিবরণ আমরা জানি না। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার নামে ৭৫ থেকে ৭৭ সময়কালে একনায়কী ব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিলো। সেদিন আমেরিকা প্রবাসী একজন বিমান সেনা (অব.) আমাকে মেইলে জানিয়েছেন যে, ১৯৭৫ থেকে ৭৭ সময়কালে শুধুমাত্র বিমানবাহিনীর ৪৬২ সৈনিককে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে।
ঘটনাচক্রে জিয়াউর রহমান কেবল যে নিজেই পাকিস্তানের লিগ্যাসি রক্ষার কাজটি করে গেছেন সেটি নয়, সেই ধারাবাহিকতা এখনও সমানতালে বিদ্যমান। তার দল বিএনপি, তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা কোমর বেধে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে সক্রিয় আছেন। প্রয়াত পুত্রও একই কাজ করে গেছেন। তাদের রাজনীতি এখনও জিয়াউর রহমান প্রদর্শিত পথেই চলছে। একাত্তরের ঘাতকদের রক্ষা করা থেকে শুরু করে পাকিস্তানপন্থী, উগ্রবাদী, জঙ্গীবাদী ও তালেবানী রাজনীতি চর্চায় জিয়ার দল ও তার জোট এখনও প্রবলভাবে সক্রিয়। আমরা বিস্মিত না হয়ে দেখলাম যে, বেগম জিয়া নিজে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দাবি করলেন এবং বিচার বন্ধ করার দাবি তুললেন। একই সাথে তিনি তালেবানি ছকের হেফাজতি ১৩ দফা দাবিকে সমর্থন দিলেন। এমনকি বিএনপি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এটি আমাদের দুর্ভাগ্য যে, একাত্তরে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করতে পারিনি। বস্তুত একাত্তরের যুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলায় বাংলাদেশের নীতি ও আদর্শবিরোধী শক্তিকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধটা যদি নয় মাসে শেষ না হয়ে নয় বছরে শেষ হতো তবে যেমন করে শত্রু-মিত্র চেনা যেতো তেমন করে শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করাও সম্ভব হতো। যুদ্ধটা দ্রুত শেষ হবার ফলে এমনকি একাত্তরে তারা বেকায়দায় পড়লেও পচাত্তর পরবর্তীকালে ওরা বিপুল বিক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে এখন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে আছে। জামাত বলি আর হেফাজত বলি, বিএনপি বলি আর এলডিপি-বিকল্প ধারা বলি, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের একটি বর্ধিত অংশে পরিণত করাই হচ্ছে তাদের প্রধান এজেন্ডা।
স্বাধীনতা উত্তরকালে গোড়ার দিকেও এর ব্যতিক্রম ছিলোনা। আমি স্মরণ করতে পারি সেই সময়ে কেউ কেউ মুসলিম বাংলা শ্লোগান দিয়ে বাংলাদেশকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বদলে পাকিস্তানের মতো একটি ইসলামী রিপাবলিক বানাতে চেষ্টা করছিলো। সেই সময়কালের উগ্র ডান ও উগ্র বাম দুই পক্ষেরই মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশকে তার জন্মের আদর্শ থেকে সরিয়ে নিয়ে পাকিস্তানের মতো ইসলামী রাষ্ট্রে কেন্দ্রিভূত করা। একই কারণে স্বাধীনতার পরপরই ভারত বিরোধিতা একটি প্রবল রাজনৈতিক শ্লোগানে পরিণত হয়। তাহের সেটি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি এটিও উপলব্ধি করেছিলেন যে, আমাদের মতো অনুন্নত রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীকেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। যেহেতু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একেবারে শূন্য থেকে গড়ে ওঠেনি এবং পাকিস্তানের আদর্শে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনীই এদেশের প্রধান সামরিক শক্তি ছিলো সেজন্যই তিনি একটি গণমুখী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী হবে শোষিত জনতার বন্ধু। তারা বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে সেবা দেবে না, শোষণ বঞ্চনার অবসান ঘটাবে। তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নীতি ও আদর্শ বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। তবে তাহেরের সবচেয়ে বড় ভুলটি সম্ভবত ছিলো যে, তিনি মরহুম জিয়াউর রহমানের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, জিয়া তার সাথে থাকবেন। জিয়া তাহেরকে সেই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেনানিবাস থেকে মুক্ত হয়েই জিয়া তাহেরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হন। যে তাহেরের পক্ষে জিয়ার ভাষণ দেবার কথা যে তাহেরের সাথে শহীদ মিনারে সমাবেশ করার কথা, জিয়া তার কোনোটাই করেননি। বরং বেছে নেন ষড়যন্ত্রের পথ। জিয়াপন্থী মওদুদ আহমেদ তার বইতে ষ্পষ্ট করে লিখেছেন যে, তাহেরের বিচারের আগেই নির্ধারণ করা ছিলো যে, তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হবে। এমনকি তখনকার রাষ্ট্রপতি সায়েম তাহেরের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করতে চাইলেও জিয়া সেটি করতে দেননি। এটি এখন স্পষ্ট যে, তাহেরের বিচারের আদালতের বিচারক ইউসূফ হায়দার প্রতিদিন জিয়ার সাথে তাহেরের বিচার নিয়ে পরামর্শ করতেন। তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে তারপর যে ফাঁসির আদেশের আইন সংশোধন করা হয়েছে সেটিই এখন স্পষ্ট। কিন্তু তাকে কি? জিয়ার পরে এরশাদ ক্ষমতায় আসেন এবং এরশাদের পর ক্ষমতায় আসেন বেগম জিয়া। ইতিহাসের সেই নির্মম সত্যকে ওরা কেন প্রকাশ করবে। এরশাদ জিয়ার জুতাই পায়ে দিয়েছিলেন। বেগম জিয়াতো জিয়ারই প্রতিনিধি।
মাঝখানে আওয়ামী লীগের পাঁচ বছর অতিক্রান্ত করে ২০০১-২০০৬ সময়কালে পুরো পাঁচটি বছর ক্ষমতাসীন থেকে বেগম জিয়ার দুঃশাসন বা তারেক কোকোর লুটপাটের পরও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে ক্ষমতার পালাবদল হয়। তবে সেবারও অনেক মানুষ বাক্স ভরেই জিয়ার দলকে ভোট দিয়েছে। অন্য সময়ের চাইতে সেবার কিছু কম লোক ভোট দেবার ফলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারেনি। তবে শতকরা হিসাবটা কিন্তু মোটেই ফেলে দেবার মতো নয়। বেগম জিয়ার চরম অথর্বতা এবং তারেক-কোকোর প্রমাণিত লুটপাটের পরও জিয়ার লিগ্যাসি কাজ করেছে। তবে এবারতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা দল নয়, জিয়ার কোনো প্রতিপক্ষ নয় বরং দেশের উচ্চ আদালত একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। তারা কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা বিভ্রান্তি না রেখে স্পষ্ট করে বলেছে যে, জিয়া একজন ঘাতক। তবে জিয়ার অন্ধ অনুসারীরা যে এই রায়ের পরেও থেমে নেই তার প্রমাণ আমরা ২২ মার্চ ১১ রাতেরই একটি টিভি চ্যানেলে দেখেছিলাম। তাহের হত্যা মামলার রায়ের ওপর যখন দুজন সাংবাদিক আলোচনা করছিলেন তখন জিয়ার সেই ভক্ত তাদেরকে বলেছিলেন, জিয়াকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া বা প্রেসিডেন্ট জিয়া বলার জন্য। কি চমৎকার আব্দার। জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বললেও হয়তো দাবির একটি সারবত্তা থাকতো-কিন্তু শহীদ! যার হাতে মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার এবং হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ঠাণ্ডা মাথায় খুন হয়েছে তাকে শহীদ বলা? আদালত যাকে ঘাতক বলছে তাকেই শহীদ বলতে হবে? আর কতো বিচিত্র হবে এই দেশ!
দেশের সর্বোচ্চ আদালত জিয়াকে খুনি আর তাহেরকে দেশপ্রেমিক বলে যে রায় প্রদান করে তাকে এক বাক্যে বলা যায়, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এই বাংলা প্রবাদ বাক্যটি বাংলাদেশের জিয়া ভক্তদের মোটেই ভালো লাগবে না। এমন আরও দুচারটি প্রবাদ তাদের পছন্দ নাও হতে পারে। যদি বলা হয়, সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না, তবে সেটিও তাদের ভালো লাগবে না। মরণজয়ী তাহের যে এভাবে জয়ী হবেন এবং সত্য যে এভাবে প্রকাশিত হবে সেটি হয়তো তারা ভাবেননি। ভালো লাগার কথা নয়, ভাবারও কথা নয়। কারণ তারা মনে করে, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় না আসতো তবে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন, ক্ষমতা দখল, সংবিধান সংশোধন বা শহীদ কর্নেল তাহেরের বিচারের রায় এভাবে তাদের বিপক্ষে যেতোনা। তারা বরং মনে করে থাকতে পারে যে, আদালত সরকারের ইচ্ছায় কাজ করেছে। এমনভাবে তারা বলেছিলো যে, সরকার বিদেশ থেকে সাংবাদিক ভাড়া করে এনে জিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলিয়েছে। প্রসঙ্গটি ছিলো বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক লরেন্স লিফসুটজকে নিয়ে। বিএনপির নেতারা গলার স্বর উঁচু করে লিফটসুজকে গালিগালাজও করেন। অথচ বাস্তবতা ছিলো যে, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতকে চূড়ান্তভাবে দলীয় প্রভাবে কাজ করানো যায় না।
কখনও কখনও মনে হয় যে আদালত সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু যখনই চূড়ান্তভাবে আইনের ব্যাখ্যা ও পারিপার্শ্বিকতা বিশ্লেষণ করা যায় তখন বোঝা যায় যে, আদালতের হাত-পা আইনের হাতে বন্দী। যেমনটি হয়েছে আমাদের সংবিধান ও সামরিক শাসন প্রসঙ্গে। আদালত কি কোনোভাবে সংবিধান স্থগিত করে সামরিক আইন জারী করাকে সমর্থন করতে পারবে? এটি কি কোনো আইনের আওতায় করা সম্ভব? ফলে যখনই সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন উদ্যোগ থাকবে তখনই আদালতকে তার বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে। কর্নেল তাহেরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যেভাবে তাহেরকে বিচারের আওতায় ফাঁসি দেয়া হয়েছে সেটি বিধিবদ্ধ কোনো আইনের আওতায় সিদ্ধ হতে পারে না বলেই আদালত তাহেরের বিচারের বিপক্ষে রায় দিয়েছে। কোনো একটি বেঞ্চ যদি কোনো বিষয়ে কোনো বিতর্কিত রায় প্রদান করেও, চূড়ান্তভাবে সেইসব রায়ের পর্যালোচনা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষতারই জয় হয়েছে। এখন যদি কেউ সামরিক আইনকে বৈধ করতে বলে এবং আইনের বাইরের বিচারকে বৈধ করতে বলে তবে সেটি যে আবার সামরিক ফরমান ছাড়া বৈধ করা যাবে না সেটি বুঝতে হবে।
২০১১ সালে বাংলাদেশের আদালত জিয়াকে খুনী হিসেবে চিহ্নিত করে যে রায় দিয়েছে এবং কর্নেল তাহেরকে একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে যে অভিধা প্রদান করেছে সেটি দেশের মানুষ নীরবে বলতে চাইলেও জিয়া ঘরানার রাজনীতির ডামাডোলে তা কখনও উচ্চকিত হতে পারেনি। এমনকি কিছু বিদেশিও তাদের সত্য ভাষণকে তুলে ধরতে সক্ষম হননি। সত্যের সাথে আপোস করেননি এমন একজন বিদেশি মানুষের নাম লরেন্স লিফটসুজ। ৭৫-এর পর থেকেই তিনি বলে আসছিলেন তার পাওয়া অনুসন্ধানের কথাগুলো। অবশেষে তিনি আদালতের সামনে বলার সুযোগ পেলেন এবং একজন সাহসী সাংবাদিক হিসেবে নিজের বিবেকের তাড়নায় সেই সুযোগটি গ্রহণ করলেন। দেশটি যখন জিয়ার সামরিক স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথরে বন্দী এবং বাংলাদেশের মানুষও জিয়ার শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেনি, তখন যে কজন সাহসী মানুষ তার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি তাদেরই একজন। এটি অবাক হবার নয় যে, জিয়ার ভক্ত ও বেগম জিয়ার দলের লোকেরা এটিও স্মরণে রাখেনি যে, লরেন্স লিফটসুজ আদালতের অনুরোধে ঢাকা এসে কথা বলেছেন। তিনি যখন তার সন্তানের অসুস্থতার জন্য ঢাকা আসতে পারেননি, তখন বিদেশে থেকেই লিখিত বক্তব্য দিয়েছিলেন।
রায় নিয়ে সেই সময় বিবিসিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মন্তব্য করেছেন, আমি কিছু বলতে চাইনা। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, ৭৫ সালে জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর সংকট দূর করে দেশকে রক্ষা করেছেন। ৭৫ সালের পর থেকে এমন কথাই এদেশের মানুষ শুনে আসছে। কিন্তু এই কথাগুলো মানুষ শুনেনি যে, জিয়া যখন সেনানিবাসে বন্দী ছিলো তখন তাকে বন্দিত্ব থেকে উদ্ধার করেছিলেন শহীদ কর্নেল তাহের। সেনাবাহিনীতে থাকা তাহেরের অনুসারীরা জিয়াকে কোলে করে এনে ইতিহাসের রাজা গোপালের মতো বাংলার সিংহাসনে বসিয়েছিলেন এবং কথা ছিলো সেনানিবাস থেকে জিয়া শহীদ মিনারে আসবেন এবং জাসদের সাথে মিলে একটি জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দেবেন। বন্দীত্ব থেকে মুক্তি পাবার এক ঘণ্টা অতিক্রম করার আগেই জিয়া তার সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে যান এবং জাসদের ওপর নির্যাতনের স্টীম রোলার নেমে আসে। জাসদের কি পরিমাণ নেতা কর্মী জিয়ার খড়গের নিচে জীবন বিপর্যস্ত করেছে তার হিসাব আমাদের কাছে আছে, যাদের আপনজন সেই দুঃসহ সময় অতিক্রম করেছেন। আমার ঘরে একজন মহিলা আছেন যিনি এখন পঞ্চাশের কোঠা অতিক্রম করেছেন এবং যিনি জিয়ার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। পচাঁত্তরের পর সেনানিবাসের সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠের কথা স্মরণ করলে এখনও তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাদের হাত থেকে বেঁচে থাকাকে তিনি এখনও এক সৌভাগ্য বলে মনে করেন। শুধু জাসদ করার অপরাধে জিয়ার নির্যাতকগণেরা দিনের পর দিন তাকে চোখ বেঁধে রাখে। অথচ এই মহিলা মাত্র আঠারো বছর বয়সে দেশের মুক্তির জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তখন পাকিস্তান বাহিনীকে তার ততোটা ভয়ংকর মনে হয়নি যতোটা জিয়ার বাহিনীকে তিনি হিংস্র হিসেবে পেয়েছিলেন। তার একটিই অপরাধ ছিলো যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পরে জাসদের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। চোখ বেঁধে সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে অন্ধকার ঘরে দিনের পর দিন ফেলে রেখে, হাত-পা বেঁধে চেয়ারে বসিয়ে লাথি দিয়ে চেয়ার সরিয়ে ফেলে প্রচণ্ড আঘাত করে বা গরম পানিতে চুবিয়ে রেখে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতে যে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিলো তার বিবরণ কেবলমাত্র হিটলারের সাথেই মিলে। কর্নেল তাহেরের অসংখ্য সহযোগী-সমর্থক-কর্মী ও জাসদের নেতৃবৃন্দ এসব অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। আমি চিনি এমন অসংখ্য মানুষ তাদের সেই বিভীষিকার কথা স্মরণেও আনতে চায় না। বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখা থেকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে ডিজিএফআই-এর টর্চার সেলে নির্যাতন করার কতো কাহিনী এদেশের মানুষ জানে? মানুষ এই কথাটি বলেনা যে, ৭৫-এর ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ছিলো কর্নেল তাহেরর অনুগত। সেদিন ইচ্ছা করলেই তিনি বিপ্লবী সেনাবাহিনীর নেতা হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারতেন। সামরিক বাহিনীর জোয়ানরা তাকেই অবিসংবাদিত নেতা মনে করতেন। কিন্তু তাহের মনে করেছিলেন, তার দীর্ঘদিনের বন্ধু জিয়াকেই নেতা বানাবেন-কারণ জিয়া তখন সামরিক বাহিনীর চাকুরীতে নিয়োজিত ছিলেন ও তার কমান্ডটিই বৈধ কমান্ড হতে পারতো। তাহের একটি দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যে বাহিনী দেশের সাধারণ মানুষের পাশে থেকে একটি স্বাধীন দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য দেশবাসীর কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করবে। জিয়া সেই সামরিক বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে তার অনেক দূর থেকে ফেলা জাল দিয়ে ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। এখনতো এটিও স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়ে জিয়া জানতেন এবং তিনি তার মৌন সম্মতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদেরকে উৎসাহিত করেন।
অন্যদিকে মরহুম আইনজীবী জহির সাহেবের মতো মধ্যপন্থী জিয়াভক্তরা মনে করেন যে, জিয়া ও তাহের প্রসঙ্গ ইতিহাসের ওপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। আইনজীবী জহিরের কথায় আমি দ্বিমত পোষণ করিনা। আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাস যাকে যেখানে বসানোর সেখানেই তাকে বসাবে। হয়তো কাছের ইতিহাসে অনেক কিছু বদলে দেয়া যায়। কিন্তু সময় যতো যেতে থাকে ইতিহাস ততো সত্য প্রকাশ করতে থাকে।
সাম্প্রতিককালে আমরা দেখলাম যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুখে এক কথা বলে কাজে অন্যটা করেছে এবং উইকিলিকস নামক একটি ওয়েবসাইট সেইসব সকল সত্য প্রকাশ করে দিয়েছে। আজ যারা মনে করছেন যে, রাস্তায় মিছিল করে বা প্রতিবাদ সভা করে পুরো জাতিকে কোন মিথ্যাকে সত্য হিসেবে গেলানো যাবে তারা হয়তো ভাবেননি যে, ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করেনা। আজ যার বিশাল রাজনৈতিক সমর্থক বাহিনী, কাল যে সেটি থাকবেই সেই নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারেব না। এক সময়ে এই অঞ্চলে মুসলিম লীগের কোন বিকল্প ছিলোনা। আমাদের নিকট অতীতে মাওলানা ভাসানীকে আমরা দেখেছি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে। কিন্তু সেই ভাসানীর রাজনৈতিক দলটিকে এখন আর খোঁজেই পাওয়া যায় না। জিয়ার যে দল সেটিও যে আগামীতে এমন অবস্থাতেই থাকবে, সেটি কে বলতে পারে। আমরা এটি জানি যে, মরহুম জিয়াউর রহমান অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দেশের আওয়ামী লীগবিরোধী সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি বেশ শক্তিশালী প্লাটফরম দাড় করিয়েছিলেন। তার পক্ষে ক্ষমতায় থাকা মোটেই সহজ হতোনা যদি তিনি এই রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করতে না পারতেন। কিন্তু আমরা এটিও জানি যে পচাঁত্তরের জনগোষ্ঠী আর ২০১৫ সালের জনগোষ্ঠী কিংবা ২০২১ সালের জনগোষ্ঠী এক নয়-এক হবে না। এখন থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগের বাংলাদেশ যেমন এখন নেই তেমনি নেই এমন সময় যখন তথ্য লুকিয়ে রাখা যায়।
তবে ১১ সালের ২২ মার্চের রায়ে পয়ত্রিশ বছর যাবত আইনের শাসনের দুয়ারে মাথা কুটে মরা বেগম লুৎফা তাহের ও তার সন্তানসহ তাহেরের ভাইবোনেরা একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারলেন। জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু বেশ জোরের সাথেই সেদিন বলতে পারলেন যে, জাসদ একটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এবং জাসদকে নিয়ে এতোদিন যেসব বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে সেইসব সঠিক নয়। তারা নিজেরা সামরিক আদালতে যেসব শাস্তি পেয়েছিলেন সেইসব থেকে মুক্তি পাবার ফলে নিজেরাও কলঙ্কমুক্ত হলেন এবং তাদের নতুন প্রজন্ম এখন বুক ফুলিয়ে বলতে পারছে যে, ইতিহাস সত্যকে সামনে তুলে এনেছে। তাহেরের কলঙ্কমুক্ত হবার পর যখন আমি তাকে স্মরণ করছি তখনও তার সকল স্মৃতি ধূসর। একজন জাতীয় বীরকে যে সম্মান দেবার কথা আমরা কি সেটি তাকে এবারও দিতে পারলাম? আমি খুব সবিনয়ে এই কথাটি বলতে চাই যে, বর্তমান সরকারের শরিক দল হয়ে জাসদও তাকে সেই মর্যাদাটুকু দিতে পারেনি যেটি তার ন্যূনতম প্রাপ্য ছিলো। সরকার নিজে কর্নেল তাহের বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অথচ যদি রাজনীতির বিচারেও পুরো বিষয়টি দেখা হয় তবে আওয়ামী লীগের উচিত ছিলো তাহেরের বীরত্ব ও জিয়ার খলনায়কের পার্টটি জাতির সামনে তুলে ধরা। এর ফলে তাহের কতোটা জীবিত হতেন তার চাইতে বড় বিষয় হলো আওয়ামী লীগের রাজনীতি অনেক বেশি লাভবান হতো।
আজকের লেখাটি শেষ করার আগে শহীদ তাহেরের জন্য খোলা ওয়েবসাইটের হোমপেজটির কয়েকটি বাক্য তুলে না ধরে পারলাম না। তার ওয়েবসাইটের হোমপেজের লেখাটি এমন “নিকারাগুয়ায় যারা জেনারেল অগাস্টো সানডিনোর আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন তারাই ১৯৩৪ সালে তার মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দী পর আবারো ওঠে দাঁড়ান। তাহেরের মতো সানডিনোও বিশ্বাসভঙ্গের শিকার হয়েছিলেন, তাকেও হত্যা করা হয়েছিলো। ... হয়তো তাহেরের দৃষ্টান্ত এমনি বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টান্ত আনবে। চারপাশে নির্যাতিত মানুষের ভিড় দেখে যারা আত্ম জিজ্ঞাসার ব্রতী হবেন, জানতে চাইবেন তাদের মধ্যে কেউ কোনোদিন পৃথিবী বদলে দিতে উঠে দাঁড়িয়েছিলো কিনা, তাদের জন্য নতুন অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করবে হয়তোবা।
আমি জানি না, তাহেরের ফিরে আসাকে মাথায় রেখেই কথাগুলো লেখা হয়েছিলো কিনা। বেঁচে থাকুন কর্নেল তাহের। যে জাতির অনেক বেশি বীর নেই সেই জাতির জন্য তিনি এক মহাবীর।
৩০ জুলাই ১৫
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক।
[email protected], www.bijoyekushe.net
এইচআর/আরআইপি