বাসের জন্য লাইন ভাঙা বৈধ!
মানব জীবনের সবচে’ বড় সত্য হচ্ছে মানুষ লাইন শুরু করে সবার শেষজন হয়ে এবং লাইন শেষ করে সবার প্রথমজন হয়ে। আমি এখন বাসের লাইনের মাঝামাঝি অবস্থান করছি। গত এক ঘণ্টা যাবত কোনো বাস নেই।
আমরা ছোটবেলা থেকেই লাইন মেনে চলতে পারি না। তাই আমাদেরকে বাংলা খাতা নামক বিশেষ এক ধরনের লাইন টানা খাতায় লিখতে হয়েছে। শুধু লাইন শেখার জন্য। অথচ আমরা নিয়মিত লাইন মেরেছি ঠিকই তবে লাইন ধরতে শিখিনি। সেজন্যই গায়ক তার জীবনমুখী গানে গেয়েছেন `আমার লাইন হয়ে যায়, আঁকাবাঁকা..’- এই যে মাত্র আসা বাসটির উদ্দেশ্যে লাইন ভেঙে যে যেভাবে পারলো আঁকাবাঁকা হয়ে ছুটে গেলো। গায়ে গতরে যারা শক্তিশালী তারা উঠে গেলো। আমরা যারা দুর্বল তারা বাস না পেয়ে হতাশ হয়ে আবার লাইন ধরে দাঁড়ালাম। সেখানে আবার নতুন ঝামেলা। সামনের ভদ্রলোক দাবি করছেন তিনি আমার আগেই ছিলেন। কিন্তু তার সামনের জনের শক্ত দাবি – এই লোক পেছন থেকে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে। তর্ক যখন তুঙে তখন আরেকটা বাস এসে হাজির। আবার পড়িমরি করে সবাই একসাথে দৌড় দিলো। আবার শক্তিশালীদের জয়। আমরা দুর্বলরা আবার লাইন ধরে দাঁড়ালাম পরের বাস এলে সবার আগে দৌড় দিয়ে উঠে যাবার জন্য।
কথা হচ্ছে যদি সবাই পড়িমরি করে দৌড়ই দিবে তাহলে লাইন কেন? কারণ একটাই আমার আগেরজন লাইনে দাঁড়িয়েছে। আমিও। আমার দেখাদেখি আমার পরের জনও লাইনে দাঁড়িয়েছে। তাহলে লাইন ভেঙে কেন দৌড় দিচ্ছে? এটার উত্তরও সহজ। আমার আগের জন্য লাইন ভেঙে দৌড় দিয়েছে তাই আমিও। আমার দেখাদেখি আমার পেছনের জনও।
আমরা হলাম দেখাদেখি জাতি। আমরা প্রত্যেকেই ওভারব্রিজ ব্যবহার করি না কারণ হিসাবে যুক্তি দিই একা ওভারব্রিজ ব্যবহার করে কী হবে? দেশ লাইনে চলে আসবে? আমার সামনের ভদ্রলোক পরিবর্তন হয়েছে। যিনি আগে ছিলেন তিনি সফলভাবে ধাক্কা মেরে বাসে উঠার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বর্তমান ভদ্রলোক ভীষণ রাগী এবং প্রতিবাদী। যারা লাইন ভেঙেছে তাদের কমনসেন্সের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলছেন ‘দেখছেন ভাইসাহেব। আরে ব্যাটা তাড়া তো আমাগোও আছে। সবকিছুর তো একটা সিস্টেম আছে। নাকি বলেন’?
-জি অবশ্যই সিস্টেম আছে
-সিস্টেমের বাইরে আমরা যাইতে পারি?
-হাঁ স্যরি, না কোনোভাবেই পারি না।
-বলেন তো এই যে লোকগুলা লাইন ভেঙে চলে গেলো তারা কি উচিত কাজ করলো? নিয়ম ভাঙলো না তারা? বাসের লাইন ভাঙার জন্য জেল জরিমানা হওয়া দরকার। এই জাতি জরিমানাকেই শুধু ভয় পায়।
-না ভাই এই জাতি মাইরকে ভয় পায়। রিমান্ডে নিয়ে দুইটা দিলেই সোজা হয়ে যাবে।
ভদ্রলোক আমার কথায় খুব খুশি হলেন। দেশ, সমাজ, আন্তজার্তিক বিশ্ব, মোদির ঢাকা সফর, বাসের লাইন ইত্যাদি বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান উনি আমার সামনেই চর্চা করলেন। আমি আগেও দেখেছি বিষয়টা। আমাকে পেলে সবাই নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। আমাকে দেখলেই বোধহয় মনে হয় এই লোক বেকুব, জ্ঞানের থলে ফুটা। এর কাছে যা বলা হবে সেটাকেই সে জ্ঞান ভাববে। দূর থেকে দেখলাম বাস আসছে। যেহেতু আমার সামনের লোকটা ভদ্রলোক, সেহেতু সে দৌড় দিবে না। লাইন মেনেই বাসে উঠবে। তাই আমি দৌড় দেবার কোনো রকম প্রস্তুতি নিলাম না।
বাস কাছাকাছি আসতেই লোকটা দিলো ভো দৌড়। প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও আমিও দৌড় দিলাম। বাঁচি মরি বাস ধরতেই হবে। আর লোকটার এমন আচরণে আমি কিছুই মনে করলাম না। কারণ প্রেম, যুদ্ধ এবং বাস ধরার ব্যাপারে সব জায়েজ!
এইচআর/পিআর