ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

হল নয়, শিক্ষার্থীদের হৃদয় দখল করুন

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ১৬ এপ্রিল ২০১৮

বাংলাদেশে এখন আক্রমণের সবচেয়ে সহজ লক্ষ্য ছাত্রলীগ। আমরা সবাই যেন অপেক্ষা করি, কখন ছাত্রলীগ কোনো একটা অপকর্ম করবে, আমরা সবাই মিলে তাদের গালি দেবো। ছাত্রলীগকে গালি দেয়ার মধ্যে দারুণ একটা উল্লাস দেখা যায়। শুধু প্রতিপক্ষ নয়, আওয়ামী লীগ নেতারাও মনের সুখ মিটিয়ে ছাত্রলীগকে গালি দেন।

গালি দেয়ার সময় আমরা এত নিষ্ঠুর হয়ে যাই, ভুলে যাই ছাত্রলীগের গৌরবময় অতীত। তবে এর দায় অনেকটাই ছাত্রলীগের। কারণ গালিগুলো যে মিথ্যা, তা নয়। গত ৯ বছরে হেন অপকর্ম নেই, যা ছাত্রলীগ করেনি। ‘ছাত্রলীগ’ লিখে গুগলে সার্চ দিলে যা আসে, তার কোনোটাই ভালো কিছু নয়। বিশ্বজিত হত্যা বা সিলেটের বদরুলের নৃশংসতার কথা তো সবারই জানা। হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির লাঠিয়াল- অপকর্মের ফিরিস্তি বহুত লম্বা।

একটা অপরাধ বাকি ছিল, পায়ের রগ কাটা। শিবিরের ট্রেডমার্ক এই অপবাদটা ছাত্রলীগের কাঁধে চাপাতে পারলে ষোলকলা পূর্ণ হয়। গত সোমবার রাতে তাও হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশা নাকি এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছেন। মূহুর্তেই ভাইরাল হয়ে গেল সচিত্র অভিযোগ। শুরু হলো বিক্ষোভ। হলের বাইরেও ছাত্রদের বিক্ষোভ।

ভেতরে-বাইরে বিক্ষোভের মুখে তাৎক্ষণিকভাবে মধ্যরাতেই এশাকে হল থেকে, ছাত্রলীগ থেকে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বহিষ্কার করা হলো। অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে; ছাত্রলীগ হোক আর যেই হোক। কিন্তু রগ কেটে দেয়ার শাস্তি তো নিছক বহিষ্কার হতে পারে না। কারো গায়ে হাত দেয়া ফৌজদারি অপরাধ। আর পায়ের রগ কেটে দেয়া তো আরো বড় অপরাধ। কেউ এ অপরাধ করলে নিছক বহিষ্কারে শেষ হবে না, তার শাস্তি। আর এশার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই।

এশা সুফিয়া কামাল হলে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। ছাত্রীদের মারধোর করে, তাদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করায়; এসবও নাকি সত্যি। কিন্তু আসল অভিযোগের খবর কি? ছাত্রলীগ নেত্রী কি রগ কেটেছেন? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পুরোটাই চিলের পেছনে দৌড়ানো। আক্রান্ত মোর্শেদা বেগম একই হলের ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। রাগের মাথায় কাচে লাথি দিয়ে তার পা কেটেছে। কেউ তার রগ কাটেনি। কিন্তু যাচাই না করেই ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ছবির দায় নিয়ে এশাকে বহিষ্কার হতে হলো। এখানেই থামেনি তার শাস্তি। এশাকে জুতার মালা পরিয়ে তার ভিডিও তুলে ছড়িয়ে দেয়া হলো ফেসবুকে। ছিঁড়ে ফেলা হলো তার পরণের পোশাকও।

জুতার মালা গলায় পরানো, চুল কেটে মাথায় আলকাতরা লগিয়ে দেয়া, দোররা মারা- এসবই গ্রামীণ ফতোয়াবাজদের প্রিয় শাস্তি। এইসব ফতোয়াবাজদের মূল টার্গেট নারীরা। গ্রামে হোক, শহরে হোক; নারীদের এভাবে হেনস্থা করা অন্যায়। কিন্তু দেশের সবচেয়ে সচেতন ও প্রগতিশীল অংশের বিচরণক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও যখন একজন নারীকে জুতার মালা পরিয়ে, বস্ত্রহরণ করে তার ভিডিও তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়াটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু এই অন্যায়ের পরও যখন অনেককে এর পক্ষে অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাইতে শুনি; তখন বুঝি, অন্তরের সব অন্ধকার এখনও সরাতে পারিনি আমরা।

এশাকে জুতার মালার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে অনেকে বলছেন, লাঞ্ছনাটা তার মত সন্ত্রাসীর প্রাপ্য। তার ইস্যুটা নারীবাদের নয়, মানবতার নয়, মানবাধিকারের নয়। তখন মনে হয়, সন্ত্রাসীর কোনো মানবাধিকার থাকতে নেই, এমন অপযুক্তি দিয়ে আমরা অনেকে যেমন ক্রসফায়ারকেও বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করি; এটাও তেমনি। আমরা ভুলে যাই, নারী অধিকার বা মানবাধিকারে কোনো ইস্যু নেই, ব্যক্তি নেই, স্থান নেই, কাল নেই, পাত্র নেই।

নির্যাতিতা ছাত্রলীগ করেন বলে, আপনারা মুখ ঘুরিয়ে রাখবেন। তার মানে আপনাদের মানবাধিকারের ধারণা, নারী অধিকারের ধারণা ঠিক পরিষ্কার নয়। এশা নির্দোষ এমন দাবি আমি করছি না। এশার অপরাধগুলো নিয়ে আলোচনা করছি। কিন্তু যত অপরাধই করুক। একজন নারীর গলায় যখন জুতার মালা পরানো হয়, ভয়ে সেই নারী যখন চিৎকার করে, ‘আমার জামা, আমার জামা’; তখনও যখন কেউ কেউ একে প্রকৃতির বিচার বলে উল্লসিত হন, বুঝতে অসুবিধা হয়; মানবতা নয়, আপনাদের হৃদয়জুড়ে ঘৃণা। সেই ঘৃণা শুধু ছাত্রলীগের জন্য নয়, একজন নারীর জন্যও।

মনে হচ্ছে ছাত্রলীগ হলেই, তার আর কোনো অধিকার থাকে না। সব দোষ ছাত্রলীগের ঘাড়ে চাপাতে পারলেই বুঝি সব মাফ। অপরাধ যাই হোক, একজন নারীকে জুতার মালা গলায় দিয়ে ঘোরানো, ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়া অন্যায়, অমানবিক। দেশের যে কোনো প্রান্তেই হোক, যার সাথেই হোক; এটা অন্যায়। অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রুচির সাথে নারীর এই অবমাননা বড্ড বেমানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগেও বইমেলায়, বর্ষবরণে, থার্টি ফার্স্টে নারী অবমাননা হয়েছে। কদিন আগে উপাচার্যের অফিসে ছাত্রলীগের এক নেত্রী আরেক নারীর বস্ত্রহরণ করেছেন। আসলে বিবেচনাটা ছাত্রলীগ নয়, হওয়া উচিত ন্যায়-অন্যায়। যেটা অন্যায়, সেটা সবসময়ই অন্যায়। ছাত্রলীগ নেত্রীর গলায় জুতার মালা দিয়েছে বলে চুপ করে থাকা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়ারই নামান্তর। একটা অন্যায় দিয়ে কখনোই আরেকটা অন্যায়কে জাস্টিফাই করা যায় না।

ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা এশার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা বাসায় গিয়ে এশাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছে। একদিনেই জুতার মালা বদলে গেলে ফুলের মালায়! মাত্র ২৪ ঘণ্টায় লোক দেখানো তদন্ত শেষে এশাকে নির্দোষ ঘোষণা করে বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়া হলোা। ছাত্রলীগের এই দ্রুত বহিষ্কার এবং তারচেয়েও দ্রুতগতিতে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দেখেই বোঝা যোয়, পরিস্থিতি অনুধাবণ করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।

জুতার মালা গলায় দিয়েছে বলেই তো আর ইশরাত জাহান এশার আগের অন্যায়গুলো মুছে যায়নি। রগ কাটার বিষয়টি না হয় গুজব। কিন্তু এশা সুফিয়া কামাল হলে একচ্ছত্র ত্রাসের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল, এটা তো মিথ্যা নয়। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে যাওয়ার অপরাধে মেয়েদের ডেকে এনে শাসানো, চর-থাপ্পর মারার অভিযোগও মিথ্যা নয়। জুতার মালা পরানোটা খুবই নিন্দনীয়, কিন্তু সেটা যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, সেটাও ছাত্রলীগ নেতৃত্বের উপলব্ধি করা উচিত।

শুধু সুফিয়া কামাল হল নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ হলেই ছাত্রলীগ এই একক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকেই ছাত্র রাজনীতির অবক্ষয়ের শুরু। যখন যে দল ক্ষমতায়, ক্যাম্পাসে থাকে তাদের একক আধিপত্য। ডাকসু নির্বাচন নেই ২৮ বছর। যতদিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে। আর টানা ৯ বছর মূল দল ক্ষমতায় থাকায় ছাত্রলীগ এখন দানবে পরিণত হয়েছে।

দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন তাদের তালুক। হলগুলো যেন একেকটা টর্চার রসেল। গেস্টরুমে নির্যাতন নিয়মিত ঘটনা। আদর্শিক মিল থাকুক আর নাই থাকুক, দলের মিছিলে যেতে হয় বাধ্যতামূলক। শীতের মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হওয়ায় নিউমোনিয়া কেড়ে নিয়েছে এক ছাত্রের প্রাণ। আরেক ছাত্রের চোখ গেছে নির্যাতনে। এখন আর ক্যাম্পাসে সিনিয়র-জুনিয়রের বালাই নেই। ছাত্রলীগের জুনিয়ররাও সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি করে।

গ্রাম থেকে আসা অনেকের ঢাকায় থাকার আর কোনো জায়গা নেই। তাই তারা মুখ বুজে বছরের পর বছর সয়ে যায় ছাত্রলীগের নির্যাতন। আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ অভিযোগ করার সাহস পায় না বলে, মূলধারার মিডিয়ায় খুব একটা আসে না, এই নির্যাতনের খবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের দেয়ালে দেয়ালে মিশে যায় কত নিরীহ ছাত্রের কান্না, ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের নেতারা কি তার হদিস জানেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো হল এবং গোটা ক্যাম্পাস এখন ছাত্রলীগের দখলে। কিন্তু একটা সত্যিকারের গোপন ব্যালটের নির্বাচিন হলে ছাত্রলীগ গো হারা হারবে। আমার ধারণা ছাত্রলীগের নেতারাও এটা জানেন, কিন্তু মানেন না। তারা ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে। ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই।

দিনের পর দিন ছাত্রলীগের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাই কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সুযোগে মাঠে নেমে প্রতিবাদ করেছে। রগ কাটার গুজবের কারণে এশা বেকায়দায় পড়েছেন, কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাওয়ার অপরাধে সাধারণ ছাত্রদের শাসানোর ঘটনা অধিকাংশ হলেই ঘটেছে। জুতার মালা পরানো যেমন অন্যায়, তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের হায়ে হাত তোলাও অন্যায়। একটা অন্যায় কখনো আরেকটা অন্যায়কে জায়েজ করে না। মাত্র ২৪ ঘণ্টার লোক দেখানো তদন্তে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ছাত্রলীগ বুঝিয়ে দিল এশার অন্যায়টা তারা অনুধাবণ করতে পারেনি, তাদের আত্মোপলব্ধি হয়নি বা হলেও তা আমলে নেননি।মূল দল ক্ষমতায় থাকলে হল দখল বা ক্যাম্পাস দখল ডালভাত, যে কেউ পারবে। চেষ্টা করুন, শিক্ষার্থীদের হৃদয় জয় করতে। কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তেমন হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই আপনার গলায় ফুলের মালা দেবে।

১৪ এপ্রিল, ২০১৮

jagonews24

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন