ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পেডোফিলিদের কাছে পুত্রশিশুও সমানভাবে বিপদজনক

প্রকাশিত: ০৬:৪৯ এএম, ২৮ জুলাই ২০১৫

আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী ভাবীর ফুটফুটে দু’টি কিশোরী মেয়ে। বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে সারাক্ষণ তার অজানা ভয় আর টেনশন। কখনো কখনো তাকে দেখলে মনে হয়, মেয়েদের বেড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে কোনো এক অজানা উৎকণ্ঠায় যেন রাতে তার ঠিকভাবে ঘুম হচ্ছে না। ভাবীর তীক্ষ্ণ কৌতূহলী দৃষ্টি কি যেন খুঁজে বেড়ায় চারদিকে। স্কুল, কোচিং, আরবি শিক্ষা, এমনকি নিজ বাড়িতে লিফটে ওঠা নামার সময়েও কি যেন অনুসরণ করতে থাকেন, আর একা একা আনমনে ক্ষোভ আর বিদ্বেষ প্রকাশ করতে থাকেন। বাচ্চাদের নিয়ে তার এই অতিরিক্ত টেনশনের জন্য একদিন মৃদু তিরস্কার করলে তিনি বেশ উত্তেজিত এবং আবেগতারিত হয়ে বলতে থাকেন ‘আপনি কিভাবে বুঝবেন? আপনারতো ছেলে’।

যাহোক, মেয়েদের নিয়ে তার এই আচরণ আমার কাছে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি আর পাগলামো মনে হলেও, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সিলেটের হতদরিদ্র পরিবারের শিশুপুত্র রাজন হত্যাকাণ্ডের পর শুধুই মনে হচ্ছে প্রতিবেশী ভাবীর পাগলামো আচরণই সঠিক ছিল। হয়তো শৈশবের কোনো পীড়াদায়ক স্মৃতি বহুকাল ধরে বহন করেছেন তিনি, লোকলজ্জার ভয়ে প্রকাশ করেননি। আবার এমনও হতে পারে যে, সমাজের কুৎসিত আর নির্মম বাস্তব চিত্রগুলো হয়তো তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ এবং উপলব্ধি করেছেন, যা তার মনের খুব গহীনে ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে। প্রতিবেশী ভাবীর মতো অনেকেই হয়তো আমরা এমন ধারণা করে বসে আছি যে শুধু কন্যাশিশুরাই পেডোফিলিদের (শিশুদের প্রতি যৌন আসক্ত ব্যক্তি) সম্ভাব্য নির্যাতনের শিকার হয়। তাই যদি হবে , তাহলে শিশু রাজনের করুণ হত্যাকাণ্ড আমাদের কি শিখিয়ে গেলো? টেলিভিশনে আমরা তার পিতামাতার কথা শুনেছি। যা শুনে হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। হত্যাকারীরা তাকে যেভাবে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করছিলো, ঠিক একই রকমভাবে বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষেরা কি মানসিকভাবে নির্যাতিত হননি? কি পুত্র আর কি কন্যা, পেডোফিলিদের কাছে সকল শিশুদের জীবনই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

রাজন চলে গেছে ঠিকই কিন্তু তার এই অকালপ্রয়াণ থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও অনেক রাজনদের জীবন যদি বাঁচানো না যায়, তবে কি লাভ হবে আইনের দণ্ড, লেখালিখি আর মানব বন্ধন দিয়ে? বালকামী ধর্ষকদের বিকৃত অসুস্থতার কারণে শিশুদের জীবন যদি এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তবে এখন সময় হয়েছে এ বিষয়ে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করার এবং বিকৃতি নিরাময় করার।

মনোচিকিৎসকদের মতে, পেডোফিলিয়া একধরনের যৌনবিকৃতি, যাতে আক্রান্ত একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা মহিলা তার কামনা চরিতার্থের জন্য শিশু বা অপরিণত বালক বা বালিকাকে তার সঙ্গী হিসেবে পছন্দ করে এবং আকর্ষণ বোধ করে। জীবন উপভোগের জন্য কোমলমতি শিশুদের প্রতিই তারা বেশি আগ্রহী। ব্যক্তিত্বের অপরিপক্বতা, হীনমন্যতা বোধ, অবিবাহিত অবস্থা, বিপত্নীক, দাম্পত্য জীবনে অসন্তুষ্টি, শীতলতা, এমন পুরুষ বা মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতার প্রকাশ বেশি লক্ষ্য করা যায়। পেডোফিলিরা অনেক সময়েই বিপদজনক হয়ে ওঠে, শিশুটিকে পাওয়ার জন্য তার উপরে বল প্রয়োগ করা হয়। হতভাগ্য দরিদ্র পরিবারের সবজি বিক্রেতার সন্তান শিশু রাজন যদি উচ্চবিত্ত শিক্ষিত একটি পরিবারের সন্তান হতো তাহলে হয়তো এমন একটি নির্মম ঘটনা নাও ঘটতে পারতো। যদি অন্যান্য উন্নত দেশের মতো মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ভার সরকারের হতো, তাহলে রাজন লেখাপড়া করতে স্কুলে যেত, অথবা যৌন শিক্ষা বিষয় পাঠ্য বইয়ে সংযোজিত হতো, তাহলেও হয়তো রেহাই পেতে পারতো শিশু রাজন। তবে কি শুধু হত্যাকারীদের শাস্তি বিধান করেই মৃত্যুর যবনিকাপাত হবে? বিশ্বজিৎ ও ত্বকীর মতোই মনের ক্ষত হিসেবে স্মৃতিতেই জমিয়ে রেখে দেবো? রাজনের খুনিদের যদি ফাঁসিও হয়, তাহলেই কি পাল্টে যাবে মানুষের বিবেক, স্বভাব আর প্রবৃত্তি? তাহলে কিভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি আমরা এই পেডোফিলিয়াগ্রস্থ বিপদজনক মানুষগুলো থেকে?

আমাদের সংস্কৃতি সংস্কার ও প্রথায় পিতৃতন্ত্রের আধিপত্যের কারণে খুব গোপনে আর সতর্কতার সাথে সবাই এই অপরাধগুলো চেপে যায়। তবে অতি সম্প্রতি সেলিব্রেটিদের এই বিষয়ে মানসিকতা পরিবর্তনের বিষয়টি খুবই প্রশংসনীয়। তারা নির্দ্বিধায় শৈশবের নিপীড়নের ঘটনাগুলো মিডিয়ার কাছে প্রকাশ করছে যা থেকে আস্তে আস্তে থলের বেড়াল বের হতে শুরু করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে আমাদের সকলের হাতেই এখন মোবাইল ফোন পৌঁছে গেছে, মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করার ফলেই রাজন হত্যার আঠাশ মিনিটের লোমহর্ষক উল্লাস আমাদের দারে দ্বারে পৌঁছে গেলো! আহা! শিক্ষা সভ্যতা আর পশু প্রবৃত্তির কারণে রাজনের হত্যাকারীরা হয়তোবা উপলব্ধিই করে উঠতে পারেনি যে তারা কি নিষ্ঠুর, নির্মম আর জঘন্যতম উল্লাসেই না রাজনকে হত্যা করলো! তার বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাদ আমাদের হৃদয়কে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়ে গেলো। মানবতাকে ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লো ১৩ বছরের দরিদ্র একটি শিশু। অবুঝ শিশু জানে না যে বিষয়টি কি, যে জন্য তাকে প্রাণ হারাতে হল! ঐ ঘটনাটির পর থেকে আমার মনের খুব কাছে এসে প্রতিদিনই হাজির হয় রাজন, যে আমার কাছে আকুতি জানায় ‘মা, আমাকে তোমরা বাঁচাও।’

প্রশ্ন এসে যায়, এধরনের ঘটনা আসলেই কি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা, নাকি শিশু হয়রানি আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত? একটু সচেতনতা নিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখুন, এরা আমাদেরই আশে-পাশের খুব কাছের মানুষ, প্রতিবেশী, অথবা আত্মীয়। ছোটবেলা আমাদের এক প্রতিবেশী বড় ভাই, বয়স আনুমানিক পঁচিশ থেকে ছাব্বিশ হবে। তিনি এক বিকেলে আমাদের অন্য এক প্রতিবেশীর একবছরের শিশুপুত্রকে আদর করে বেড়াতে নিয়ে যায়। প্রায় একঘণ্টা পরে আবার শিশুটিকে পিতামাতার কাছে ফেরত দিয়ে যায়। কিন্তু বাসায় দিয়ে যাবার পর শিশুটির মুখ থেকে অনবরত লালা ঝড়তে থাকে এবং বেশ কয়েকবার বমি করে বাচ্চাটি ভীষণ অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। বাবা মা শিশুটিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানালেন যে শিশুপুত্রটির মুখগহ্বরে কোনো ব্যক্তির দ্বারা নির্যাতিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, গ্রামের বাড়িতে এ ধরনের ঘটনা তিনি আগেও ঘটিয়েছেন। তিনি আমাদের প্রতিবেশী বড় ভাই ছিলেন, এখনো বেঁচে আছেন। তবে পরিবর্তিত হয়েছে তার অবয়ব আর পোশাক।

২০০৬ সালে এক মহিলা ডাক্তারের চেম্বারে দীর্ঘ লাইনে তীর্থের কাকের মতো বসে আছি কল পাবার আশায়। হঠাৎ দেখি আমাকে কল দেবার ঠিক আগে খুব অল্প বয়সী এক কিশোরীকে তার বাবা মা ধরে ধরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। ডাক্তার ভদ্রমহিলা তার বাবা মাকে অনবরত ধমকাচ্ছেন আর বলছেন ‘আপনারা কেমন বাবা মা, যে এতোটুকু একটি বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মেয়েটির জীবন নষ্ট করে দিলেন’? নার্সের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, তাদের গ্রামে পাড়ার বিবাহিত একজন বয়স্ক লোক পিতামাতাকে ভয় দেখিয়ে এগারো বছরের মেয়েটিকে বিয়ে করেছে। নির্যাতনের ফলে মেয়েটির অঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে হয়ে গেছে। জরুরি প্রয়োজনে অপারেশন করতে হবে। সেদিন মেয়েটির চিৎকার আমাদের হৃদয়কে খুব গভীরভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। আনুমানিক তিন সপ্তাহ আগে রাজশাহীতে আদিবাসী সাঁওতালের তিন বছর বয়সী এক কন্যা শিশু আপন ফুপার দ্বারা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়। যার ফলে শিশুটির একটি স্পর্শকাতর অঙ্গ চিরতরে অকার্যকর হয়ে গেছে। যার দরুন এখন তার পেট ফুটো করে পায়ুপথের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে শিশুটি চিকিৎসাধীন আছে (ঘটনাটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত)। গত সপ্তাহে ইংল্যান্ডের ওয়েলসের অধিবাসী ল্যান ওয়াটকিন্স নামে পঁয়ত্রিশ বছরের একজন পপস্টারের বিরুদ্ধে মোট তেরোটি শিশুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে তারই বান্ধবী জোয়ানি মেঞ্জেলিস। এগুলোর মধ্যে শিশু ধর্ষণের প্রচেষ্টা এবং শিশু পর্ণগ্রাফির অভিযোগও রয়েছে ।

এ ছাড়াও মাত্র এগারো মাসের এক পুত্র শিশুকে নির্যাতনের অভিযোগও তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। গত ২০ জুলাই লাইফনিউজ ডটকম এ প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে লুইসিয়ানা প্রদেশের স্পায়সি নামের ৪১ বছর বয়সী এক নারী শৈশবে তার সৎপিতা দ্বারা দীর্ঘদিন নির্যাতিত হয়েছিলেন। তিনি অতি সম্প্রতি তা গণমাধ্যমকে জানান এবং অনেক দেরিতে হলেও সম্প্রতি তিনি মুখ খুলে সমাজের শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন বলে মনে করছেন। আর এতদিন পর তা প্রকাশ করার আরও একটি কারণ হচ্ছে যে তখন তা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো পথ তার আর খোলা ছিল না। আর এ ধরনের আচরণ হত্যাকাণ্ডের চাইতেও জঘন্য হিসেবে মনে করেন তিনি। আর তাই, তিনি তা শেষ পর্যন্ত আর গোপন রাখতেও পারেননি। আর এই কাজে তার পিতাকে সহায়তা করেছে তারই গর্ভধারিণী মা। তিনি আরও জানান যে সে প্রথম নির্যাতনের শিকার হন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র চার বছর।

( চলবে...)

এইচআর/পিআর