রবীন্দ্রনাথ পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খেয়েছিলেন?
রবীন্দ্রনাথ পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খেয়েছিলেন কিনা জানা নেই নজর আলীর। বৈশাখের অতি চমৎকার আগমনী গীত রচয়িতা কবিগুরু বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন পান্তা-ইলিশের ধারেকাছেও যাননি, এরকম লিখিত কোনো ডকুমেন্ট জোগাড় করতে পারলে বেশ হতো। জৈতুন বেগমের দরবারে সেটি পেশ করে বলা যেত-
: এই দেখ, বৈশাখ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আবেগ লেখালেখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি ইলিশ মাছ দিয়া পান্তা খাওয়ার জন্য তোমাদের মতো বেহুশ হয়ে যাননি। কিন্তু এখন আর সময় নেই। ভাবনাটা কয়েকদিন আগে মনে উদয় হলে কাজে লাগত। কাল বাদে পরশু পহেলা বৈশাখ। নজর আলী এখন ইলিশ কেনার জন্য বাজারে দৌঁড়াবে, না রবীন্দ্রনাথের খাদ্যতালিকা জোগাড়ের চেষ্টা করবে?
ইলিশ নিয়ে ভাবতে গিয়ে কয়েকদিন আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল নজর আলীর। ব্যক্তিগত কাজে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে বড়সাব, মেজোসাব, সেজোসাব ও ছোটসাবরা মিলে দোকান সাজিয়ে বসেছেন। নজর আলী এক ছোটসাবের কৃপা লাভের আশায় অপেক্ষা করছিলেন। দেখলেন, তার দিকে ছোটসাবের মনোযোগ কম। তিনি পিয়নের সঙ্গে গবসবে ব্যস্ত। গবসবের এক পর্যায়ে ছোটসাব পিয়নকে জিজ্ঞেস করলেন-
: সুরুজ্জামাল, বৈশাখ তো আইসা পড়ছে। বৌমার জন্য ইলিশ মাছ কিনছস?
: আবার জিগায়!
: কী বললি?
: কিনছি স্যার।
: কয়টা?
: দুইটা।
: কত নিছে?
: আঠারশ’।
সুরুজ্জামাল আকারে-আয়তনে ছোটখাটো ধরনের মানুষ। আকার-আয়তন যাই হোক, যে লোক সিডিউল টাইমের সাতদিন আগেই আঠারশ’ টাকা দিয়ে এক জোড়া ইলিশ কিনে ফ্রিজে ঢুকিয়ে ফেলতে পারে, তাকে গজ-ফিতায় মাপলে চলবে না।
আড়চোখে সুরুজ্জামালের দিকে তাকিয়ে নজর আলী ভাবতে লাগলেন, পিয়নের চাকরি করে সুরুজ্জামাল যদি এক জোড়া ইলিশ মাছ কিনে ফেলতে পারে, তাহলে এই অফিসের ছোট-বড়সাবরা কয় জোড়া ইলিশ কিনেছেন? কৌত‚হল দমন করতে না পেরে এক ফাঁকে নজর আলী ছোটসাবকে জিজ্ঞেস করলেন-
: স্যার, আপনে ইলিশ মাছ কিনেন নাই?
: কিনছি।
: কয় হালি?
হঠাৎ সহকর্মী শরাফতউল্লাহর ডাকে স্মৃতির জাল ছিন্ন হল। নজর আলীর পিঠে থাপ্পড় মেরে তিনি বললেন-
: চলেন, আমিও আপনার সঙ্গে যাব।
অবাক হয়ে নজর আলী বললেন-
: কোথায়!
: বাজারে।
নজর আলী মনে মনে বললেন, খাইছে আমারে! দুপুরে একসঙ্গে খাওয়ার সময় কথায় কথায় বাজারে গিয়ে ইলিশ কেনার কথা বলেছিলেন তিনি। শরাফতউল্লাহ সহগামী হবেন জানলে নজর আলী ভুলেও এ কথা উচ্চারণ করতেন না। সঙ্গী-সাথী নিয়ে বাজারে যাওয়ার উপায় নেই নজর আলীর।
তার মতো মানুষ বাজারে যাবে একা, যাতে দোকানদারদের কাছে পদে পদে অপমানিত হওয়ার কোনো সাক্ষী না থাকে। ঢোল-ঢাক্কর বাজিয়ে বাজারে যাবেন ছোটসাব-বড়সাবরা। তারা বাজারে গিয়ে মাছ-মাংস, সদাইপাতি কিনবেন কোনোরকম দরদাম না করে। সঙ্গে থাকা সভাসদরা মারহাবা-মারহাবা বলে তাদের রুচি ও ক্রয়ক্ষমতার প্রসংশা করবে। দোকানদার বিগলিত হয়ে বলবে- স্যার, আবার আসবেন। বড় সুন্দর সে দৃশ্য। নজর আলীর বেলায় এরকম দৃশ্য কল্পনারও অতীত। কাজেই শরাফতউল্লাহর কাছ থেকে বাউলি মারতে হবে। এজন্য বিশ্বাসযোগ্য একটা গল্প তৈরি করা দরকার। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নজর আলী বললেন-
: শরাফত সাহেব, বাজারে যাওয়া চাঙ্গে উঠছে!
: কেন?
: আরে! নিজের যন্ত্রণায় বাঁচি না, এর মধ্যে খবর পাইলাম, আরেকজন ঢাকা মেডিকেলে যন্ত্রণায় কাতরাইতাছে। এখন আমাকে সেখানে যাইতে হবে।
: মানে?
: আমার এক আত্মীয় সকালবেলা অফিসে যাইতেছিল। বাসের চাপা খাইয়া তার শরীরের অর্ধেক অংশ থেঁতলাইয়া গেছে।
: আজ তাইলে ইলিশ কিনবেন না?
: আর ইলিশ! বাসের গুঁতা খাইয়া আপনজন চ্যাপ্টা হইয়া যাইতেছে, এই সময় ইলিশের পিছনে দৌড়াইলে চলব! ইলিশ ক্যান্সেল। এইবার ভর্তা-ভার্তি একটা কিছু দিয়া চালাইয়া দিব।
ভর্তার কথাটা নজর আলী চিন্তা করে বলেননি। গল্প বানাতে গিয়ে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে। শরাফতউল্লাহ বিদায় নেয়ার পর নজর আলী বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বসলেন। পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ খেতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। ইলিশের বদলে আলুভর্তা দিয়ে পান্তা খেলে সমস্যা কী? ভাবতে ভাবতে নজর আলী একটা পরিকল্পনা করে ফেললেন। বাসায় যাওয়ার পর বাজারের ব্যাগ জৈতুন বেগমের হাতে দিতেই সে জানতে চাইল-
: মাছ আনছেন?
: না।
: তাইলে কী আনছেন?
: আলু।
: আলু?
: সঙ্গে পাটশাকও আছে।
: মানে কী!
পরিকল্পনা অনুযায়ী চোখ কপালে তুলে নজর আলী বললেনÑ
: সে এক বিরাট ইতিহাস!
: ইতিহাস? বুঝলাম না...
: বুঝাইয়া বলতেছি। তার আগে আণ্ডা-বাচ্চা সবাইরে ডাক দেও। ইতিহাস তুমি একলা শুনলে চলবে না। সবাইকে শুনতে হবে। তা না হইলে তারা আমারে ভুল বুঝতে পারে।
জৈতুন বেগম চোখ পাকিয়ে বলল-
: একাব্বরের আব্বা, গল্প বানাবেন না কিন্তু!
: আরে না! আমার কী মাথা খারাপ হইছে, ইতিহাসের মধ্যে গল্প ঢুকাইয়া দিব? ইতিহাসের মধ্যে গল্প ঢুইক্যা যাওয়ায় বাঙালি জাতির আইজ কী দুরবস্থা, দেখতেছ না?
ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে দাঁড়ানোর পর গলা খাঁকারি দিয়ে নজর আলী বললেন-
: ইলিশ মাছ কিনবার নিয়ত কইরা বাজারে গেছি, তারপর কী ঘটল- সবাই মন দিয়া শোন। এইখানে-ওইখানে ঢু মারার পর একটা ইলিশ পছন্দ কইরা দাম জিজ্ঞাসা করলাম। দোকানদার নাক চুলকাইতে চুলকাইতে যে দাম চাইল, তা শুইন্যা মরা ইলিশ নইড়াচইড়া ওঠল।
এই দৃশ্য দেইখ্যা ভয়ে আমি দৌঁড় দেয়ার পর একটা আলুর বস্তার সঙ্গে টক্কর খাইলাম। বাজারে এত জিনিস থাকতে আলুর বস্তার সঙ্গে টাক্কর খাইলাম কেনÑ এইটা লইয়া গভীরভাবে ভাবতে গিয়া আমার মনে হইল, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো মোজেজা আছে। হায়াত-মউত-রিজিক এইসব হইল আল্লাহর হাতে। বছরের প্রথম দিন আমাদের রিজিকে আল্লাহপাক ইলিশ মাছ লেখেন নাই, তা এই ঘটনার মাধ্যমে তিনি বুঝাইয়া দিলেন- এই যুক্তির বশবর্তী হইয়া আমি আর মাছের বাজারে গেলাম না...
ছেলেমেয়েরা ইতিহাস শুনে মজা পেলেও আলুভর্তা ও পাটশাক দিয়ে পান্তা খাওয়ার কথা শুনে কলরব করে উঠল। জৈতুন বেগম বলল-
: আপনের আর কোনো বক্তব্য আছে?
: না।
: এইবার তাইলে আমার বক্তব্য শুনেন। পান্তা-ইলিশ বাসায় খাওয়াটা জরুরি না। নববর্ষ উপলক্ষে রমনা পার্কে অসংখ্য পান্তা-ইলিশের দোকান গজাইয়া ওঠে। আমরা সেইখানে পান্তা-ইলিশ খাবো।
দোকানে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার কথা শুনে নজর আলী দমে গেলেন। মেশিন দিয়ে পিস করা দোকানের এক-একটা ইলিশের টুকরার যে দাম নেয়া হয়, নজর আলীর পক্ষে সে ধাক্কা সামাল দেয়া কঠিন। জৈতুন বেগমকে নিরস্ত করার অভিপ্রায়ে নজর আলী বললেন-
: বছরের প্রথম দিন বাইরে খাইলে সারাবছর বাইরের খাবার খাইয়া কাটাইতে হবে!
নজর আলীর কথা শুনে জৈতুন বেগম উৎফুল হয়ে বলল-
: এইটা হইলে তো খুবই ভালো হয়। পুরা এক বছর রান্নাবান্নার ঝামেলা থেইক্যা মুক্তি পাওয়া বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। একাব্বরের আব্বা, তাইলে এই কথাই ফাইনাল- আগামীকাল আমরা রেডিমেড পান্তা-ইলিশ খাবো।
জৈতুন বেগমের কথা শুনে নজর আলীর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নিজের অজান্তে পতঙ্গ যেমন মাকড়সার জালে যেমন আটকা পড়ে, তেমনি নিজের কথার জালে নিজেই আটকা পড়েছেন নজর আলী। এখন উপায়?
লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক।
[email protected]
এইচআর/আরআইপি