মোটাতাজা ভেল্কিতে কোটায় ঘু-উ-টা
কোটা বিষয়ক চলমান আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আর আন্দোলনে থাকছে না। একদিকে ন্যায্যতার ন্যায্য দাবি এরইমধ্যে বরবাদ। অন্যদিকে, আকথা-কুকথাসহ নানা প্যাঁচাল ও কচলানিতে বিষয়টি একেবারে ‘অন্য কিছু’তে গিয়ে ঠেকেছে প্রায়। কোটা নিয়ে অংকের ছড়াছড়ি চরমে। যে যেদিক দিয়ে পারছেন মুক্তিযোদ্ধা, নারী, জেলা ও প্রতিবন্ধী ইত্যাদি নিয়ে মোটা মোটা হিসাব সাপ্লাই করছেন। বাজারে চলছেও এগুলো।
সেইসঙ্গে গুজব-গুঞ্জনের বাজারও গরম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম দিনে ‘পুলিশের গুলিতে আহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন’- এমন খবর রটেছে বা রটানো হয়েছে। আরেক কিছিমে বলা হয়েছে, রটনাটি ইমপোর্টেট ফ্রম লন্ডন বাই তারেক রহমান। এটিও বাজার কম পায়নি।
এ অবস্থার মধ্যেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মৃত্যুর গুজব ছড়ানোর পেছনে পুলিশের সাইবার ক্রাইম টিম শনাক্ত করেছে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের অ্যাকাউন্টকে। আবু বক্কর সিদ্দিকি নামে আহত শিক্ষার্থীর অজ্ঞান ছবি দিয়ে তার মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হয়। কী থেকে কী হচ্ছে? কোথাকার ঘটনা গড়াচ্ছে কোথায় গিয়ে? এ নিয়ে ভেল্কি লাগাচ্ছেই বা কারা?
লাগাম টানার চেয়ে সরকারিমহলে এ নিয়ে একটু আধটু খেল এবং স্বাধীনতা, একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধসহ চেতনার পাইকারি কথার ধুম। সরকারের হিতাকাঙ্খীদের কাছে এটি সাবোটাস। বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে এঁটে বঙ্গবন্ধুর কন্যার বিরুদ্ধে শ্লোগানের অর্থ জামায়াত-বিএনপির মদদপুষ্টদের আস্ফালন।
একটা জব্বর ইস্যুর দেখা মেলার তৃপ্তি বিরোধীমহল বিএনপিতে। সময় নষ্ট না করে এ আন্দোলনে চট জলদি সমর্থন দিয়েছে দলটি। এক নেতায় এক দল ধরনের বিশিষ্টজনরাও কোটা নিয়ে বিশেষজ্ঞ বক্তব্য ছুঁড়ছেন। কথার বহরে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে মোটামুটি একটা মৌসুম জমেছে। আরেকটি গ্রুপও গজিয়েছে। তারা বলতে চান- মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-নাতি-পুতির জন্য কোটা থাকলে রাজাকারের সন্তান-নাতি-পুতিদের জন্যও শাস্তির বিধান থাকা উচিত।
বিচ্ছিন্ন আন্দোলনের পরিণতি যা হওয়ার এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছে বা হবে। আন্দোলনকারীদের কেন মধ্যরাতে বিক্ষোভ করতে হবে? ছাত্রলীগকেই বা মাঠে আসতে হবে কেন? এসবের পেছনে শিরোমনি কারা? কোটা নিয়ে ডানে-বামে, পক্ষে-বিপক্ষে কথার ফুলঝুরি ছড়ালেও মুক্তিযোদ্ধারা কেন ভিক্ষা করে আজতক তা নিয়ে তো কোনো আন্দোলন তো দেখিনি আমরা।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাই এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তাহলে কোটা সুবিধা নেবে কারা? মুক্তিযোদ্ধাদের নামে কোটার হিস্যা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের কাছে কতোটা গেছে- সেটার কোনো হিসাব নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে যত বেশি সুবিধা জোগানোর ঘোষণা এসেছে, ততই বেড়েছে দুর্নীতি। ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ বলে পরিচিত সরকারগুলোও এ উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। মাঝখান দিয়ে বিতর্কিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধারা!
রাজনীতির দাবা খেলায় এখন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ‘মধ্যরাতের গণ্ডগোল, ভিসির বাসভবনে হামলা, আগুন দেওয়া, চারুকলায় হামলার ঘটনার মধ্যে গুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ কোটার যৌক্তিকতা বুঝবে? না কি চারুকলায় আগুন দেওয়া, ভিসির বাসায় ভাঙচুরের কথামালা শুনবে? ভাও বুঝে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলে দিয়েছেন, এরা রাজাকারের সন্তান?
এর আগে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় জারি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। কোটা পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ধরে নেয়া যায় বিষয়টি একটা পরিণতিতে চলে গেছে। সামনে রমজান, ঈদ, বাজেট। তারপর কোরবানীর ঈদ। পেঁয়াজ-তেলের কায়কারবার। চলে আসতে পারে ডিম দিবস। মানুষ তখন কোটার কথা এমনিতেও ভুলে যাবে। কোটা নামের এ সদকা-ফেতরার নিস্পত্তিও আসবে না।
আন্দোলনকারীরা মাঠে থাকুক, না থাকুক বল এখন সরকারেরই কোর্টে। সরকার কিভাবে খেলবে তার ওপর নির্ভর করে আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি। সরকার যথোচিতভাবে কোটাসংস্কার না করলেও ৭ মের পরে তাদের করার কিছু থাকবে না। এটি সরকার উৎখাতের আন্দোলন নয়। কোনো বিপ্লবী আন্দোলনও নয়। তবে যে কোনো আন্দোলন সফল হওয়ার একটা শর্ত হচ্ছে থামতে জানতে হয়, স্ট্রাটেজিক বিরতি দিতেও জানতে হয়।
বিভক্ত আন্দোলনকারীরা এ গুণ-বৈশিষ্ট্য নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে কি না সময়ই বলে দেবে। বড় জোর তারা আবার নামবে বঙ্গবন্ধুর ফ্রেমবাঁধানো পোর্ট্রেট নিয়ে। পুলিশও ছুঁড়বে টিয়ার শেল। সেই শেল আন্দোলনকারীদের চোখে বা বঙ্গবন্ধুর ছবিতে যেখানেই পড়ুক তাতে কিছুই যাবে-আসবে না। কোটাবাজির বয়স ৪৬ বছর। এর বেড়ে ওঠা ও ফলাফল দেখছে সবাই। মাগনা, ফাও সদকাভিত্তিক চাকরিসহ অন্যান্য প্রাপ্তিতে লজ্জার বালাই নেই।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/আরআইপি