ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পাল্টানো সময়ে

প্রকাশিত: ০৫:২২ এএম, ২৬ জুলাই ২০১৫

সে এক বিরাট ডাকাত । তাকে ধরা হয়েছে । ভয়ংকর মানুষটাকে কঠিন সাজা দেওয়া হবে। ইউনূসকে খবর দেওয়া হয়েছে। সে এসে কোটর থেকে তুলে নেবে চোখ । এই কাজে তার অনেক পারদর্শিতা আছে। খেঁজুর কাটা দিয়ে চোখ তুলে আনার বিষয়ে তার সুনাম আছে। একদিকে তার অপেক্ষা অন্যদিকে চলছে উৎসব। এরইমধ্যে কয়েক দফা মাইর দেয়া হয়েছে  ডাকাতকে। মাইরের ওপর ওষুধ নাই। কিন্তু ডাকাত নির্বিকার। চোখ ফুলে আছে। পিপাসায় ক্লান্ত। তবু সে নির্বিকার। কারণ সে জানে ভিড়ের মাঝে কেউ না কেউ এসে বলবে, আহা অনেক হইছে মানুষটারে ক্ষ্যামা দেন। শেষ দৃশ্যে বাড়ি বা চৌদ্দ শিকের আড়ালে চলে যাবে লোকটা।

হুমায়ূন আহমেদের এই বর্ণনা অনেকেরই জানা। নাটকের এই দৃশ্য দেখে বা বর্ণনা পড়ে, মানুষের ভালোত্বের প্রতি শ্রদ্ধাই বরং বাড়ে। হুমায়ূন আহমেদের বর্ণনার সময় কি পাল্টে গেলো এত দ্রুত? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় লেখককে চাপাতি দিয়ে কোপানোর সময়, আটক হলো না খুনিরা। কেউ ভিড় থেকে এগিয়ে এসে ঝাপটে ধরলো না। বললো না, এইটা আপনি কি করুইন। কিংবা, কেউ আমারে পানি খাওয়াওরে আমি মইরা যাইয়ায়… শুনেও দর্শকদের কেউ বললো না, ক্ষ্যামা দেন। ওরে ছাড়েন, ও নাবালক, মাইরা যাইয়ের। 

দুই.
আমার মায়ের বয়স বেড়েছে। বেড়েছে আমারও। আমরা দুজন যেকোনো বিবেচনায় ছোট নই। কিন্তু দেখা হলে রুটিটা বা চিতল পিঠা ছিড়ে হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠা নেই তাঁর। আরে আরেকটু খা। চোখ ভিজে আসে নীরবে। আশপাশে ভাইয়ের মেয়েরাও ভিড় করে। আরে খান, শক্তি বাড়বো। ফলে, ফেইসবুকে যখন কারো স্ট্যাটাস দেখি, মাদার সিক, প্লিজ প্রে, বুকের ভেতর কেমন কেমন লাগে। সবার মা, সব সময়ের জন্য ভালোবাসার এক আকাশ। সেখানে সবার অনুভূতি সমান। তারপরও সেদিন আজিজ মার্কেটে এক বন্ধু বললো, জানিস এক ছেলেকে চিনি, সে ফেইস বুকে জানালো তার মা অসুস্থ। প্লিজ প্রে। কিন্ত মায়ের কাছে যায়নি। কারণ ব্যস্ততা। আমরা লাইক দেই । শেয়ার দেই কিন্তু বাস্তবতা জানি না।

আবেগের অনুবাদ কী তবে বদলে যেতে বসেছে? সেই গল্পটাতো সবারই জানা। এক বন্ধু লিখেছে অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। অনেকে লিখেছে শুভ কামনা। শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠুন। একজন শুধু ফুল হাতে দেখতে গেছে হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধে ম ম করা রুমে।

তিন.
ফেইসবুক বলুন আর ব্লগ বলুন, সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম এক সঙ্গে পরিচিত নিউ মিডিয়া নামে। আর এখানে তথ্য আদান প্রদানের যে পদ্ধতি তাকে আদর করে ডাকা হয় সিটিজেন জার্নালিজম নামে। মানে, একেবারে মানুষের একান্ত মনের খবরটি রটিয়ে দেওয়ার কাজটি সে করতে পারে। অবরুদ্ধ সমাজে, যেখানে গণমাধ্যম যেতে পারে না, সেখানে নিউ মিডিয়া কাজ করে প্রবলভাবে। এটাই এই নতুন যুগের শক্তি। অসুবিধা একটাই। সেখানে কোনো সম্পাদক  না থাকায়, অসম্পাদিত তথ্য হু হু করে আসে মানুষের সামনে। তা অতি ভয়ংকর হতে পারে কখনো কখনো। তারপরও নিউ মিডিয়া  কখনো কখনো পত্রিকা ও সম্প্রচার মাধ্যমকে প্রভাবিত করে প্রবলভাবে। এর সবচেয়ে জোরালো উদাহরণ, রাজন হত্যাকাণ্ড। ফেইসবুকে ভিডিও আপলোড না হলে, এই সংবাদ আমাদের কাছে আসতো কিনা জানি না। এলেও এমন প্রবল প্রভাব পড়তো কি না তা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। যদি সংবাদটি এমন হতো, গণপিটুনিতে চোর নিহত, তাহলে কি একই প্রভাব হতো সমাজে?

চার.
শাহবাগ আন্দোলনের কথা ভুলিনি নিশ্চয়ই। তার আগে অনলাইনে মানে ব্লগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির আদর্শিক লড়াই। ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে একদল তরুণের প্রাণপণ লড়ে যাওয়া মনে আছে নিশ্চয়ই। সে আবগের প্রকাশ যদি শাহবাগের জমায়েত হয়, তবে অনলাইনের শক্তি নিয়ে আর কিছু না বলাই ভালো। নদী দেখে যে বুঝে না জলের গভীরতা, তার কাছে সাগরও যা, খাল ও তা।

বলছি, আদর্শিক লড়াইয়ে নিউ মিডিয়া দারুণ এক জায়গা। কিন্তু ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশে? হাই বলে একটা নক করে, দারুণ একটা জন্মদিনের কার্ড পাঠিয়ে , শোকে রিপ লিখে যারা ভাবেন দায়িত্ব শেষ। আমি তাদের দলে থাকতে চাই না। আমার বরং ভালো লাগে শোকে কারো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। ভালো লাগে বন্ধুর হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হাতে ব্যথা করে দিতে। ভালো লাগে ভিড় থেকে মায়াবতি কেউ এসে বলবে, করছুইন কী, পানি দেইন পোলাডারে, ওই মইরা যাইয়ের, শুনতে বা পড়তে।

পাঁচ.
ব্যক্তিগত অনুভূতির অনেক প্রকার আছে। যখন কেউ রাষ্ট্রীয় কোনো নীতি নিয়ে কথা বলে কিংবা সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের  নিন্দা বা প্রশংসা করে তখন তা সেই মানুষটির ব্যক্তিগত অবস্থানেরই জানান দেয়। বিষয়টি যেহেতু অসংখ্য মানুষের মনে অনেক ব্যক্তিগত বিষয়ের যোগফল হয়, তাই তা আর ব্যক্তিগত থাকে না। হয় সামগ্রিক। ফলে, রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির অনেক বিষয় আপনার কাছে ব্যক্তিগত হলেও একই অনুভূতি আমারো হওয়ায় তা আর আপনার ব্যক্তিগত থাকছে না। সে সব একান্ত কথা সামগ্রিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য দরকার। আদর্শিক অবস্থান তৈরির জন্যও দরকার। আবার কারো জন্য অকাতর আবেগও ব্যক্তিগত। অন্যের সঙ্গে হয়তো মিলবে না তা।

ছয়.
শেষ কথা বলি। কেবল মানুষই মানুষের চোখে তাকিয়ে বসে থাকতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রকৃতির অন্য কেউ কি এই চর্চা করে? প্রকৃতির অন্য কেউ কি ফেইসবুকিং করে? আমরা দুটোই করি। আবার নিজেদের রক্ষা করি নানা ঝামেলা ও সংকট থেকে। এবার না হয় আগের দিনে ফিরে যাবো । মানে নিজের পাশাপাশি রক্ষা করবো অন্যকে। কারণ আইন চলবে নিজের গতিতে। অপরাধী চিহ্নিত করে সাজা দেয়ার কাজ সে করে যাবে। মানবিকতা রক্ষা না করলে মানব নামের অর্থ যে অনেক হাল্কা হয়ে যায়।  

shadi

এইচআর/এমএস