আন্তর্জাতিক নারী দিবস : কতটা প্রাসঙ্গিক এখনও
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস আশা করি আমাদের প্রায় সবারই কমবেশি জানা আছে। শিল্পবিপ্লবের পর কোন প্রেক্ষাপটে নারীদের জন্য একটি আলাদা দিবসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন আমাদের পূর্বসূরিরা সে ইতিহাস এখন যে কেউ চাইলেই গুগলেও পাবেন। তাই সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে না টেনেও যদি সেদিনের বাস্তবতাকে এখনকার বাস্তবতায় বসানো যায় তাহলে হয়তো একটা তুলনামূলক চিত্র আমরা দাঁড় করাতে পারবো।
১৯ শতকের যে দিনটিতে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়েছিলো সেদিন যেসব দাবি নিয়ে মিছিল বা র্যালিটি হয়েছিলো সেসব দাবিগুলো কি ছিলো? খুব শক্ত কোন দাবি ছিলো না। ছিলো রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ যেসব ক্ষেত্রে নারীদের বিচরণ আছে সেসব জায়গায় নারীর অবস্থানকে স্বীকৃতি দেয়া এবং নারীর অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে একে অপরের সাহায্যের হাতটিকে শক্তকরে ধরে রাখা। এই এত বছর পর ২০১৮ সালের নারী দিবসের ঘোষিত থিম বা প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে "Press For Progress"
জাতিসংঘ প্রতিবছরই নারী দিবসের একটি করে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে দেয়। ২০১৭ সালের 'গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ' রিপোর্ট অনুসারে দেখা যায় সারা বিশ্বে জেন্ডার গ্যাপ দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। অর্থাৎ, নারীর প্রতি দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী এখনও প্রায় ২০০ বছর পিছিয়ে আছে। যদিও রিপোর্ট বলছে নারীরা বিচ্ছিন্নভাবে নিজেরা অনেক বেশি এগিয়ে আসছে, চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে, দিচ্ছে। নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন ও সচল। সাম্প্রতি মি টু ক্যাম্পেইনসহ সারা বিশ্বজুড়ে চলা কিছু সামাজিক আন্দোলন থেকে এটা প্রতীয়মান হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সমাজে যদি নারীকে দেখার একটি সামগ্রিক এবং ইতিবাচক দৃষ্টি জেগে না ওঠে অর্থাৎ, নারীকে অক্ষম, দুর্বল বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণি হিসেবে দেখার এবং নারীর অবস্থানকে অস্বীকৃতির সংস্কৃতি থেকে যদি মুক্তি না আনা যায় তাহলে জেন্ডার বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে না। আর এই শপথকে সামনে রেখেই এই বছর নির্ধারণ করা হয়েছে সারাবিশ্ব জুড়ে নারীর জন্য নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে হাতে হাত রেখে অগ্রগতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। তার মানে ১৯ শতকের বাস্তবতা এই একবিংশ শতকে এসেও এতটুকু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় নি বরং বেড়েছে বলা যায়।
এইতো গেলো আন্তর্জাতিক ভাবনার কথা। একটু বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার দিকে তাকালে কী দেখতে পাই আমরা? উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর অভিজ্ঞতা যদি হয় এখনও জেন্ডার বৈষম্য দূর করতে এগোতে হবে আরও অনেক পথ তাহলে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ যে এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নারী উন্নয়নকে একই সূত্রে বাঁধতে পারেনি তাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদে সই করা একটি দেশ। "মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল" এ "নারীর প্রতি বৈষম্য" বিষয়ক যে ধারাটি আছে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে এখন "সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল" এর টার্গেট নিয়ে আগাচ্ছে। অর্থাৎ, যে উন্নয়ন এসেছে তাকে দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখাই হচ্ছে এর লক্ষ্য। কিন্তু আসলেই কী আমরা নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে পেরেছি? নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পেরেছি?
পরিসংখ্যানে গেলে হয়তো কিছু বেঞ্চমার্ক আমরা অর্জনে সফল হয়েছি। নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিতে পেরেছি কিন্তু সেটা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে নিশ্চিত করতে পেরেছে কতটা? সেই হিসাব কী আদৌ আছে আমাদের কাছে? নারীর মানসিক মুক্তি কী এসেছে? রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কতটা নারীর প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে বাড়ানো হয়েছে আর কতটা এম ডি জি'র কোটা পূরণের জন্য হয়েছে? সমাজ বা পরিবার কি এখনও আমাদের কন্যা সন্তানের জন্মকে হাসিমুখে মেনে নিচ্ছে?
গৃহকোণ থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কন্যাটিকে কি বিনা বাধায় বেরিয়ে আসতে দেয়া হচ্ছে? কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থা বা অবস্থান কী? রাস্তায়, অফিসে, গণপরিবহনে কি নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা গেছে? অনেকেই মনে করেন, নারীবান্ধব আবার কী জিনিস? নারীরা যদি পুরুষেরই সমান হয় তাহলে আবার বিশেষ করে তাদের জন্য ব্যবস্থা কেন রাখতে হবে? কেন নারীকে আলাদা করে বিবেচনা করতে হবে?
নারীবান্ধবের সংজ্ঞা খুব সহজে বলা যায়, যখন যে পরিবেশে একজন নারী চলাফেরা বা মেলামেশার ক্ষেত্রে নিজেকে নারী বলে মনে করবে না, সমাজের একজন নাগরিক হিসেবে তার সুযোগ বা সুবিধাগুলো অন্যদের মত সহজেই এবং বিনা নিগ্রহে পাবে, কোন প্রকার লড়াই বা হেনস্তার শিকার না হয়েই যখন একজন নারী নিজের মত প্রকাশের মত সুযোগ পাবে সেটিকেই আসলে বলা যায় নারীবান্ধব পরিবেশ।
আমাদের সমাজ কি নারীবান্ধব? আমাদের কর্মস্থলগুলো কি নারীবান্ধব? আমাদের মার্কেট, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন কি নারীবান্ধব? উত্তরটি নিজের কাছে পরিষ্কার হলেই কেন আলাদা করে নারীর জন্য দিবস করা লাগবে সেই উত্তরটি পাওয়া যাবে। পরিসংখ্যান বলে, যে হারে নারীরা ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে সে হারেই আবার তারা গৃহকোণে ফিরে যেতে শুরু করেছে কেবল একটি সহায়ক পরিবেশের অভাবে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে। প্রতিদিনের ধর্ষণ ও নির্যাতনের চিত্র আমাদের কারোই অজানা নয়।
তাই, যারাই বলে থাকেন, এই একবিংশ শতকে এসেও কেন ৮ মার্চ পালন করতে হবে? বা একটি বিশেষ দিনেই কেন নারী দিবস হবে? তাদের জন্য উত্তর হচ্ছে, যেদিন আমরা সমাজ থেকে নারীকে নারী বলে নয়, একজন সামাজিক জীব হিসেবে, সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মেনে নেবার মত মানসিকতা ধারণ করতে পারবো, যেদিন আমাদের পরিবারগুলো ঘরের কন্যাকে কেবল রন্ধনশিল্পী নয় একজন কর্মক্ষম কর্মজীবী মানুষ যে আকাশ জয় করার ক্ষমতা রাখে বলে বিশ্বাস করবে সেদিন হয়তো এই বিশেষ দিবসের প্রয়োজনীয়তা বা প্রাসঙ্গিকতা আর থাকবে না।
কিন্তু তার আগ পর্যন্ত অন্তত এই একটি দিন সবাইকে মনে করিয়ে দিবে, নারীরা কারও দয়ার পাত্র নয়। নারীর সমস্যাগুলোকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নারীর মেধাকে স্বীকৃতি দিয়ে তার যোগ্য জায়গা তৈরি করে দিতে হবে। ঘরে বাইরে সব জায়গাতেই নারীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নয়, স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর মা হবার প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে তার দুর্বলতা বা অসুস্থতা নয় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ৮ মার্চ মনে করিয়ে দেয়, কন্যা শিশু সমাজের বোঝা নয়। ৮ মার্চ মনে করিয়ে দেয়, নারীর ঋতুস্রাব তার জন্য পাপ নয়। এসব বিশেষ দিনে নারীরা অপবিত্র থাকে না কারণ প্রকৃতি তাকে এভাবেই গড়ে দিয়েছে।
৮ মার্চ মনে করিয়ে দেয় নারী কেবল প্রেয়সী বা প্রেমিকা হবার জন্য জন্মায়নি, সেও সমান তালে তার পুরুষ সহকর্মীর পাশাপাশি কাজ করবার মত যোগ্যতা রাখে। তারও আছে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, নিজের মত করে উড়তে চাওয়ার অধিকার, যখন যেমন ইচ্ছা চলতে পারার মত ইচ্ছে। নিজের মত করে পথ বেছে নেবার স্বাধীনতা, আছে সঙ্গী বেছে নেবার যোগ্যতা। কেবল নারী বলেই যেদিন সমাজ তাকে আর আঘাত করবে না, কেবল নারী বলেই সমাজ যেদিন একজন নারীকে আঙ্গুল তুলে দেখাবেনা তুমি অপবিত্র, তোমার জন্য বাইরের দুনিয়া নয় গৃহকোণই তোমার গন্ডি সেদিনই কেবল বলা যাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। যেদিন ঘরে ঘরে নারীদের মুক্তির গানের সুর ভাসবে, যেদিন পুত্রের চেয়ে কন্যাকে কোন অংশেই কম যোগ্য মনে করা হবে না কেবল সেদিনই বলা যাবে নারীদের জন্য আলাদা কোন দিবসের প্রয়োজন নেই। যেদিন সমাজের পুরুষেরা আর পশুর আচরণ করবে না, যেদিন সমাজে চলে আসা নারীর প্রতি সংহিংসতাকে রুখতে পুরুষেরাই আগে মাঠে নামবে, যেদিন নারীর মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য আর নারীকেই গলা ভেঙে রাস্তায় নামতে হবে না সেদিনই বলা যাবে বছরের সকল দিনই নারীর কেবল একটি দিনেই সীমাবদ্ধ রাখাটা যৌক্তিক নয়।
ততদিন পর্যন্ত আসুন আমরা নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে গলা তুলি। নারীর অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হাতে হাত রেখে বলি #pressforprogress এটি যেন কেবল শ্লোগানেই সীমাবদ্ধ না থাকে। এই শ্লোগানকে বুকে ধারণের মত একটি সামাজিক বাস্তবতা তৈরিতে ভূমিকা হোক সকলের। নারী দিবস কেবল একলা নারীর জন্য নয়।
লেখক: কলামিস্ট।
এইচআর/আরআইপি