বি চৌধুরী এবার নিশ্চয়ই জিয়ার মাজারে যাবেন!
বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী আবারো স্বপুত্র বিএনপিতে ফিরতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ঘরের ‘ছেলে’ ঘরে ফিরে যাচ্ছেন বলে তাকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। ৮৪ বছর বয়সী প্রবীণ এই চিকিৎসক জীবনের শেষ স্পেলে এসে বুঝতে পেরেছেন এই দেশের মানুষ এখনো তৃতীয় শক্তিকে বরণ করতে আগ্রহী নয়। এক যুগেরও বেশি সময় বিএনপির বাইরে থেকে অশ্বডিম্ব প্রসব করে বুঝতে পেরেছেন তিন নম্বর হলে কী হয়।
গত ২৮ মে অধ্যাপক চৌধুরী তার সাবেক নেতা সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। সেদিনই ঈঙ্গিত মিলেছিল বিএনপিও তাকে ফিরে পেতে চায়। কারণ ওই আলোচানা সভার আয়োজন করেছিল বিএনপি। তাতে প্রধান অতিথি ছিলেন জনাব চৌধুরী। আর দর্শক সারিতে ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির মতো একটি দলের অনুষ্ঠান, তাও আবার দলের প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুবার্ষিকীকে ঘিরে, সেখানে দল থেকে বের করে দেওয়া বা বের হয়ে যাওয়া একজন নেতাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছে নিশ্চয়ই খালেদা জিয়ার সম্মতিতে। এরপর ইফতার পার্টিতে তাদের দাওয়াত দেয়া নেয়ার মধ্য দিয়ে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।
এরইমধ্যে গণমাধ্যমে গুঞ্জন শুরু হয় খালেদা জিয়া আরেক বর্ষীয়ান ব্যক্তি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদকে দায়িত্ব দিয়েছেন দলছুট সবাইকে বিএনপির ছাতার নিচে নিয়ে আসতে। এই প্রক্রিয়ায় কর্নেল অলি এবং জরুরি অবস্থার সময় সংস্কারের নামে দল থেকে বের হয়ে যাওয়াদেরকেও ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে। বি চৌধুরী বিষয়টি উড়িয়ে দেননি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানো খুব কঠিন কাজ নয়। তেমন প্রয়োজন হলে বিএনপির পাশেও দাঁড়াতে পারেন। তার পুত্র মাহী চৌধুরীও একই সুরে কথা বলেছেন। তার ভাষায় বিএনপিসহ জাতীয়তাবাদী দলগুলোকে শক্তিশালী করতে হলে জিয়ার রাজনৈতিক দর্শনে আবার ফিরে আসতে হবে। সব জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের ভিত্তি হতে হবে জিয়ার রাজনীতি। তার মানে তারা উন্মুখ হয়ে বসে আছেন বিএনপিতে ফিরতে।
অধ্যাপক চৌধুরীর প্রথম রাজনৈতিক দল বিএনপি থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছিল জেনারেল জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানানো নিয়ে। আবার তার ঘরে ফেরার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েই। বিএনপির ও বি চৌধুরীর ভুলে যাওয়ার কথা নয় বিকল্প ধারা নামে দল সৃষ্টির প্রেক্ষাপট কী ছিল এবং পরবর্তী সময়ে এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল। আবার তিনি বিএনপিতে যেতেই পারেন তবে আগের বার অপমানিত হয়ে বের হয়ে এসে বলেছিলেন বিএনপির সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ করতেই আলাদা দল গঠন করেছেন।
২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পর বি চৌধুরীকে বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করে। কয়েক মাস না যেতেই আসে জেনারেল জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী। রাষ্ট্রপতি একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি তাই তিনি জিয়ার কবরে ফুল দিতে যাননি। এতেই ক্ষেপে যায় দলের সব এমপি। একপর্যায়ে ২০০২ সালের ১৯ ও ২০ জুন বিএনপির সংসদীয় দলের সভায় রাষ্ট্রপতি পদ থেকে তাঁকে সরানোর জন্য `ইমপিচমেন্ট`-মানে গলাধাক্কা দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ওই প্রস্তাব সংসদে উত্থাপনের আগেই ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন বি চৌধুরী। জিয়ার মাজারে না যাওয়ার চেয়ে বড় কারণ তখন আলোচিত ছিল অধ্যাপক চৌধুরীর পুত্র মাহী চৌধুরীর সাথে জেনারেল জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের ভাগাভাগির দ্বন্ধ। জিয়ার মাজারে না যাওয়াটাকে ইস্যু হিসেবে নিয়ে তারেক রহমানের ঈঙ্গিতে দলের তরুণ এমপিরা বিদ্রোহ করেছিলেন। একদিকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র আরেক দিকে রাষ্ট্রপতির পুত্র।এই দ্বন্দ্বেই বি চৌধুরীকে হারাতে হয় রাষ্ট্রপতির পদ।
রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়ার পর অধ্যাপক চৌধুরী বিএনপি থেকেও পদত্যাগ করেন। ২০০৪ সালে বি চৌধুরী তার পুত্র মাহি কে নিয়ে বিকল্প ধারা বাংলাদেশ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সঙ্গে নেন দলের আরেক এমপি এম এ মান্নানকে। দল গঠনের আগেই তাদের ওপর শুরু হয় অত্যাচার। বাড়িতে হামলা, হাসপাতালে হামলা, দেশের কোথাও সমবেত হতে পুলিশের অনুমোদন না দেয়া, মান্নানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাংচুর চলতেই থাকে। বিএনপির কর্মীরা মহাখালী রেললাইনের পাশে বি চৌধুরীর ওপরও হামলা চালায়। সারাদেশে যেখানেই বি চৌধুরীর অনুষ্ঠান সেখানেই হামলা। শুধু তাই নয় তার দলের মহাসচিবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেয় বিএনপি সরকার। বিএনপির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস আর দুর্নীতির অভিযোগে বি চৌধুরী এক সময় ড. কামালকেও সাথে পান।
এরকমই প্রেক্ষাপটে বিএনপি জামাত সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে কর্নেল অলির নেতৃত্বে বিএনপি থেকে বের হয়ে আসে কয়েকজন সংসদ সদস্য। তাদেরকে সাথে নিয়ে বি চৌধুরী ও কর্নেল অলি মিলে গঠন করেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। বি চৌধুরী চেয়ারম্যান এবং কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ কো-চেয়ারম্যান হন দলটির। বিলুপ্ত হয়ে যায় বিকল্প ধারা। কিছু দিন না যেতেই নেতৃত্বের কোন্দলে আলাদা হয়ে যান বিএনপিত্যাগী এই দুই নেতা। পরে বি. চৌধুরী তার প্রতিষ্ঠিত দল বিকল্পধারা বাংলাদেশকে নিয়েই নতুন করে পথ চলা শুরু করেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনেও অংশ নেয় বিকল্প ধারা। কুলা প্রতীক নিয়ে বি চৌধুরী পুরান ঢাকা ও তার নিজের ছেলে মাহী চৌধুরী মুন্সিগঞ্জের আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পুরান ঢাকার আসনটিতে জামানত হারান বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ও সাবেক রাষ্ট্রপতি। আর মুন্সিগঞ্জের যে আসনে বিএনপির হয়ে কখোনেই হারেননি বি চৌধুরী সেখানে কোনো রকমে জামানত ঠেকাতে পেরেছিলেন। সারাদেশে৬৩ জন প্রার্থীর ৬১ জনই জামানত হারায়। আর সব মিলিয়ে দেড় লাখ ভোটও তারা পাননি।
যত জনপ্রিয় নেতাই হন না কেন মূলধারার বাইরে গেলে যে জামানতও টেকানো যায় না এটা বুঝতে অনেক দেরিই করেছেন তারা। তাই পুরানো অপমানের কথা ভুলে গিয়ে আবার তিনি সেই দলেই ভিড়তে চাইছেন। তবে কিসের জন্য? তিনি কী আশা করছেন আবারো বিএনপি ক্ষমতায় আসবে এবং তখন তিনিই হবেন রাষ্ট্রপতি। সে আশা তিনিই করতেই পারেন। অথবা তার পুত্রের ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই পারেন। তবে অধ্যাপক চৌধুরী যে গত জুন মাসে বলেছিলেন বিএনপিকে জামাতমুক্ত হতে হবে। সেটার কী হবে? তিনি জামাত নির্ভর বিএনপিতেই ফিরে যাবেন নাকি জামাতমুক্ত বিএনপিতে যাবেন? সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। শোনা যাচ্ছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি বিএনপিতে ফিরে যাবেন। জিয়ার মাজারে না গিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ হারিয়েছিলেন অধ্যাপক চৌধুরী, এবার ফিরে যেতে চাইলে জিয়ার মাজারেই ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দিতে হবে।
এইচআর/পিআর