ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ১০:২৭ এএম, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হবে- এই মর্মে রয়েছে সাংবিধানিক ও আইনি নির্দেশ। কিন্তু কোথাও কী এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? তাছাড়া আইন করে কী ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করা যায়? প্রশ্ন জাগে, মাতৃভাষাকে কেনইবা আইন দিয়ে মর্যাদা রক্ষা করতে হবে? যতদিন পর্যন্ত আপামর জনতা অন্তর থেকে নিজ ভাষাকে শ্রদ্ধা করতে না শিখবে ততদিন কী সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হয়েছে বলা যায়?

প্রশ্ন হতে পারে কেন বাংলাকেন্দ্রিক হতে হবে সবকিছু? উত্তরটাও খুব সাধারণ। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় যখন কিছু বলা হয় বা প্রচার করা হয় তখন খুব সহজেই সমাজের যেকোন প্রান্তে থাকা মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ হয়ে যায়। বিজাতীয় ভাষায় যোগাযোগ করা হলে সেখানে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় ভাষার সারল্য ও বোধগম্যতা। আপনি কোন বক্তব্য যখন একটি বড় জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে চান তখন তার মাধ্যম কী হবে? সেটি লেখ্য হোক আর কথ্য হোক এর মাধ্যম যদি হয় মাতৃভাষা তখন এর জন্য খুব বেশি ব্যাখ্যা না দিলেও সেটি পৌঁছে দেয়া সম্ভব। কিন্তু অত্যন্ত পীড়াদায়ক হচ্ছে রক্তক্ষয়ী একটি লড়াইয়ের মাধ্যমে পাওয়া এই ভাষাকেও আমরা অবহেলা করছি প্রতিনিয়ত। এর পিছনে কিছুটা যেমন অবহেলা আছে অন্যদিকে আবার সামাজিক মর্যাদার একটি বাহ্যিক কারণও যুক্ত আছে।

বাংলা ভাষার ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের উপরে। বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে দেখা যায় এ ভাষাটি কখনই বিনা তর্কে এক নম্বর হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সমাজের উচুঁস্তরের মানুষের কাছে বাংলা কখনই তাদের স্যোসাইটির ভাষা বলে গ্রহণযোগ্য ছিলো না। একটা সময়ে আররি ফার্সির প্রভাব থাকলেও পরবর্তীতে ইংরেজির প্রভাব চালু হয় প্রবলভাবে।

এই অঞ্চলে বাংলাকে কেন্দ্র করে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হলেও বেশ লম্বা সময় ধরে বাংলাকে বিবেচনা করা হতো নিম্ন শ্রেণির ভাষা হিসেবে। সাহেবী ভাষা হিসাবে ইংরেজিকেই বিবেচনা করা হতো। কোলকাতা কেন্দ্রিক যে শিক্ষিত সমাজটি গড়ে উঠেছিলো তৎকালীন সময়ে তাদের বেশিরভাগই কথা বলতেন ইংরেজিতে। শিক্ষকরা ক্লাসে লেকচার দিতেন ইংরেজিতে, ছাত্রদেরকে তর্ক বিতর্ক এমনকি পরীক্ষার খাতাতেও ইংরেজিতে লেখাকেই উৎসাহিত করা হতো।

মেধাবী ও তুলনামূলক সুবিধাজনক শ্রেণি বাংলাকে নিজের ভাষা হিসেবে নিতে পারেনি কখনই। অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকেও যত সাহিত্য চর্চা হতো তার ভিতরেও কেউ কেউ ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করতে চাইতেন। মধুসূদন দত্ত এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জানা যায়, বঙ্কিম চন্দ্রও প্রথম দিকে ইংরেজিতেই তার লেখা চালাতে চেয়েছিলেন।

সে সময়ে তরূনরা ইংরেজিকেই প্রাধান্য দিত বেশি এমনকি নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনাও চালাতো ইংরেজিতে। এই ইংরেজি নির্ভরতার কারণ হিসেবে গোলাম মুরশিদ তার "হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতি" বইয়ে বলেছেন এটি কেবল কিছু সুযোগসুবিধার জন্য হয়েছিলো বিষয়টি তা নয়। কারো কারো কাছে এই ইংরেজি নির্ভরতা ফ্যাশন হিসেবেও প্রচলিত ছিলো।

এমনকি ইংরেজদের ভাষাকেই কেবল তারা রপ্ত করেনি, রপ্ত করেছিলো ইংরেজদের জীবনাচরণও। বাঙালি সমাজের নিয়ম, আচার বা সংস্কৃতিকে পাত্তা না দেয়া এ সবই তারা আয়ত্ত্ব করেছিলো নিজেদেরকে আধুনিক প্রমাণের জন্য। অষ্টাদশ শতকে কলেজগুলোর ছাত্রদের মাঝে দেখা যায় তারা ইংরেজিতে যতটা পারদর্শী হয়েছিলো ঠিক ততটাই দুর্বল ছিলো বাংলা ভাষায়।

সপ্তদশ, অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতকেও বাংলা ভাষা নিয়ে সমাজে যে মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় এই একবিংশ শতকে এসেও কী এর খুব একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে? এখনও কী আমাদের সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত ছাত্রদের মাঝে ইংরেজি বলা একটি ফ্যাশন নয়? বাংলা বলা আর ইংরেজি বলাদের মাঝে কী পার্থক্য করা হয় না?

ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোটাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে স্ট্যাটাসের অংশ। গ্লোবালাইজেশনের অজুহাতে আমরা প্রতিনিয়ত বাংলাকে অবহেলা করে যাচ্ছি। আমাদের এখানে বাংলা মিডিয়ামের শিক্ষাকে এখনও সমাজে আপাত পিছিয়ে পড়া শ্রেণির বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ, ভিনদেশি ভাষা হলেও ইংরেজি জানাকে বলা হয় দক্ষতা আর শুদ্ধভাবে বাংলা জানাকে কোন দক্ষতার মধ্যে আনা হয় না।

বহুমুখি শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্যই তৈরি করছে এই পার্থক্য। অফিস আদালত সব জায়গাতেই ইংরেজি জানাকেই যোগ্যতা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। চাকরির বাজারে কেউ প্রয়োজনীয় যোগ্যতার ঘরে লিখে দেয় না শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে ও পড়তে জানতে হবে। বরং লেখা থাকে, ইংরেজিতে দক্ষ হতে হবে।

ভাষা কেবল একটি ভাষা নয়। এর সাথে জড়িত একটি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ, বিশ্বাস সবকিছু। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে পেয়েছিলাম। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাওয়ার মাধ্যমেই পেয়েছিলাম বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশটি যার একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা পদ্ধতি, বিচার ব্যবস্থাসহ সকল কাঠামো হয়েছিলো এদেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাওয়ার উদ্দেশ্য ছিলো গোটা বিশ্বে বাঙালিদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরা। বিদেশী ভাষাকে বয়কট নয় বরং নিজ ভাষায় বিদেশি ভাষাকে জানার রাস্তা তৈরি করা। বিশ্বের হাজার হাজার ভাষার মধ্যে বাংলার স্থান ষষ্ঠ। অথচ আমরা বাংলাভাষী হিসেবে এখনও গর্ব করি না। বিশ্বমানের সাহিত্য রচিত হবে বাংলায় এবং সেগুলোকে তুলে ধরা হবে বিশ্ব দরবারে। অথচ এখন হচ্ছে তার উল্টো।

আমরা বিদেশি ভাষাকেই অবশ্য শিক্ষণীয় বলে ধরে নিয়ে বাংলাকে করে দিয়েছি অপশনাল। বিশ্বসাহিত্য আদান প্রদান করতে হলে ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। বাংলা ভাষার উৎকর্ষে ভাষা নিয়ে নতুন নতুন গবেষণা, সাহিত্য চর্চা ও প্রচারের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। অথচ আজকে বাংলা একাডেমির ভূমিকা অনেকটাই বিতর্কিত।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার ঘোষণা দিয়েছিলেন সার্বজনীন বাংলা ভাষার চর্চাকে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি জানতেন এই লড়াকু জাতির গর্ব করার বড় বিষয় হচ্ছে নিজস্ব ভাষা। এই ভাষাই নিশ্চিত করেছিলো স্বাধিকারের দাবিকে। তাইতো তিনি প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে আদালত পর্যায় পর্যন্ত সবজায়গাতেই বাংলাকে প্রাধান্য দেয়ার উপর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ১৯৭৫ সালে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বপ্নের বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয়ার চক্রান্ত করা হয়েছিলো।

১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পর ২০০০ সালে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ২০১০ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে চালু হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট যার লক্ষ্য ছিলো পৃথিবীর সব ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া। বিভিন্ন ভাষার উপাদান ডাটাবেজে সংরক্ষিত হবে, বিলুপ্তপ্রায় বা বিলুপ্ত ভাষাগুলোকে দৃশ্যমান করা হবে। থাকবে বিশ্বমানের পাঠাগার, যাতে থাকবে বিভিন্ন ভাষার উপর লিখিত বই, ব্যাকরণ থাকবে।

এছাড়াও থাকবে ভাষা-জাদুঘর ও আর্কাইভ। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের মধ্যে থাকবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ দোভাষী তৈরি করা, ভাষানীতি প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা ও পরামর্শ দান, বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষার ওপর গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা ইত্যাদি। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করারও উদ্যোগ নেয়া হবে। সর্বোপরি মাতৃভাষার চর্চা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও সুরক্ষা প্রদান করা হবে। প্রতিষ্ঠার অনেক বছর পার হলেও এর কর্মসূচির কয়টি অর্জিত হয়েছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। এভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে অবহেলিত অবস্থাতেই আছে আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা।

গ্লোবালাইজেশনের যুগে আমরা চাইলেই অন্যান্য ভাষার প্রসারকে উপেক্ষা করতে পারবো না। যেটি হওয়া উচিত ছিলো নিজ ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষার বিস্তার সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে বিদেশি ভাষার প্রসার ঘটেছে যথেষ্ট কিন্তু বাংলা গেছে পিছিয়ে। কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষার প্রচলন কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসে ভারতীয় হাই কমিশনারের বক্তব্যটি এখন যদি রেফারেন্স হিসেবে দেয়া হয় তাহলে খুব বেশি বাড়াবাড়ি হবে বলে মনে হয় না। তিনি বলেছেন এদেশে হিন্দি ভাষার ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল। কারণ এখানকার লোকেরা হিন্দি যথেষ্ট ভালো বুঝতে ও বলতে পারে। কথা পুরোটাই মিথ্যা নয়। আমরা যখনই ভারতীয় কাউকে দেখি বা কথা বলতে যাই তখনই "আমিও হিন্দি জানি" সেটা প্রমাণের এক প্রাণান্ত চেষ্টা থাকে।

এসব কিছুই জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্যতাকেই প্রকাশ করে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের এই ইতিহাসকে সমর্থন করে না। সালাম বরকত জব্বারের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই ভাষাকে অপমান মানে তাদের রক্তের সাথে বেঈমানি করা।

বাংলা নিয়ে আলোচনা, তর্ক, বিতর্ক কেবল ফেব্রুয়ারি এলেই করবো আর বছরের অন্য সময় আমরা চুপ থাকবো এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাভাষার প্রচলন নিয়ে তর্ক চালাতে হবে সারা বছর ধরে। ঘরে বাইরে সব জায়গায় জোড় দিতে হবে শুদ্ধভাবে বাংলাকে আয়ত্ত্বের ওপর। নাটক, সিনেমায় আজকাল যে বিকৃত বাংলা বলার প্রচলন হয়েছে কথা বলতে হবে তার বিরুদ্ধেও। যেখানেই বিকৃতি সেখানেই প্রতিরোধ করতে হবে।

বাংলা ভাষা আমার অস্তিত্ব, আমার পরিচয়। এই পরিচয়কে নষ্ট করে দেয়া মানে আত্মপরিচয়কে বিকৃত করা। ভুলভাল ইংরেজি বলতে পারাকে গর্ব নয়, শুদ্ধ বাংলা বলাকেই যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পরিবার থেকে প্রশাসন- সবজায়গাতেই চালু করতে হবে শুদ্ধ ও পরিশীলিত বাংলা ভাষার। বাংলা নিয়ে গবেষণার উপর আরো বেশি করে জোর দিতে হবে। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করতে হবে বাংলা একাডেমির মত ভাষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

লেখক : কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/আরআইপি