ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আসাদের রক্তমাখা শার্ট

মিয়াজান কবীর | প্রকাশিত: ০৫:৩২ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০১৮

আসাদ একটি নাম। একটি সংগ্রাম। একটি অধ্যায়। একটি রক্তাক্ত ইতিহাস।

ইতিহাসের এ সংগ্রামী পুরুষ আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার সবুজ শ্যামলিমায় ভরপুর ধানুয়া গ্রামে ১৯৪২ সালের ১০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৌলভী মোহাম্মদ আবু তাহের, মায়ের নাম মতিজাহান খাদিজা খাতুন।

আসাদের বাবা-মা দুজনই ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং শিক্ষানুরাগী। তাদের স্নেহ-মমতায় বেড়ে ওঠেন আসাদ। ছয় ভাই-দুই বোনের মধ্যে আসাদ ছিলেন চতুর্থ। দেখতে ছিলেন ফর্সা, সুন্দর সুঠাম দেহের অধিকারী।

jagonews24আট ভাইবোনের সঙ্গে আসাদের ছবি

আসাদ ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিলেন মনোযোগী। ১৯৬০ সালে শিবপুর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে ইতিহাসে অনার্স এবং ১৯৬৭ সালে একই বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। সে বছরেই তিনি সিটি ল’ কলেজে ভর্তি হন।

আসাদ ছাত্র জীবনেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অত্যন্ত মেধাবী এ ছাত্রনেতার অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার দরুণ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা হল শাখার সভাপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত হন।

১৯৬৭ সালে এম এ পাশ করার পর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নির্দেশেই আসাদ নিজ গ্রাম ধানুয়ায় চলে যান। সেখানে গিয়ে নরসিংদী অঞ্চলে ‘কৃষক সমিতি’ গড়ে তুলেন। অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার বলে আসাদ কৃষক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে বিশাল সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হন।

১৯৬৮ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী হাট-বাজারে হরতাল আহ্বান করলে শিবপুর-মনোহরদী অঞ্চলে আসাদ হরতালের দায়িত্ব পালন করেন। এ হাট-বাজার হরতালের উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের কাছ থেকে ইজারাদারদের অতিরিক্ত খাজনার আদায়ের বিরুদ্ধে এবং সেই সঙ্গে আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করার দৃপ্ত শপথ। সেদিন হাতিরদিয়া বাজারে হরতাল চলাকালে পুলিশ বাধার সৃষ্টি করে। দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এক পর্যায় পুলিশ গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলে নিহত হন তিনজন কৃষক। আসাদসহ আরও অনেকে আহত হন।

আসাদ আহত অবস্থায় ঢাকায় চলে আসেন এবং পত্রিকা অফিসে গিয়ে হাতিরদিয়া বাজারের ঘটনার বিবরণ দেন। পরের দিন জাতীয় পত্র-পত্রিকায় শিরোনাম হয় হাতিরদিয়া বাজারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।

jagonews24সেময় হাতিরদিয়া বাজার নিয়ে পত্র-পত্রিকা সংবাদ শিরোনাম

হাতিরদিয়া বাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরে জনমনে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের বহ্নিশিখা।

সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এগার দফার ভিত্তিতে তীব্র গতিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। আন্দোলনের তীব্রতায় বেসামাল হয়ে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার ছাত্র-জনতার ওপর শুরু করে নির্যাতন।

১৯৬৯ সালের ২০ শে জানুয়ারি সংগ্রামী ছাত্রবৃন্দ পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে ধর্মঘট, মিছিল ও প্রতিবাদী সভা আহ্বান করে। ছাত্র-ছাত্রী সমবেত হয়ে এবং বিশাল মিছিল বের করে। মিছিল নিয়ে চানখাঁর পুলের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশের সঙ্গে বাধে সংঘর্ষ। বাহাউদ্দিন নামে জনৈক এক পুলিশ অফিসারের পিস্তলের গুলিতে বিদীর্ণ হয় আসাদের বক্ষ। গুলিবিদ্ধ হয়ে আসাদ সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। আসাদের তাজাবুকের লাল রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার শ্যামল মাটি।

jagonews24আসাদ গুলিবিদ্ধ হলে তাৎক্ষণিক মিছিল

আসাদের মৃত্যুর পরদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। এবং পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল গায়েবানা জানাজা। জানাজা শেষে লাখ লাখ মানুষ খালি পায়ে মৌন মিছিল বের করে এবং রাজপথ প্রদক্ষিণ করে।

jagonews24

jagonews24পত্র-পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম

আসাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা বাংলায় দাবানল জ্বলে ওঠে। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আসাদ হত্যার প্রতিবাদে ২২ ও ২৩ জানুয়ারি ‘শোক দিবস’ এবং ২৪ জানুয়ারি ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সে কর্মসূচি মোতাবেক সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয় এবং কালো ব্যাচ ধারণ করে ছাত্র-জনতা মশাল মিছিল বের করে। ২৪ তারিখে সারা দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। কর্মসূচির শেষ দিনটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়।

আসাদের মৃত্যুর পর মাত্র দুমাসের মধ্যে সৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের একনায়কত্ব শাসনের অবসান ঘটে। আইয়ুবশাহী পতনের প্রতীক হিসেবে ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইয়ুবের নাম ফলক নামিয়ে আসাদের নাম সংযোজন করে। এভাবে ঢাকার ‘আইয়ুব গেট’ থেকে ‘আসাদ গেট’ নামে রূপান্তরিত হয়।

আসাদ গেটে উনসত্তর গণ-আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়েছে শিল্পীর নান্দনিক টেরাকোটায়। সেই সঙ্গে শিল্পী এহসানুল আহসান খান মিঠুর শৈল্পিক রূপরেখায় প্রতীকী বন্দি খাঁচা থেকে মুক্ত হয়ে ডানা মেলেছে বলাকারা।

আসাদ ছিলেন একজন ছাত্রনেতা। একজন আদর্শবান সংগঠক। একজন নিবেদিত দেশপ্রেমিক। সেই দেশ প্রেমিক শহীদ আসাদের স্মৃতিকে ধরে রাখার লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ’।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথানের শহীদ আসাদের রক্ত সিঁড়ি বেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেই গণঅভ্যুথানের নায়ক শহীদ আসাদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। শহীদ আসাদ আত্মত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। সেই আত্মত্যাগের মহিমায় অনুপ্রাণিত শিক্ষার্থীরা।

শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার পাশাপাশি স্কাউটিং, শরীর চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। শহীদ আসাদের আত্মত্যাগের ঘটনায় গর্বিত এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

আসাদ চেয়েছিলেন শোষণহীন একটি মুক্ত সমাজ। সেই লক্ষ্যে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন। দেশের জন্য নিজের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীনতার পথ রচনা করেছিলেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় উনসত্তর একটি মাইলফলক। স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে শোষিত বঞ্চিত দেশকে মুক্ত করতে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুথান যে ভূমিকা রেখেছিল, জাতির জীবনে তা অবিস্মরণীয়।

jagonews24আসাদের শার্ট

ঊনসত্তরের সিঁড়ি বেয়েইতো মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ হয়েছিল। অর্জিত হয়েছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এ সংগ্রামী বীর পুরুষ চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছে তার জন্মভূমি ধানুয়া গ্রামের নরম মাটির বুকে বকুলের তরু বীথির ছায়ায়। শহীদ আসাদ যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন সংগ্রামে-মিছিলে, স্বাধীনতার রূপরেখায়, শিল্পীর ক্যানভাসে, বইয়ের প্রচ্ছদে, খবরের শিরোনামে, পোস্টার, ফেস্টুনে, প্রিয়জনের চিঠির পাতায়, কবির কবিতায়।

লেখক : গবেষক।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন