ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্যাডম্যান

রাকিব খান | প্রকাশিত: ১০:১৭ এএম, ০৫ জানুয়ারি ২০১৮

প্যাডম্যান যে স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান বা সুপারম্যানের মতো কোন কাল্পনিক সুপার হিরো নয় গণমাধ্যমের কল্যাণে তা কমবেশি আমরা জেনেছি। বাস্তবের এক 'হিরো'কে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে বলিউড। আর এই তারকা হলেন ভারতের অরুনাচালাম মুরুগানানথাম। কিন্তু কেন এই মানুষটিকে নিয়ে এতো হইচই? গভীরভাবে জানতে আমি ডুব দিই ভার্চুয়াল জগতে। এরপর যত সময় কেটেছে প্যাডম্যানকে নিয়ে আমার মুগ্ধতা তত বেড়েছে।

অরুনাচালাম মুরুগানানথাম'র দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডুর বাসিন্দা। ২৬ বছর বয়সে পরিবারের পছন্দে শান্তি নামের এক তরুণীকে বিয়ে করেন। এর কিছুদিন পরে তিনি লক্ষ্য করলেন, তাঁর স্ত্রী ঋতুকালীন সময়ে অনিরাপদ পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে অরুনাচালমকে। কিন্তু দাম বেশির কারণে শান্তির পরিবারের মতো তিনিও স্ত্রীর জন্য প্যাড বা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে ব্যর্থ হয়। পরে নিজেই প্যাড তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।

ব্যবহারের পর অরুনাচালামের ঘরে তৈরি করা প্যাডের বাজে রিভিউ দেন শান্তি। এতে নিরাশ হননি তিনি। বরং কম খরচে আরামদায়ক প্যাড তৈরির নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। চলতে থাকে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর প্রতিবারই গিনিপিক হচ্ছিলেন শান্তি। একপর্যায়ে প্যাড যাচাইয়ের জন্য তিনি অন্য মেয়েদের খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন ১৯৯৮ সাল। গ্রামের মানুষ এতে সাড়া দেবে না ভেবে তিনি মেডিকেল কলেজে ছুটে যান। কিছু ছাত্রী তাঁর প্যাড যাচাই করতে সম্মত হয়। কিন্তু ব্যবহারের পর নানা কারণে তাদের কেউই রিভিউ দেয়নি। শেষমেষ অরুনাচালাম সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই প্যাড পরে টেস্ট করবেন!

প্যাড পরে চলাফেরা করার এক পর্যায়ে আশপাশের মানুষ ব্যাপারটা বুঝে ফেলে। তখন সবাই তাকে নিয়ে মজা করতে থাকে। এসব সহ্য করতে না পেরে শান্তি তাকে ছেড়ে চলে যান। দূরত্ব তৈরি করেন নিকট স্বজনেরাও। নানা কষ্টের মধ্যেও বাকিটা পথ অরুনাচালাম একাই হেঁটেছেন। হাল ছেড়ে না দেয়ার মানসিকতা একদিন সাফল্য হিসাবে ধরা দেয়। এক পর্যায়ে তিনি সাশ্রয়ী দামে গুণগত মানের প্যাড তৈরির ডিভাইস বা যন্ত্র তৈরিতে সাফল্য পান। তাঁর এই উদ্ভাবন 'বেস্ট ইনোভেশন ফর দ্যা বেটারমেন্ট অব সোসাইটি'র স্বীকৃতি পায়। মানবতার কল্যাণে প্যাড তৈরির যন্ত্রটি অরুনাচালাম ভারতের প্রত্যন্ত জনপদে ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর উদ্দেশ্য হলো স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারকারীর সংখ্যা শতভাগ বৃদ্ধি করা। সেই সঙ্গে প্যাড তৈরির মাধ্যমে নারীর আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করে দেয়া।

পাঠক, অরুনাচালামকে নিয়ে এতো কিছু বলার কারণ হচ্ছে- প্রথমত তিনি মাসিক নিয়ে প্রচলিত ট্যাবু ভাঙতে ভূমিকা রেখেছেন, মেয়েদের প্যাড ব্যবহারে উৎসাহী করেছেন, সাশ্রয়ী দামে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করেছেন এবং স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার একটা সুযোগও তৈরি করে দিয়েছেন। অর্থাৎ যে দায়িত্বগুলো রাষ্ট্রের পালন করার কথা ছিল ব্যক্তি উদ্যোগে তার পালে হাওয়া জুগিয়েছে মানুষটি। এ কাজে বোনাস হিসাবে তিনি সামাজিক স্বীকৃতি ও খ্যাতি পেয়েছেন।

ঋতুস্রাব বা মাসিক হাতের নখ বৃদ্ধির মতোই একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। অথচ বিষয়টি আমাদের সমাজে যেন অচ্ছুত। একটি জাতীয় দৈনিক বলছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৮ মিলিয়ন বা ৮০ লাখ নারী এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। যাদের বেশিরভাগই প্রত্যন্ত জনপদের মানুষ আর পোশাক কর্মী। অজ্ঞতা আর লজ্জায় তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এই সময়টা পার করে। চিকিৎসকরা বলছেন, পিরিয়ডের সময় অপরিষ্কার পুরনো কাপড় ব্যবহার করলে জ্বর, তলপেটে ব্যথা ও মূত্রনালীতে সংক্রমণ হতে পারে৷ এছাড়া ইনফেকশন হতে পারে জরায়ুতে। দীর্ঘমেয়াদী এই সংক্রমণ থেকে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বাস্তবতা হলো এখন প্রায়ই এ ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর আশপাশ থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। আর যে মানুষটি এ ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে তার পরিবার যে নানা দিক থেকে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

মেয়েদের পিরিয়ডকালীন সময় নিরাপদ করার অভিযানটা শুরু হতে পারে নিজ নিজ ঘর থেকেই। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার। সন্তানের সঙ্গে আড্ডায় এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হতে পারে। ঘরোয়া বৈঠকে বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন বিষয়ে ছেলে-মেয়েকে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। গোড়াতেই এসব কথা শেয়ার করা না হলে কিশোর-কিশোরীর মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। না বুঝে ভুলও করে বসতে পারেন অনেকে। আমার মতো যারা পরিবার থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ বঞ্চিত হয়েছেন তাদের অতীত স্মৃতি যে সুখকর নয় তা সহজেই অনুমেয়।

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের যৌন ও প্রজনন সেবা দেয়ার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্র তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে চলমান নানা প্রকল্পের পরিধি বাড়াতে হবে। প্রত্যন্ত জনপদে সহজলভ্য করতে হবে স্যানেটারি ন্যাপকিন। মেয়েদের বিনামূল্যে প্যাডও দেয়া যেতে পারে। কেননা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রিরিপ্রডাকটিভ বা বয়ঃসন্ধিকালে যদি মেয়েদের যথাযথ সেবা দেয়া যায় তাহলে রিপ্রডাকটিভ বা প্রজননকালে এবং পোস্টরিপ্রডাকটিভ বা প্রজনন পরবর্তি সময়ে নারীরা যে ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভোগেন তা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। অর্থাৎ দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর পেছনে চিকিৎসা খাতে রাষ্ট্রের যে খরচ হয় তা কমে আসতে পারে যদি শুরুতেই কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যায়।

এক সময় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দিতে দেখা গেছে। বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে কনডম, পিলসহ নানা উপকরণ বা পথ্য। কিন্তু এখন মাঠে স্বাস্থ্য কর্মীদের তেমন তৎপরতা নেই। উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক সংকট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। নানা অজুহাতে শহরমুখি চিকিৎসকরা। অবস্থা এতো খারাপ যে কোথাও কোথাও ডাক্তারের অনুপস্থিতি বা ঘাটতিতে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন ফার্মাসিস্ট-ওয়ার্ড বয়রা। এই শোচনীয় অবস্থায় ঋতুকালীন বা বয়ঃসন্ধিকালীন সেবা তৃণমূলে কতটুকু মিলছে তা সহজেই অনুমেয়।

চিকিৎসকরা কেন গ্রামে থাকতে চান না তা কমবেশি সবার জানা। কিন্তু এর প্রেক্ষিতে তাদের কর্ম পরিবেশ উন্নত করার তেমন উদ্যোগ নেই। যদিও গ্রামে থাকতে বিভিন্ন মহল থেকে তাদের চাপ প্রয়োগ অব্যাহত আছে। এই চাপ বা বল প্রয়োগ প্রক্রিয়ায় খুব যে লাভ হচ্ছে না তা তো প্রমাণিত। তাই তৃণমূলে কর্মরত ডাক্তারদের সমস্যা সমাধানেও ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রামে অবস্থানকালীন সময়ে চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার বিষয়টি আমলে নেয়া যেতে পারে।

মাঠ পর্যায়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দিতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও কাজ করছে। এক্ষেত্রে তাদের প্রতিবন্ধকতা দূর করার পাশাপাশি কাজের গতি আনতে নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে। সেই সঙ্গে এনজিওগুলোর মধ্যে সমন্বয় রাখা দরকার। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, সবাই আলাদাভাবে কাজ না করে একসঙ্গে পরিকল্পনা করে এগুলে নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং ঋতুস্রাবের সময়ে করণীয় বিষয়ে তথ্য দেয়া সহজ হবে। পিরিয়ড নিয়ে সমাজের অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা ভাঙতে গবেষণা বাড়ানোও প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

প্রতিবছর ২৮ মে ‘মিন্সট্রেশন হাইজিন ডে’ পালিত হচ্ছে। দিবসটির কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সীমিত না রেখে বিভিন্ন ফোরামে বছরজুড়েই এ নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, মিন্সট্রেশন বা ঋতুস্রাবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রজন্মের বিস্তার হচ্ছে। এই বিষয় নিয়ে প্রতিবন্ধকতা বৈষম্য তৈরি করছে। এক্ষেত্রে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতিবন্ধী নারীরা। তাদের পরামর্শ হচ্ছে, যারা দামের কারণে স্যানেটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারছেন না তারা কাপড় ব্যবহার করতে পারেন৷ সেক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য নেয়া কাপড়টি অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে৷ তারপর ব্যবহারের পর সেটি সাবান ও গরম পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে৷ এরপর ইস্ত্রি করে কাপড়টি জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে৷ এছাড়া কয়েকবার ব্যবহারের পর কাপড়টি ফেলে দিতে হবে৷ নইলে ইনফেকশনের আশঙ্কা থাকবে৷

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/আইআই