এভাবেও তো ভাবা যায়
সালতামামি। গণমাধ্যমের খবর ঘরে খুব পরিচিত শব্দ। বছর শেষ হওয়ার আগে আগে শুরু হয়, রেশ থাকে বছর শুরুর পরেও সপ্তাহখানেক। এখানে বছর জুড়ে কী কী খবর আলোচিত হয়েছিল, সেগুলো দর্শক বা পাঠকদের একবার মনে করিয়ে দেয়া আর কী। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেই আলোচিত ঘটনাটি এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে, সেটা চিহ্নিত করা হয়।
এবারো ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিদিন সালতামামি দেখছি, পড়ছি। কাজও কারছি কোন কোন ক্ষেত্রে। একেক খাতের একেক ধরনের সালতামামি। প্রতিটিতেই, পেছনের বিপদ আপদ দুর্ঘটনার খবরই বেশি। সাফল্য বা ইতিবাচক আলোচনা যে নেই, তা নয়। কিন্তু তুলনা করতে চাইলে, খারাপ খবরকে পাহাড় আর ভাল খবরকে উই ঢিবি বলার সেই পুরোনো উদাহরণে যেতে হবে। এটা যে গণমাধ্যমগুলো ইচ্ছে করছে তা নয়। আসলে আমাদের চারপাশে ঘটনাগুলো ভাল নয়। ভাল খবর পাবে কোত্থেকে সাংবাদিক?
খারাপ খবরগুলো চমকে দেয়ার মত। একটির চেয়ে আরেকটি ভয়াবহ। পেশাগতভাবে যদি না দেখি, তাহলে ব্যক্তি আমিই তো, এঘটনাগুলো মনে করতে চাই না। অন্যদের মনে করিয়ে দিতে চাওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। একবার এক জ্যেষ্ঠকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বছর শেষে এইসব ভয়ঙ্কর খবর মানুষকে মনে করিয়ে দেয়ার দরকার কী? ভদ্রলোক, একটু শান্ত গোছের, যে কারণে ধমক না দিয়ে বলেছিলেন, এটা তো এক ধরনের ফলোআপ। তাছাড়া খারাপ খবরগুলো আবার প্রচার হলে, দোষীদের ব্যাপারে মানুষ আরো সাবধান হয়। গণমাধ্যম কর্মীদের পেশার সঙ্গে দেশের ভালমন্দ দেখার বিষয়টি সরাসরি জড়িত।
কিন্তু আমি তখন ভাবছিলাম অন্যকথা। বিষয়টি দেখছিলাম আম জনতার সারিতে দাঁড়িয়ে। পাঠক, আপনিও দেখুন, প্রতিটি খবর গল্পে সাধারণত দু’টি পক্ষ। একটি শোষক অন্যটি শোষিত। একদল মারছে, অন্যদল দিনের পর দিন মার খাচ্ছে। কিন্তু এটাই কী শেষ কথা? একবার মনে হয়েছিল, ওই জ্যেষ্ঠকে প্রশ্ন করি, কোন নির্যাতনের ঘটনায় নির্যাতিতের কী কোন দায় নেই? এমন কোন উপায় কী নেই, যা দেখে অত্যাচার করার আগেই অত্যাচারী দমে যায়? কিন্তু সাহস পাইনি।
এবারো সালতামামির তালে পড়ে মাথায় ঘুরছে বিষয়গুলো। বার বার মনে হচ্ছে, নির্যাতিত মানুষ বিচারের জন্যে অপেক্ষা করে। এই অপেক্ষা করতে করতেই আবার বিপদে পড়ে। কিন্তু আগের বিপদের অভিজ্ঞতা থেকে যদি তিনি তাঁর নিজের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে পারেন, তাহলে তো কিছুটা শক্তি পেতেন।
ধরা যাক
গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়, দেশে লাখে লাখে রোহিঙ্গা আসা। রোহিঙ্গারা অত্যাচারিত সন্দেহ নেই। আমাদের খবরগুলোও তাই। আমার প্রশ্ন, দলে দলে না পালিয়ে, দল বেঁধে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কী তারা রুখে দাঁড়াতে পারতো না? নির্যাতন হলেই কী পাশের দেশে দৌড় দিতে হবে? যেখানে ২২ লাখ মানুষের অধিকারের প্রশ্ন, সেখানে কেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হতে হবে? ৮শ বছরের একটি পুরোনো জাতি, তবু কেন ৯৮ভাগ মানুষই নিরক্ষর? এত দিনেও কেন এমন একজন নেতার কথা আমরা বলতে পারি না, যার নাম শুনলেই বঞ্চিত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠির কথা মনে করবে বিশ্ববাসী ?
জঙ্গিবাদের উত্থানের বিষয়টিও আলোচিত। আমার তো মনে হয়, এতে যে সমাজে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়, সেই সমাজবাসীদেরও দায় কম না। বার বার যেসব জঙ্গি আস্তানা পাওয়া যাচ্ছে সেখানকার কথাই ধরুন না। সেই একই অপরিচিত অল্প বয়স্ক ভাড়াটে, তবু বাড়ি ওয়ালা কাগজ পত্র ছাড়াই বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন। এত পরিচিত কার্যক্রম তবু এলাকার কারো সন্দেহ ছাড়াই ঘরে বসেই বোমা বানাতে পারছে তারা।আর আমাদের রাষ্ট্র কী করছে? জঙ্গিদের ভয়ে মাথায় থাবড়া দিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে মানুষের উচ্ছ্বাস। হামলার ভয়ে, কেটে ছোট করছে মুক্ত বুদ্ধি চর্চার অনুষ্ঠানগুলো। জঙ্গিবাদীরা তো এটাই চেয়েছিল।
লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের কথা বলা হয়। তারপরেও বাজারে কোন পণ্য পড়ে থাকে না। বরং দেখা যে পণ্যের দাম যত আলোচিত সেই পণ্যের চাহিদা তত বেশি। অথচ খুব খোলা চোখেই দেখলেও বোঝা যায়, পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে চাতুরি রয়েছে। যিনি উৎপাদক তিনিও ঠিক দামটি পাননি। আবার ভোক্তাও বেশি দাম দিয়ে পণ্যটি কিনছেন। বছরের পর বছর এই অত্যাচার চলছে অথচ উৎপাদকও শক্তকরে কিছু বলছেন না আবার ভোক্তাও নির্বিকার। আর মজুদদার বলছে আহা কী আনন্দ, কী আনন্দ।
পাঠক লক্ষ্য করেন, এত যে পরিবহন দুর্ঘটনা এবং যানজট এর পেছনেও কী যাত্রীদের দায় কম? হাজার চেষ্টা করেও টিকেট বিক্রির বিষয়টি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায় নি। এর প্রধান কারণ দেখা যায় কালো বাজারে টিকেট বিক্রি। চোর তো চুরি করবেই, আমি তো চোর না, তাহলে আমি কেন চোরা বাজার থেকে টিকেট কিনবো? কিন্তু এই আমরাই কেউ না কেউ কালো বাজার থেকে টিকেট কিনছি। এই আমরাই ২শ যাত্রীর লঞ্চে উঠছি ৬শ জন। যে কারণে চোর চক্র ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। বেশিরভাগ রাস্তার দুই পাশ দখল করে রাখে আমাদেরই কোন গাড়িধারী বা ব্যবসায়ী। যে কারণে প্রতিটি নগরে যানজট স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে।
বাচ্চাদের স্কুলের ভর্তি যুদ্ধ, হাসপাতালে অনিয়মসহ যত রকম সামাজিক অত্যাচার, তার সবই আমরা মেনে নিচ্ছি বলেই হচ্ছে। ঘুষ দেই বলেই কর্মকর্তারা ঘুষ খান। আজ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া গেলো না, যে আমরা চোরা পথে হাঁটবো না। টাকা দিয়ে শিশুদের স্কুলে ভর্তি করবো না। অথবা হাসপাতালের বেড পেতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে টাকা দেবো না। এই প্রান্ত থেকে বন্ধ করে দিলেই বন্ধ হয়। কিন্তু সেটা তো হয়ই না, উল্টো আমরা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই গল্প করি, কত দিতে হলো একটি স্বাভাবিক কাজ করতে। যেন এটাই নিয়ম।
অনিয়মগুলো সহ্য হয়ে গেছে বলেই, নিত্য নতুন অনিয়ম আসছে আমাদের সামনে। মুক্তিযোদ্ধাকে পিটিয়ে হত্যা করছে, প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মাসহ দুই মেয়ের ঘরে আগুন দিচ্ছে। তারা যেন বের হতে না পারে, সে জন্যে শিকল তুলে দিচ্ছে বাইরে থেকে। মায়ের পরকীয়ায় খুন হচ্ছে শিশু। খোদ মাই হত্যা করছে শিশু সন্তানকে। আর সন্তানের হাতে বাবা মায়ের মৃত্যু তো জলভাত হয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন ভয়ে থাকি, কাল নতুন কোন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে অপরাধে।
শুরু করেছিলাম গণমাধ্যমের সালতামামি দিয়ে। এই সালতামামির প্রতিবেদনে খুব কম হলেও থাকে, কোন খাতের আগামী দিনের আশা কী। এই লেখাটিও ওই রকম একটি ক্ষীণ আশা নিয়েই লিখলাম। যে কোন অনিয়মের জন্যে কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করা তো সহজ। কর্তৃপক্ষ কর্তৃপক্ষের কাজ করবে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে পারবে না, তা তো আমরা বুঝতেই পারি। যাদের জন্যে করবে, তাদের যদি সহায়তা থাকে তাহলে কোন কোন ক্ষেত্রে কাজটি সহজ হবে। এত ঘাত প্রতিঘাতের পর আমাদের এখন বোঝাই উচিত যে, সুশাসন আকাশ থেকে পড়বে না। সবার সমান অংশগ্রহণে এটা সৃষ্টি হতে হবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
[email protected]
এইচআর/আইআই