ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আমাদের পাড়ায় কতিপয় হিজড়া

প্রকাশিত: ০৪:২৮ এএম, ০৫ জুলাই ২০১৫

আপনি নিশ্চয়ই মানবেন যে, বউরা মাঝে মাঝে বেড়ালের মতো হয়। অযথা মিউ মিউ করে। এমনি একটি মিউ শোনার জন্য ফোন ধরেছিলাম। ফোনের অপরপ্রান্তে পেলাম ভীত, নার্ভাস এক মানুষকে। বললো, হিজড়া এসেছিল। দুই হাজার টাকা দিয়েছি। তারপরো যেতে চায় না, বলে তিন হাজার দে। ঘরে না থাকলে ম্যানেজ করে এনে দে। ঘরে আমাদের নগদ টাকা থাকে না। ছোট একটা বাচ্চা আছে আমাদের, হঠাৎ দরকার লাগতে পারে ভেবে দুই আড়াই হাজার টাকা হাতের কাছে রাখা। বাচ্চা দেখেই হাততালি, আনন্দে উদ্বেল দুই বৃহন্নলা। বেবি, বে বি ইইই…

নিমিষে ঈদের বখশিশ চাহিদা বেড়ে অনেকগুণ। তোদের বাচ্চা হয়েছে, সংসার করছ, আমাদের কিছু নাই দে ট্যাকা দে। তোদের টাকা আছে আমাদের নাই। দে।  দাবি পূরণ না হলে নট নড়ন চড়ন। সে এক ভীতিকর অবস্থা। টাকা না দিলে বদ দোয়া দেওয়ার হুমকি। সেই শাপ শাপান্ত কাজে লাগুক আর না ই লাগুক মায়ের মন সন্তানের জন্য কোনো শাপ শুনতে প্রস্তুত নয়। ঘরে যা আছে তা দিয়েই বাঁচতে মরিয়া বউ। টাকা গেছে, যাক, মেয়ের জন্য দোয়া পাওয়া গেলো।

একই দৃশ্য আমাদের পাড়ার প্রায় সব ভবনের । সবখানেই তারা গেছেন। জোর খাটিয়েছেন। দারোয়ানকে পিটিয়েছেন। জানালায় আঘাত করেছেন। মানুষকে সন্ত্রস্ত করেছেন। সবার অভিযোগ তারা জোর করে টাকা নিয়েছেন। নিজেদেরকে ভীতিকর একটা মহল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটা না জেনেই যে, ভালোবাসা এবং ভীতি একসঙ্গে বাস করতে পারে না।

এলাকার লোকজন জানালেন, সংখ্যায় তারা আটজন ছিলেন। বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে এলজিবিটির শেষ অক্ষর মানে ট্রান্সজেন্ডার বা হিজরার সংখ্যা মাত্র দশ হাজার। অথচ অনুমান করা হয় এই সংখ্যা লাখের অধিক। হিজড়া একটা শারীরিক বিশেষ অবস্থা। না পুরুষ না নারী, কিংবা একসঙ্গে দুটো। তবে বাংলাদেশে পুরোপরি পুরুষ হয়েও বিশেষ মানসিক অবস্থায় অনেকে হিজেকে হিজরায় রূপান্তরিত করেন। এর প্রমাণ সাম্প্রতিক এক ক্যারিওটাইপিং পরীক্ষায় মেলে। চাকুরিতে নিয়োগের শর্ত হিসেবে অংশ নেওয়া পরীক্ষায় দেখা যায় ১৪ জন প্রার্থীর ১২ জনই পুরুষ। পরীক্ষা যা ই বলুক না কেন বাস্তবতা একটাই। তারা নিজেদের হিজড়া মনে করে। হয়তো মনে করে নারী। যা সে নয়। নারী ও পুরুষের বাইরে তৃতীয় এই লিঙ্গ নতুন কিছু নয়।

পৃথিবীর সামনে চলার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে হিজড়াদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় খুন হওয়া লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের লেখা থেকে একটু ধার করি। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, মানবসমাজেও উভলিঙ্গত্ব বিরল নয়। প্রাচীন গ্রিসে সমকামিতা, প্রাচীন রোমে খোজা প্রহরী (Eunuch), নেটিভ ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ‘দ্বৈত-সত্তা’ (Two-Spirits), আরব ও পার্সিয়ায় ‘বার্দাশ’ এবং ভারতবর্ষে ‘হিজড়া’দের অস্তিত্ব সেই সাক্ষ্যই দেয়। এ ছাড়া আছে ভারতের কোতি, ওমানের জানিথ, ইন্দোনেশিয়ার লুডরুক বান্টুট, মাসরি এবং রায়গ, মালয়েশিয়ায় আহকুয়া, বাপুক, পোনদান কিংবা নাকনিয়া।

তুরস্কে নসঙ্গা, মুস্তাক্নেৎ, আরবের মুখান্নাথুন, নেপালের মেটি, থাইল্যান্ডের কাথোই, চিনের তাংঝি, মালাগাসির তসিকাত্, মিশরের খাওয়াল, অ্যাঙ্গোলার চিবাদোস্, কেনিয়ার ওয়াসোগা, পর্তুগালের জিম্বাদা, পলিনেশিয়ার ফাফাফিনি, মেক্সিকোর জোতো/পুতো, ব্রাজিল এবং ইসরায়েলের ত্রাভেস্তি এবং ত্রান্সফরমিস্তাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে থাকা রূপান্তরকামী কিংবা উভলিঙ্গ সত্তা।

হিন্দুদের পুরাণে আমরা পেয়েছি ‘বৃহন্নলা’ কিংবা ‘শিখণ্ডী’র মতো চরিত্র। আছে হরি এবং শিবের (হর) মিলনের ফসল ‘আয়াপ্পা’। আনাতেলিয়া, গ্রিস এবং রোমার বিভিন্ন মন্দিরে ‘সিবিলি’ এবং ‘ডাইওনিসস’-এর পুজার কথা আমরা জানি। সিবিলির পুরোহিতেরা ‘গাল্লি’ নামে পরিচিত ছিলেন। এরা নারীবেশ ধারণ করতেন। মাথায় নারীর মতো দীর্ঘ কেশ রাখতে পছন্দ করতেন।

যা হোক,ভারত, নেপাল, পাকিস্তান এমনকী বাংলাদেশও  হিজড়াদের পৃথক লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ এই স্বীকৃতি দেয় ২০১৩ সালে। তাদের পুনর্বাসন ও  কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে  ট্রাফিক পুলিশ হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার সরকারি পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। এমনকী বাংলাদেশের তৃতীয় লিঙ্গের উদ্যোক্তাদের এসএমই খাতের আওতায় ঋণ দেওয়ার  নির্দেশ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে। তারপরো হিজড়াদের সামান্য একটা অংশের এমন ভয়ানক আচরণ, নানা কিছু ভাবতে বাধ্য করছে।

আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই শবনম মৌসি নামে একজন হিজড়া ভারতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বের শেরিল চেজ, এরিক শেনিগার, জিম সিনক্লায়ারের মতো ইন্টার-সেক্স সেলিব্রিটিদের কথা না ই বা বললাম। তারা নিজ পরিচয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। আমাদের সমাজে কেন হিজড়াদের চাঁদা আদায়, করুণ ভিক্ষা কিংবা সেক্স ট্রেডের মতো নাক সিটকানো কাজে নিজেদের জড়িয়ে রাখতে হয়? আমরা কী তা ভাবতে চাই? রাষ্ট্রীয়ভাবেই তা ভাবা উচিত। কারণ তারা এই রাষ্ট্রের নাগরিক। সমাজিকভাবে ভাবা উচিত, কারণ তারা এই সমাজের সন্তান। দুটে মানুষের ভালোবাসার চূড়ান্ত অনবদ্য ফলাফল। সৃষ্টির সেরা জীব- মানুষ।

ভয় পেলেও বউয়ের মন হিজড়াদের আর্থিক দুর্গতিতে ভেজা। যা পেলো তারা তা জমা দেবে নিজেদের গুরুমার কাছে। পাবে নিজেদের ভাগ। অথচ, সম্মানজনক একটা জীবন পাওয়ার অধিকার তারও আছে। সে, সব সুযোগ পায়নি বলে, মানুষের করুণা চায়। ভালোবাসা চায়, মেলে না, পাওয়ার মরিয়া আগ্রহের অনুবাদ হয় চাঁদাবাজি। আচরণ ভুল বুঝে অনেকে। একটু আলাদা হওয়ায় যে মনোযোগ হিজড়ারা পেতে পারতো তা পরিণত হয় ভয়ে। ভেবে দেখেন, সমাজের অপর দুই লিঙ্গে নারী ও পুরুষের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো যদি আদর ভালোবাসার মতো মানবিক আবেগ থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান, শিক্ষার অধিকার গুলো ঠিকঠাক পেতো, তারা আসতো আমাদের কাছে? বিশেষ করে বর্তমান রূপে? বিশ্বের যেসব দেশে তৃতীয় লিঙ্গের  মানুষেরা যথাযথ সুযোগ পায়, তারা বাস করে সম্মানজনক জীবনে। তাদের নিয়ে করুণ গল্প খুব একটা শোনা যায় না। যতটা শোনা যায়, আমাদের মতো দেশে।

শেষ কথা হলো, আমরা চাই, হিজড়ারা সমাজে বাঁচুক আর দশটা মানুষের মতো। খেয়ে, পরে।


 
এইচআর/এমএস