আমৃত্যু থাকুক ভাইদের সম্পর্ক
ধরুন, আপনাদের বাড়িটা ৪ কাঠা জমির ওপর তৈরি। বাবা তৈরি করেছিলেন। জমিটা আপনার বাবার নামেই ছিল। আপনার মা আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আপনারা দুই ভাই, কোন বোন নেই। জন্মের পর থেকেই দুই ভাই একসাথে বড় হয়েছেন, একসাথে আপনাদের মা হাতে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন, একসাথে স্কুলে গিয়েছেন, কলেজে গিয়েছেন। এখন কি এমন হল যে, বাবার সেই চার কাঠা জমি দুই কাঠা করে ভাগ করে নিয়ে দুইটা বাড়ি করে আলাদা থাকতে হচ্ছে, খেতে হচ্ছে?
কিংবা ধরুন, আপনার বাবার ২ বিঘা চাষাবাদের জমি আছে। আপনারা তিন ভাই আছেন সেই জমির অংশীদার। আপনারা সবাই শহরে থাকেন। গ্রামে কেউ নেই। আপনাদের জমি অন্যের কাছে বর্গা দিতে হয়। অথচ আপনারা একসাথে বর্গা না দিয়ে, যে যতটুকু জমি ভাগে পেয়েছেন, সে তার মত একেকজনকে জমি বর্গা দিয়ে দিচ্ছেন। আপনাদের জমি আইল দিয়ে আলাদা করে চাষ করা হচ্ছে। লেখাপড়া শিখে আপনার কত বিবেকবান হয়েছেন, সেটাই এখন সকলকে দেখিয়ে দিচ্ছেন।
পার্থিব সম্পত্তির কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে ভুল বোঝাবুঝি হবে, সেটাই মেনে নেওয়া যায় না। সেখানে মারামারি, খুন, জখমের বিষয়তো কল্পনাতেও আনা উচিত না। অথচ সেটাই এখন হচ্ছে। ভাইদের সমস্যা সমাধানে এলাকায় সালিশ বসাতে হয়। ভাইদের নিজেদের ভুলের বিচার করে গ্রামের মাতুব্বর কিংবা পাড়ার ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গ। কতটা বোকা হয়ে গিয়েছি আমরা? ভাইয়ে ভাইয়ে অমিল হবে কেন? সামান্য স্বার্থের কারণে এক ভাই অন্যজনের মুখ দেখা বন্ধ করে দেয়। মনে হয়, মৃত্যুর পর কবরে নিয়ে যাবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি। একটু মেনে নেওয়ার ইচ্ছা যদি প্রতিটা ভাইয়ের মধ্যে থাকত, তবে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত না। কিছু যদি বেশি পায়, তবে সেটাতো আপনার ভাই পেল। একটু মনে করার চেষ্টা করুন, ছোট থাকতে এক ভাই অন্যজনের গলা ধরে ঘুমিয়ে থাকতেন। তাহলে বড় হয়ে কেন পারছেন না, বুড়ো হয়ে কেন পারছেন না? সুখে দুঃখে সবচেয়ে কাছের বন্ধু কিন্তু আপনার ভাই। খুব ছোট থাকতে দেখতাম, যাদের সমসাময়িক দুই/তিন জন ভাই থাকত, তাদের সাথে পাড়ার কেউ মারামারি করতে যেত না। কারণ কোন একজনকে কেউ মারলে, বাকি সব ভাই মিলে সেই ছেলেটিকে মারত। তবে সেসব মারামারি মারাত্মক কিছু ছিল না।
এখন পাড়ার বখাটেদের ভয়ে অনেককে গুটিসুটি মেরে বসবাস করতে দেখা যায়। ঘরের মেয়েদের হেনস্তা হতে হয়। আপনারা ভাইয়েরা একসাথে বসবাস করুন। অবসরে রাস্তার মোড়ের উপর ভাইয়েরা একসাথে বসে আড্ডা দেন। আপনাদের ঘরের মেয়েদের দিকে কেউ আড় চোখে তাকানোর সাহস পাবে না। বাল্যশিক্ষার সেই গল্পটা আরকেবার মনে করুন। এক বিজ্ঞ পিতা অন্তিম শয্যায় ৩ ছেলেকে ডাকলেন। বললেন, সবাই একটি করে কঞ্চি নিয়ে আসবে। সন্তানরা তাই করল। এবারে ৩টি কঞ্চি এক সাথে করে বড় ছেলেকে ভাঙতে বললেন, সে পারলোনা। মেজো ছেলেকে একসাথে ভাঙতে বললেন সেও পারলোনা। ছোট ছেলেও পারলোনা। এখন ১টি করে কঞ্চি ভাঙতে বলার সাথে সাথেই যার যার মত ভেঙে ফেলতে সক্ষম হল। বিজ্ঞ পিতা বললেন, এভাবেই তোমরা ৩ ভাই এক থাকতে পারলে কেউ তোমাদের পরাজিত করতে পারবে না, কেউ ষড়যন্ত্র করতে পারবে না।
কয়েকদিন আগে অজ্ঞাতনামা একজনের ডায়রির কয়েকটা পৃষ্ঠা হাতে পেয়েছিলাম। সেখানে এক বড় ভাইয়ের তার ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে কিছু লেখা ছিল। হয়ত নিজের মনের কষ্ট কিছুটা কমানোর জন্যই সেই ভাই ডায়রিতে কথাগুলো লিখেছিল। সেই লেখাটার কিছু অংশ তুলে ধরছি। “স্নেহের সুমন, আম্মা মারা যাওয়ার পনের দিনের মধ্যে তুই সাথীকে আর রনিকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলি। তোরা চলে যাবার সময়তো একবারও আমার দিকে তাকালি না, অথচ ছোট ছোট দুটি চোখে রনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। একবার বড় আব্বু বলে ডাকও দিয়েছিল, কিন্তু সাথী তাড়াতাড়ি রনিকে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে এমন কি হয়েছিল বল তো, তুই আলাদা হয়ে গেলি?
আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দেই, তখন তুই ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলি। তোকে স্কুলে রেখে আমি কলেজে যেতাম। আব্বা নিয়ে আসত। যেদিন আমার ক্লাস থাকত না, সেদিন আমি তোর স্কুলের মাঠেই একা একা বসে থাকতাম। এরপর আমি অনার্সে ভর্তি হলে, আমার ক্লাসে তেমন যাওয়া লাগত না। তোকে সাইকেলে করে স্কুলে নিয়ে যেতাম। তোর কিছু লাগে কিনা, সেই চিন্তা করে বাসায় আসতেও ভালো লাগত না। একসাথে দুই ভাই বিকাল বেলা নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। তুই আইসক্রিম খেতে পছন্দ করতি। আমার টিউশনির টাকা দিয়ে যখন তোর জন্য কিছু কিনতাম, খুব আনন্দ হত। তোর খাওয়া আইসক্রিম আমাকে একটু খেতে দিতি। আমি ভাবতাম, তোর জন্য হলেও কখনো বিয়ে করব না। নিজের বলতে তুই ছাড়া আর কি ছিল আমার? সেই তুই চলে গেলি আমাকে ফেলে”।
ভাইয়ের চেয়ে কেউ আপন হয় না। সম্পর্ক সেই আট-দশ বছর বয়সে যেমন ছিল,ঠিক সেই রকম রাখেন সারাজীবন। এক ভাই অন্য ভাইয়ের কাছে কখনো বড় হবেন না। ছোটদের মত দুষ্টুমি করুন। ভাইদের মধ্যে কোন মধ্যস্থকারী থাকতে দেবেন না। একজন অন্যজনকে বকা দেবেন, রাগারাগি করবেন, আবার একসাথে খেতে বসবেন। ভাইয়েরা এক থাকলে, পৃথিবী হাতের মুঠোয় থাকবে। কেউ চোখ রাঙিয়ে কথা বলার সাহস পাবে না।
লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
[email protected]
এইচআর/আইআই