সুষমা স্বরাজের সফর- পরবর্তী রাজনীতির পর্যবেক্ষণ
সুষমা স্বরাজ এসেছিলেন এবং সেটা ইতোমধ্যেই পুরোনো খবর। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটি কোনোভাবেই কখনোই পুরোনো হতে পারে না, হবে না, নতুন নতুন তত্ত্ব, তথ্য এবং প্রপঞ্চ দু’টি দেশের মধ্যে সম্পর্ককে বার বার নতুন ও অভাবনীয় করে তোলে এবং ভবিষ্যতেও তুলবে। সে কারণেই এই সম্পর্কের বিভিন্ন দিক ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
জাগো নিউজের পাঠকের জন্য প্রায় মাসাধিক কাল লিখিনি। কিন্তু না লিখলেও সুষমা স্বরাজের সফর ও গত এক মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ দৃষ্টি এড়ায়নি। বিশেষ করে হঠাৎ করেই বেগম জিয়ার লন্ডন থেকে চিকিৎসা শেষ করে ঢাকায় ফিরে আসা এবং ফিরে এসেই সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করাসহ বহু ঘটনা নিয়েই পাঠকের সামনে আমার বলার মতো কথা রয়েছে। আজকে সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর এবং বেগম জিয়ার ফিরে আসা বিষয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রাখি।
দীর্ঘ তিন মাস বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে তার পুত্র তারেক জিয়ার সঙ্গে কাটিয়েছেন। ঢাকায় আমরা জানতে পারি যে, তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যদিও আমরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তার লন্ডন অবস্থানকালে যে একটিমাত্র প্রকাশিত ছবি দেখতে পেয়েছি তাতে দেখা গিয়েছে যে, তিনি তার পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে একটি শপিং মলে বাজার করছিলেন। হতে পারে বাংলাদেশে তিনি কখনওই সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবনের কোনো স্বাদ পান না, তাই লন্ডনে গিয়ে তিনি শপিং মলে ঘুরেছেন। দীর্ঘ তিন মাস তিনি প্রায় কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যই দেননি। এমনকি ব্রিটেনে তার দলীয় নেতাকর্মীদের কারো সঙ্গেই তিনি কোনো দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানা যায় না। যদিও এই তথ্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই চাউর হয়েছে যে, তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং কারো কারো সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে এরকম বৈঠক হতেই পারে এবং হওয়া উচিতও। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউর হওয়া তথ্যেও সতত্যা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়।
সেক্ষেত্রে বেগম জিয়া লন্ডন সফরকালে কার কার সঙ্গে বৈঠক করেছেন সে বিষয়ে সকলেই ধোয়াশায় আছেন। লন্ডনের বিএনপি-ঘনিষ্ঠ মহলে একথাও চাউর হয়েছে যে, বেগম জিয়া বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যারা আগামী নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। আগেই বলেছি যে, রাজনীতিতে এরকম সুযোগ ও তার সদ্ব্যবহার জরুরি। আমরা খুব সহজেই এই সত্য যাচাই করতে পারি যে, বেগম জিয়া যে তিনমাস লন্ডনে অবস্থান করছিলেন সেই তিন মাস বাংলাদেশ থেকে কোন্ কোন্ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ লন্ডন সফর করেছেন এবং সেই তালিকা থেকেই আমরা একটা ধারণাও পেতে পারি যে, কার কার সঙ্গে তার আলোচনা হলেও হতে পারে। এমনও গুজব শোনা গিয়েছে যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বেগম জিয়া বৈঠক করেছেন। আবারও একথা স্বীকার করে নিচ্ছি যে, এসব তথ্যের কোনোটিরই কোনও সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ নেই, কারণ বেগম জিয়া বা তার দলের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে কখনওই কোনো বিবৃতি বা তথ্য দেয়া হয়নি।
কিন্তু সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরের মাত্র দু’তিনদিন আগে যখন বেগম জিয়া ফিরে এলেন তখন এক ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু একথা বলেই ফেললেন যে, “বলেছিলাম না, বিএনপি নেত্রী ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন?” বন্ধুকে হেসে একথাই বলেছি যে, তাতে অসুবিধে কীসে? বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী, একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা যদি প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন তাহলে অসুবিধে কোথায় বলুনতো? বন্ধু খুউব স্পষ্ট ভাষায় শোনালেন যে, নাহ অসুবিধে কিছুই নেই, তবে মুখে ভারত-বিরোধী রাজনীতির তুবড়ি ফুটিয়ে গোপনে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চললে পরবর্তীতে ক্ষমতায় গিয়ে প্রকাশ্যেই ভারত-বিরোধী তৎপরতায় মদদ দিলে ভারতীয় হিসেবে আমাদের একটু সমস্যা হতেই পারে। তার সঙ্গে তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।
বিএনপি নেত্রী হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছেন, যারা বলেছিলেন বেগম জিয়া আর দেশে ফিরবেন না তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। একথা পাগলেও হয়তো বিশ্বাস করবে না যে, বেগম জিয়া এতো বড় একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হয়ে দলটিকে অতলে ফেলে রেখে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু সেই প্রশ্নটি আসলে থেকেই যায় যে, বেগম জিয়া কি সুষমা স্বরাজের সঙ্গে তার বৈঠকের প্রতিশ্রুতি পেয়েই ফিরে এলেন? নাহলে, তিনি তো দেশে থেকেও ভারতের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকে যোগদান করেননি তুচ্ছ হরতালের অজুহাতে। তখন ভারতের অনেক বিশ্লেষকই একথা জোর দিয়েই বলেছিলেন যে, বেগম খালেদা জিয়া প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে যোগ না দিয়ে ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধে আঘাত করেছেন এবং এই আঘাত অমোচনীয়। রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছুই নেই, আর প্রণব মুখার্জিও হয়তো ছিলেন কংগ্রেস নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, হতে পারে বিজেপি সে কথা ভুলে গিয়ে প্রতিবেশি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকটি হতে দিয়েছে। এর আগেতো বেগম জিয়াকে লবিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছিল সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য।
কিন্তু এবার নির্বিঘ্নেই বৈঠকটি হয়েছে এবং যথারীতি বেগম জিয়া ও তার দলীয় নেতারা সুষমা স্বরাজের কাছে দেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কথা তুলেছেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরেকটি দেশের নির্বাচন বিষয়ে যে কথা বলতে পারেন না বা উচিতও নয়, সে বোধটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি তাতে কোনোই সন্দেহ নেই, অতএব তিনি খুব স্বাভাবিক যে কথা বলার সে কথাতেই উত্তর দিয়েছেন, যা বাকি সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই দিয়ে থাকে। সুষমা স্বরাজ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তার সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়া সৌজন্য সাক্ষাৎ করতেই পারেন, কিন্তু রাজনৈতিক, নির্বাচন কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করাটা কি খুউব জরুরি ছিল? নাকি বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপি’র বাঘা বাঘা নেতাদের কানে তোলাটাই ছিল বেগম জিয়া ও বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ্য?
আমরা সবাই জানি যে, সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশে এসেছিলেন দু’দেশের অভিন্ন কিছু সমস্যা ও সুযোগ সম্পর্কে যৌথ আলোচনায় যোগ দিতে। সেসব আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে সকলেই উন্মুক্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাদের মধ্যেকার আলোচনা বিষয়ে আমরা কিছুই তেমন জানি না। তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে তাদের মধ্যে দু’দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া রাজনৈতিক আলোচনা হয়নি এরও সত্য-মিথ্যে জানিনে। কিন্তু বিএনপি’র পক্ষ থেকেই সুষমা স্বরাজ ও বেগম জিয়ার মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল বলেই আমরা জানি যে তারা নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। আবারও সেই প্রশ্ন তুলতে হয়, ভারতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে টেনে আনেন কে? কীভাবে? কেন? কিন্তু আমরা এই উত্তরও জানি যে, বিএনপি বা বেগম জিয়া ভারতের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে কিছুই এসে যায় না, এটাই স্বাভাবিক বলে ধরা হয় কিন্তু একই কাজ আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা করলে চারদিকে ছিঃ ছিক্কার পড়ে যায়। ব্লগে ব্লগে, ফেসবুকের পাতায় পাতায় ক্ষুদে-বৃদ্ধ বিপ্লবীরা শান দেয়া কলম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন আক্রমণে।
যা হোক, সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর এবং বেগম জিয়ার বৈঠক এখন গতস্য ঘটনা। কিন্তু এর নিশ্চয়ই একটি পরবর্তী অধ্যায় আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তার পরেই বেগম জিয়া আদালতে গিয়ে আবেগময় বক্তব্য দিয়েছেন এবং তিনি তার বক্তব্যে অনেক সত্য উচ্চারণও করেছেন। কেবল তিনি আদালতকে এই তথ্য দেননি যে, এই মামলাতো এতোদিন টানতে হতো না, এতোবারও তাকে হাজিরা দিতে হতো না যদি তিনি শ’দেড়েক বার মামলার তারিখ না পেছাতেন। একজন অভিযুক্ত যদি এতোবার মামলার তারিখ আগানো-পেছানোর সুযোগ পেয়েও দেশের সরকার ও বিচার-ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তখন স্বাভাবিক কারণেই এ প্রশ্ন তুলতে হয় যে, তার সেই আবেগময় বক্তব্যে আর কি কি তথ্য আছে যা আরো বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে?
আদালত-পর্ব শেষ করে বেগম জিয়া সড়ক পথে রওয়ানা দিয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রাণ দিতে। লন্ডনে তিন মাস ধরে চিকিৎসা গ্রহণ করে তিনি নিশ্চিত সুস্থ হয়েছেন এবং তার ফলেই সড়ক পথের এই কষ্ট তিনি হাসিমুখে বরণ করে নিতে পেরেছেন। একই সঙ্গে অবশ্য তিনি ঢাকা-কক্সবাজার মহাসড়ক ধরে তার নির্বাচনী রাজনীতিটুকুও সফল ভাবে করেছেন। আমি মনে করি, বিএনপি দীর্ঘ তিন মাস বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে যেটুকু পিছিয়ে পড়েছিল আদালতে বেগম জিয়ার আবেগময় বক্তব্য এবং কক্সবাজার সফর তার সবটাই পুষিয়ে দিয়েছে। বেগম জিয়ার সমালোচকরা বলছেন, এসব সবই আসলে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ফল, তিনিই রাজনৈতিক সঞ্জীবনী বটিকা দিয়ে গিয়েছেন। দুর্মুখেরা কী না বলে বলুন?
কিন্তু হঠাৎ লন্ডন থেকে ফেরা, সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক, আদালতে হাজিরা না দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া থেকে হঠাৎ সেখানে দাঁড়িয়ে এক ঘন্টার আবেগময় বক্তব্য এবং তারপর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রাণ দিতে সড়ক পথে রওয়ানা দেওয়া- এসব ঘটনাকে এক লাইনে ফেললে সুষমা স্বরাজকে একটু প্রশংসা করতেই হয় আমাদের। কিংবা যদি প্রশংসা নাও করি তাহলে এটুকুতো বলতেই হয় যে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে জাদুময় কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে এদেশের, নাহলে একযোগে এতোগুলো ঘটনাতো এদেশের মানুষ অনেকদিন ঘটতে দেখেনি। তবে এদেশে বছর শেষের দু’মাস সব সময়ই আন্দোলন-আতঙ্কের, দেখা যাক কোনো সঞ্জীবনী সুধা আমাদের সে আতঙ্কমুক্ত রাখতে পারে কিনা!!
ঢাকা ৩০ অক্টোবর, সোমবার ২০১৭
[email protected]
এইচআর/আইআই