ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পুরুষ সততার সঙ্গে বলুক #আমি_করিনি

তানজীনা ইয়াসমিন | প্রকাশিত: ০৪:০৯ এএম, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

#মিটু, #আই হ্যাভ। অনেকেই জেনে গেছেন এই ক্যাম্পেইন। ব্যাখ্যা মনে হয় বাহুল্য। তবুও যারা অবগত নন তাদের সংক্ষেপে জানাই যে মূলত তারকা জগতের নারীদের নেয়া এই উদ্যোগে #Metoo দিয়ে জানান তিনিও জীবনের কোন পর্যায়ে যৌন নির্যাতনের বা অবমাননার শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ এই নির্যাতন শুধু অসহায় নারীদের না, সমাজে উঁচু তলার মানুষের জীবনেও কখনো ঘটেছে। আর পুরুষ #ihave পোস্ট করে জানান যে, হ্যাঁ তিনিও কাউকে কখনো এমন নির্যাতন করেছেন।

ক্ষমাপ্রার্থী, নেগেটিভলি নয় কিন্তু ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে দেখার জন্য। একজন সেলেব্রেটি যখন এই স্বীকারোক্তি দিলো তাতে প্রাপ্তিযোগ কি? নিপীড়িত নারীর হিসাবটা বড় হলো। কিন্তু কেউ কি শাস্তি পেল? সামাজিক অসম্নানের শাস্তি হলেও কেউ পেতো যদি সেই সেলেব্রেটি নিপীড়কের নাম প্রকাশ করতো। তবে প্রকাশের ক্ষেত্রে অপব্যবহারের আশংকাও আছে। অন্যদিকে পুরুষ (অবশ্যই উন্নত বিশ্বে) যারা স্বীকার করেছেন তিনি কি করেছেন তাদের অনুতাপ কি অনুভূত? নাকি এর ভেতরে কিংকং টাইপ হুংকারও আছে “ আমিও করেছি, কি করবে করো!”

এই নেগেটিভ প্রতিক্রিয়াটা হাস্যকর লাগবে অনেকের, কিন্তু আমি পুরুষদেরই এই হ্যাশট্যাগ দেখিয়ে এই প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। বরং এই স্বীকারোক্তি হতে পারতো, #আই হ্যাভনট, আমি কোনদিন কাউকে নিপীড়ন করিনি। য্ত এর সংখ্যা বাড়তো ততই তাদের চ্যালেঞ্জ সমেত দোষ নির্দোষ প্রমাণ হতো। কেউ পোস্ট না করলে, “তুমি পোস্ট করোনি, মানে তুমি নিপীড়ন করেছ?” বলা যেতো। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রূডো; নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে অন্যতম জনপ্রিয় রাজনীতিক। কারণটা তিনি তরুণ সুদর্শন তা না, কারণ তিনি আপাতভাবে খুব সুন্দর মনের মানুষ, খুব মানবিক একজন মানুষ। সম্প্রতি তাঁর একটি বক্তব্য মন ছুঁয়ে গেছে, “আপনার ছেলেকে নারীবাদী করে তুলুন”। অভিনেত্রী মিথিলাও তার এক সাক্ষাৎকারে ছেলেদের নারীবাদী হবার আহ্বান জানিয়েছেন।

আমি আনন্দিত। এজন্য না যে আমি নারী = নারীবাদী বলে। বরঞ্চ আনন্দিত এজন্যই যে আমি “নারীবাদী না” হওয়া স্বত্বেও আমার ছেলে নারীবাদী। হয়তো পাঠক খুব উদ্ভট চোখে ভাবছেন এ আবার কেমন ঢং! শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারী কেন নারীবাদী হবেন না! কারণ এই “নারীবাদী” শব্দটা আমাকে খুব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা হেয়তর, আমরা দুর্বল। আমি কোনদিন এই টপিক্সে না লিখেও গালি শুনেছি “নারীবাদ নিয়ে লিখে এখন অনেক মেয়েই লেখক” । আমাদের জাজমেন্টাল মানসিকতার প্রকাশ, বার বার।

ছোটবেলায় ক্লাসে ফার্স্ট হতাম এই জেদে যে ২য় বা ৩য় হলে আমাকে ফার্স্ট গার্ল বলা হবে, ক্লাসের ফার্স্ট না। মেয়েরাও বলতো মেয়েদের তালিকায় অমুক, য্খন সম্মিলিত মেধা তালিকায় ঠাঁই না হতো। তাহলে আবার সম-অধিকারের লড়াই কেন? ভাগ্যিস এখন তালিকায় প্রায়ই মেয়েরাই এগিয়ে। অফিসে মেয়েদের অনেককিছু বেশতী সুবিধা চাই। কোথাও গেলে আমার লাগেজও পুরুষ বহন করে দেবে। কেন? এসবতো কোন অনিরাপত্তা থেকে নয়! বেশতী সুবিধা নেয়ায় তো হিসেব চুকানোর আশঙ্কা থাকবেই। নিজেই বার বার প্রমাণ করা যে আমি পুরুষের ওপর নির্ভরশীল।

আমি বিশ্বের যেপ্রান্তেই যাই, শুধু ঢাকা এয়ারপোর্টেই এই বিস্ময় দেখি, “এই মহিলা এত্ত লাগেজ একা কেমনে এতদূর টানবে?” ওদের শ্লেষোক্তি আমার ক্ষুদ্র শরীরে বিশাল বল এনে দেয়। কাজেই এমন বিশ্বে মেয়েদের আত্মসন্মানবোধটা স্বনির্ভরতার প্যাকেজেই আসবে। অন্যদিকে যানবাহনে নারীর জন্য সংরক্ষিত সীটে ছেলেরা বসে গেল, জায়গা দিলনা, ভিড়ে অসভ্যতা, ঘরে বাইরে নিপীড়ন নিত্যকালীন। ধর্ষণ হত্যা বেড়েছে ভয়াবহ আকারে, গোটা উপমহাদেশেই। ইয়েমেনে ২ ও ৪ বছরের মেয়ে শিশু ধর্ষণ-হত্যার দুই বিচারের অপরাধীদের সমগ্র জনগণের সামনে মাথায় রাইফেল শট করে মেরে লাশ ক্রেনে করে ঝুলিয়ে রেখেছে। মানবতাবাদীরা ছিঃ ছিঃ বলবেন, কিন্তু এমন তীব্র দৃষ্টান্ত না হলে নির্বিচারে এই পাশবিকতা বাড়বেই।

একইসঙ্গে মেয়েদের ঘরে বাইরে নিপীড়নের বেদনাটা ছেলেদেরই আগে বুঝতে হবে। তাদেরই নারীবাদী হতে হবে। কারণ সমঅধিকার, সবচেয়ে অকার্যকর একটা শব্দ। এর অস্তিত্ব বিশ্ববিধাতার দরবারেই নেই, কোন ধর্মগ্রন্থে নেই, কেন তাহলে মানব অভিধানে থাকবে? কোনদিন শুনেছেন কোন ধর্মগ্রন্থ কোন নারী রসুল বা নির্বাচিত কারো ওপর নাজিল হয়েছে? ভাবতে পারেন স্রষ্টা নারী? যদিও বা সমগ্র প্রাণীকূল আগমন হয় নারীর গর্ভেই! আলোচিত ব্যক্তিত্ব ডা. জাকির নায়েক ২০১৫`র নভেম্বরের শুরুতে ১ সপ্তাহের জাপান সফরে এসেছিলেন। ডা. নায়েকের সফরকালীন জাপানের ৪টি অঞ্চলের ভেতর আমাদের শহরও ছিল। তার সফরসঙ্গী পিস টিভির প্রায় ৪০ জনের বিশাল ট্রুপের দেখভালের মূল দায়িত্ব মসজিদ কমিটির ওপরেই পড়লো।

কিউশ্যু বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর লেকচারের দিন উপচে পড়া ভিড়। ডা. নায়েকের সেদিনের লেকচার ছিল মূলত অমুসলিমদেরকে ইসলাম কি তা জানানো। তবে সাওয়াল জবাব ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক নারী পুরুষকে ভিন্ন লাইনে দাঁড়াতে হলো। খুব কম জনই প্রশ্ন করতে পেরেছিল, কারণ এক প্রশ্নের লম্বা ব্যাখ্যা এবং ব্যাখ্যাত্তর উপপ্রশ্নও জাগ্রত হচ্ছিল। ভাগ্যগুণে আমার বড় ছেলে পুরুষ সারির শেষ প্রশ্নকর্তার সুযোগটা পেয়েছিল। তার প্রশ্ন ছিল, “ ইসলাম কি নারীদের সম-অধিকার দিয়েছে?” ডা. নায়েকের অনেক ব্যাখ্যা আমার মনঃপুত না হলেও এই ব্যাখ্যা মনে ধরেছিল। তার উত্তরের সারবত্তা ছিল, ‘ইসলাম নারীকে অধিকার দিয়েছে যেই নারীর মানুষ হিসেবে কোন অধিকার ছিল না। অন্ধকার যুগে, পৌত্তলিক যুগে নারী শিশু জন্ম হলে মেরে ফেলা হতো, পণ্যের মত বেঁচাকেনা হতো। অজস্র পত্নি উপপত্নির কোন হিসাব ছিলনা, মর্যাদা বা অধিকার তো দূরের কথা। ইসলাম নারীকে মানুষের মর্যাদা, অধিকার দিয়েছে। একজন পুরুষ সামর্থ্যবান হলে নিজ স্ত্রীর সম্মতিতে সমান মর্যাদায় কজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবেন তা প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিধবাদের পতিত মানা হতো পৌত্তলিক ধর্মে, বহুযূগ পরেও মানা হয়েছে।

রাসুল (সাঃ) নিজে তাঁর চেয়ে ১৫ বছরের বেশি বয়সী বিধবা নারীকে বিয়ে করেছেন, বিবি খাদিজা (রাঃ)এর নিজ ব্যবসায় প্রধান অংশগ্রহণ নারীর কর্মজীবী হবার অধিকার দেখিয়েছে এবং রাসুল নিজের ২৫ থেকে ৫২ বছর পর্যন্ত কেবলমাত্র এক স্ত্রীকে নিয়েই সংসার করেছেন। বিবি খাদিজা(রাঃ) এর ইন্তেকালের পর তিনি একমাত্র বিবি আয়েশা (রাঃ) ব্যতীত আর কাউকেই রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণ বা দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্য ছাড়া বিয়ে করেননি। যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিবি আয়েশা (রাঃ) অংশগ্রহণও নারীর শক্তিমত্তার প্রতি সন্মান প্রদর্শনের আরেক নিদর্শন। সুরা আন-নীসায় নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক তথা সম্পদে অধিকার পরিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়াও পর্দা নিয়ে যে নারীকে প্রেষণ করা হয়, আল কোরানে আন-নূরে (২৪:৩১) স্পষ্ট করে আগে পুরুষের চোখের পর্দা এবং শরীরের পর্দার কথা বলা হয়েছে। নারীর অধিকার পুরুষকে স্বীকার করতেই হবে, তাদেরই আগে জানতে এবং মানতে হবে। কিন্তু সম-অধিকার বলে কোথাও কখনো বলা হয়নি।”

ধর্ম সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়, বিশ্বাস অবিশ্বাসও একান্তই আত্মিক। কিন্তু যারা বিশ্বাসী, অন্তত দাবি করতে চান, বিশেষ করে যারা পুরুষের অপরাধেও বরাবর মেয়েদের পর্দা নিয়ে গলার রক্ত বের করে ফেলেন তারা ধর্মমতে পর্দাটা কি জেনে নেবেন। আপনার নিজের চোখের পর্দা থাকলে নিজের স্ত্রী কন্যা ভগ্নি মাতা ব্যতিরেকে কে বেপর্দা আপনার সেদিকে চোখ কেন যাবে? এবং এ কারণেই পুরুষকেই নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, প্রয়োজনে নারীবাদীর তকমা নিয়েই। অন্যথা এই বিশ্বে মেয়েদের নিরাপত্তা ঘরে বাইরে সবখানেই বিপন্ন থেকে প্রতিদিন বিপন্নতরই হবে। জ্ঞানের সাথে অন্ধকার দূর হয়, দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত হয়। পুরুষেরা চোখকে আব্রু দিন, অন্ধত্ব না। সততার সাথে বলুন #আমি_করিনি।

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন