ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

যানজট দৈত্য

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ০৪:০২ এএম, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

এই নগরীর ফ্লাইওভার সংস্কৃতির সবশেষ সংযোজন মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভার। বৃহস্পতিবার এর সবকটি অংশ খুলে দেয়া হলো। এর মধ্য দিয়ে ৬ বছরের অপেক্ষা ও দুর্ভোগের অবসান ঘটিয়ে পুরোপুরি খুলে গেল তিনভাগে নির্মিত ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটারের এ ফ্লাইওভারটি। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার অর্থায়ন করেছে ৪৪২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি) দিয়েছে ৭৭৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

ঢাকা মহানগরীকে যানজটমুক্ত করে মানুষের পথচলা সুগম করতে বিগত সাড়ে আট বছর একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ছয়টি ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে চার হাজার কেটি টাকারও বেশি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অধীনে এসব ফ্লাইওভার নির্মিত হয়।

ঢাকার রাস্তায় এত যানজট কেন? আর এর সমাধানই বা কী? এই প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর নেই। তবে চেষ্টা করা হয়েছে উপর দিয়ে কিছু গাড়ি পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান করার। অনেকেই বলবেন, গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে তাই যানজট বেড়েছে। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা বাড়লেই যানজট হবে, এই ধারণাটি অতি সহজ। আসলে আমাদের রাজধানীতে পরিবহন কাঠামোর অপ্রতুলতা ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা একে উত্তরোত্তর গতিহীন করে তুলেছে। সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ততার মাঝে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির গড় গতি ঘণ্টায় ৬/৭ কিলোমিটারের মতো। আর এই গতিহীনতার কারণে জীবন থেকে কত সময় চলে যাচ্ছে তার হিসেব কেউ দেবেনা।

ঢাকা শহরের মোট আয়তনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ ৮ শতাংশ, যেখানে আন্তর্জাতিক আদর্শ মান হচ্ছে ২৫ শতাংশ। আর ওই রাস্তার ওপর দিয়ে সিংহভাগ যানবাহন যদি ছোটার চেষ্টা করে, তা হলে সেই রাস্তা স্বভাবতই গতিহীন হবে। আজ থেকে তিন দশক আগেও দেশের বিভিন্ন শহরে যাত্রী পরিবহনে গণ-পরিবহন ব্যবস্থা ছিল মূলত বাস অথবা লোকাল ট্রেন-নির্ভর। ধীরে ধীরে সেটির পরিবর্তন ঘটল প্রাইভেট গাড়ি বাড়ার কারণে। আমরা মুখে বলি রেল ব্যবস্থা যাত্রী পরিবহনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বাস্তবে সড়ক পরিবহনেই আমাদের সব পরিকল্পনা।

একই রাস্তায় ধীরগতির রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটো ও সিএনজি ও এবং একই সাথে গতিশীল গাড়ি সব মিলে এখন এক সাথে থমকে থাকে। শহরের রাস্তাগুলি বর্ধিত যানবাহনের চাপ সামলিয়ে গতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। ট্র্যাফিক বিভাগের হিসাব মতে, মাত্র আট শতাংশ রাস্তারও ৩০ ভাগের মতো দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের হাতে৷ এছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই পায়ে হেঁটে চলেন নগরবাসী৷ ফলে যানজটের সঙ্গে আছে জনজট৷

ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে তা যেকোন শহরে নজিরবিহীন। মাত্র ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছেন মোট সড়কের ৭০ ভাগ৷ স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি-র হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কম-বেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন৷ এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা৷ বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন৷ অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পান৷ শতকরা এক ভাগেরও কম মানুষের প্রাইভেট কার রয়েছে৷ কিন্তু সড়ক চলে গেছে তাদেরই দখলে৷

আরেকটি বড় সমস্যা এই শহরে দাপুটে মানুষের সংখ্যা যাদের সবাই ভিআইপি নামে চেনে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের (রাজনীতিবিদ, আমলা) চলাচলের কারণে সারাদিনই ট্রাফিক পুলিশকে প্রটোকল দিতে হয়। ফলে সারাদিনই দীর্ঘসময়ের জন্য কোন না কোন সড়ক বন্ধ রখে শুধু তাদের চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়৷ স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়ে সব সড়কে। প্রটোকল সংস্কৃতির সাথে যোগ হয়েছে ক্ষমতাবানদের আইন না মানার অভ্যাস। উল্টোদিকে গাড়ি চলাচল যেন তাদের পেশিশক্তির প্রকাশ। সাধারণ নাগরিকদেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। তারাও সুযোগ পেলেই ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘন করে।

যানজট কমানোর একটা বড় উপায় হতে পারে ফুটপাথ দখলমুক্ত করা, অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা। ঢাকা দক্ষিণের কিছু কিছু অংশে ফুটপাথ দখলমুক্ত করার ফলে যানজট বেশ কানিকটা কমেছে। এই কাজ সারা শহরেই করতে হবে। অনেক মানুষের পরিবহন চাহিদা এখনও পূর্ণ হচ্ছে মোটরযান ব্যবহার ব্যতিরেকেই। পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চেপে। এই প্রেক্ষিতে, শহরের মূল রাস্তাগুলোকে বিপদমুক্ত করার তাগিদেই ফুটপাথের হকারমুক্তি আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। পথচারীরাও এখন বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তারা যত্রতত্র সড়ক পার হওয়ায় রাস্তার গতি কমছে।

যানজট এক দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে এই শহরে। এর কারণে ঢাকা একটি অকার্যকর শহরে পরিণত হচ্ছে৷ তাই এখনই প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা৷ এই শহরকে বাঁচাতেই হবে। মানুষের জীবন, পেশা এবং অর্থনৈতিক তৎপরতা স্থবির হতে দেয়া যায় না। প্রয়োজন বিভিন্ন যানবৈচিত্র্য অনুযায়ী রাস্তার বিভাজন ও যান নিয়ন্ত্রণ। শুধুমাত্র বাস নয়, মেট্রো রেল, লোকাল ট্রেন, জলপথ পরিবহন- এগুলোর যথাযথ সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই সংঘবদ্ধ পরিবহন ব্যবস্থা। এই উন্নত বিকল্প তৈরি করেই ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ঝোঁক কমানো যেতে পারে, কমতে পারে শহরে যানজট।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন