ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ফেইক নিউজ

তানভীর আহমেদ | প্রকাশিত: ০৬:৩৬ এএম, ১০ অক্টোবর ২০১৭

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম সরাসরি প্রেস কনফারেন্সে যখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর নিচ্ছিলেন সেদিন কেইবল নিউজ নেটওয়ার্ক (সিএনএন) এর সাংবাদিক ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রশ্ন করতে চাইলে ট্রাম্প সাংবাদিককে প্রশ্ন করতে দেবেন না বলে আঙ্গুল তুলে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং বলতে থাকেন, ''তোমার অর্গাইনজেশন ভয়াবহ।'' ট্রাম্প সিএনএন-এর ওই সাংবাদিককে বলেন, 'ইউ আর এ্যা ফেইক নিউজ।'' পরবর্তীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় প্রশ্ন করেন, সিটেন ইনটেল কমিটি ফেইক নিউজ নেটওয়ার্ক গুলোর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না যারা প্রতিনিয়তই ফেইক নিউজ তৈরি করছে।

মার্কিন নির্বাচনের আগেও নির্বাচনী প্রচারণায় ভুয়া সংবাদ প্রচার করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মার্কিন নির্বাচনে ভোট ক্যাম্পেইনে ট্রাম্পের বিজয়ের নেপথ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কারসাজির খবরও আমরা শুনেছি। তবে একথা ঠিক ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবার পর থেকে মূলত 'ফেইক নিউজ' খুব জনপ্রিয় টার্মে পরিণত হয়েছে। লাস ভেগাসে সাম্প্রতিক হামলার পর হত্যাকারী, ডেমোক্র্যাট ও ট্রাম্পের ঘোর বিরোধী বলে অপপ্রচার শুরু করেছিলো ফেসবুক ও গুগল।

অন্যদিকে ইউটিউব প্রচার করতে থাকে হত্যাকারী হিলারি ক্লিনটনের সমর্থক। উভয় রাজনৈতিক দলের প্রতিপক্ষরা এই ভিডিও ও টুইট গুলো শেয়ার দিতে থাকে। কোনো প্রকার যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ এখানে ছিলো না। বরং ফেসবুক এসব প্রচারে সমর্থন যুগিয়েছে বলেই অভিযোগ এসেছে ট্রাম্প প্রশাসনের তরফ থেকে। সম্প্রতি জার্মান নির্বাচনের আগেও ম্যারকেল পন্থীদের ভয় ছিলো ফেইক নিউজের প্রভাব হয়তো নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দিতে পারে। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই শরণার্থী ইস্যু নিয়ে ফেসবুক ম্যারকেল বিরোধী প্রচারণায় নামে। প্রতিউত্তরে ম্যারকেল প্রশাসন ফেসবুককে নোটিশ দিয়ে জানায়, ২৪ ঘন্টার মধ্যে ফেসবুক যদি প্রমানহীন তথ্য তুলে না নেয় তাহলে ফেইসবুককে ৫০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা করা হবে।

বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে ফেসবুকের এই ফেইক নিউজ প্রচারণায় আয় চারশ বিলিয়ন ইউএস ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির বিজ্ঞাপন বিভাগের পরিচালক গ্রে কোবি নির্বাচনের আগে স্বীকার করেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পেছনে মূখ্য ভূমিকা রেখেছে ফেইক নিউজের প্রচারণা। এই খাতে ফেসবুকের পেছনে ট্রাম্পের ব্যয় ছিলো ৭০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।তাই এসব কিছু বিবেচনা করে সামনের দিনগুলোতে গণমাধ্যম কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের কাছে ফেইক নিউজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সপ্তাহ দুয়েক আগে বিলেতে আমরা কয়েকজন মিডিয়া কর্মী বিবিসি লন্ডনের ক্লাবে মুক্ত আলোচনায় বসেছিলাম। আড্ডায় ফেইক নিউজ নিয়ে কথা তুললেন বিবিসি'র সাংবাদিক মাসুদ হাসান খান। সেই আড্ডায় যোগ দিলেন বিবিসি লন্ডনের সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ঢাকা ব্যুরোর সম্পাদক ওয়ালিউর রহমান মিরাজ সহ বিলেতের মিডিয়া কর্মীরা। মিরাজ ভাই বলছিলেন, ''ফেইক নিউজ খোদ বিবিসির জন্যও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ঢাকার ফেইক নিউজের কায়দাটা একটু ভিন্ন। ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে কেউ কেউ এমন সব সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে যারা শিরোনামে বিবিসির লাল লোগো যুক্ত করা থাকে। দেখা গেছে এই সংবাদটি বিবিসি'র করা নয়, কেউ একজন ফটোশপে তাদের মনগড়া একটি সংবাদের সাথে শিরোনামে বিবিসি'র লোগোটি বসিয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে থাকলেন। এতে পাঠক সেই সংবাদ বিবিসি'র মনে করে বিভ্রান্ত হচ্ছেন, আর দায় পড়ছে বিবিসি'র উপর। এখন এই দুর্যোগ থেকে মুক্তির উপায় কি আদৌ আছে?''

সহজ উত্তর হলো বাজারে সকল জিনিসেরই নকল ও আসল থাকে। ক্রেতা হিসেবে আপনাকে মাছ কিনতে গেলে যেমন সতর্ক থাকতে হয় আপনি পঁচা মাছ কিনছেন কিনা তেমনি সংবাদ গ্রহণের ক্ষেত্রেও আপনাকে সতর্ক হতে হবে আপনি কোন সংবাদটি গ্রহণ করবেন কোনটি বর্জন করবেন। গাউসিয়া মার্কেট কিংবা নিউমার্কেটের ওভার ব্রিজের সামনে ফুটপাথ থেকে আপনি এক জোড়া জুতা কিনলেন। এক সপ্তাহ পর সেই জুতার তলা খসে পড়ে গেলো। এখন আপনি গেলেন সেই জুতা বদল করতে। গিয়ে দেখলেন যার কাছ থেকে জুতা কিনেছেন সেই দোকানি আর সেখানে নেই। যদি ভাগ্যক্রমে সেই দোকানিকে আপনি পেয়েও যান তাহলে জুতা ফেরত দিয়ে আপনি টাকা ফেরত আনতে পারবেন তার নিশ্চয়তা দেওয়া মুশকিল হবে। আবার আপনি যদি এ্যালিফেন্ট রোডের বাটা থেকে এক জোড়া জুতা কেনেন, সেই জুতা টেকসই যেমন হবে, তেমনি জুতার তলা খসে পড়লে আপনার কাস্টমার সার্ভিস পাবার সম্ভাবনাও বেশি।

তাহলে পার্থক্যটা হলো ব্রান্ডের। এখন ভালো ব্র্যান্ডের জুতা কিনতে যেমন আপনাকে ভালো দাম দিতে হয় তেমনি ভালো বা ঠিক সংবাদ পেতে হলে আপনাকে নির্ভর করতে হবে ভালো সংবাদ সংস্থা, নিউজপেপার, টেলিভিশন কিংবা গ্রহণযোগ্য সাংবাদিকের উপর। আপনি যদি ফেসবুকে শেয়ার করা একটি সংবাদের উপর ভিত্তি করে আপনার তথ্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে চান তাহলে আপনি ফুটপাথ থেকে জুতা কিনে জুতার তলা খসে পড়লে আহত হতে পারবেন না। অতএব সঠিক সংবাদের জন্য আপনাকে গ্রহণযোগ্য সংবাদ সংস্থার উপরই আস্থা রাখতে হবে।

তাহলে ওয়ালিউর রহমানের প্রশ্নের উত্তরটির কি হবে, যারা প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র বা মিডিয়ার লোগো কারসাজি করে নিজেদের নিউজ বলে প্রচার করছে তাদের রুখবে কে? সাধারণ পাঠক তো এই সকল ফেইক নিউজ থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। উত্তর সহজ, সচেতন হওয়া। স্বর্ণের দোকানে গেলে আপনি যেমন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কাউকে নিয়ে যান স্বর্ণের যাচাই বাছাই করতে তেমনি আধুনিক ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে ঠিক সংবাদ পেতে হলে নিজেকেও জহুরী হতে হবে। লন্ডনের গুগল মিডিয়া একাডেমিতে গিয়েছিলাম গত সপ্তাহে। ফেইক নিউজের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাংবাদিকরা কিভাবে গুগল টুলসকে কাজে লাগিয়ে ফেইক সংবাদ, ছবি আর ভিডিও সনাক্ত করবেন তার প্রশিক্ষণ নিতে। বিবিসি, আলজাজিরা, স্কাই, আইটিভির প্রায় দেড় শতাধিক সাংবাদিক ও মিডিয়া প্রফেশনাল সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন ম্যাট কুক। ম্যাট কুক আমাদের দেখাচ্ছিলেন, কিভাবে গুগল টুল ব্যবহার করে একটি ছবির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব, ফেইক নিউজ বের করা সম্ভব। মোটকথা, প্রযুক্তির ব্যবহার যত আপনার তথ্য প্রাপ্তি সহজ করবে আপনাকেও নিজের প্রযুক্তি জ্ঞান সমৃদ্ধ করে নিজস্ব ফিল্টার পদ্ধতির উন্নতি ঘটাতে হবে । আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক কিছুই আর চাইলেই চেপে রাখা সম্ভব নয়। সম্প্রতি বার্মার রাখাইন রাজ্যে আসলে কি ঘটেছিলো সে সম্পর্কে বিশ্ব গণমাধ্যম তেমন কোনো তথ্যই পাচ্ছিল না। কোনো গণমাধ্যমকেই সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। সেই সময় গুগল আর্থ প্লাস নামে নতুন একটি এপ্লিকেশনের মাধ্যমে গুগল রাখাইন রাজ্যের থ্রি ডি স্যাটেলাইট ইমেজ বের করে বিশ্ববাসীকে চমকে দিলো।

আমাদের আড্ডায় আরেকটি বিষয় আলোচনায় এসেছিলো। নির্বাচনে এই ফেইক নিউজ মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছিলো। সম্প্রতি জার্মান নির্বাচনেও এই ফেইক নিউজ প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে এধরনের ফেইক নিউজ অনেক বড় অঘটন ঘটাতে পারে। আমার জানা মতে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে নির্বাচন আচরণ বিধিমালায় পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে টেলিফোন ব্যবহারের কোন সুর্নিদিষ্ট নীতিমালা নেই। নির্বাচনে যে কোনো ভোট কেন্দ্র থেকে যে কোনো ধরনের সংবাদ যাচাই ছাড়া প্রচার হতে পারে, যা অনেক বড় ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন যেহেতৃ অনেক দূরে, তাই মার্কিন নির্বাচনে ফেইক নিউজের প্রচারের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ফেইক নিউজ বা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য প্রচারের ব্যপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা সময় থাকতে পরিষ্কার করা উচিত।

এই লেখা যখন লিখছি তখন আমার এক সহকর্মী একটি স্ক্রিনশট দেখালেন। এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আমার সেই সহকর্মী বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন, এখন কি হবে? কিন্তু আমি সেই স্ট্যাটাস দাতার প্রোফাইল ভিজিট করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম ওই ব্যক্তির একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি আসক্তি রয়েছে। তার স্ট্যাটাসে প্রধানমন্ত্রীর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে একাধিক কৌতূকপূর্ণ মন্তব্য রয়েছে।

সিটিজেন জার্নালিজম একদিকে যেমন মূলধারার সংবাদকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল করে তুলেছে, অন্যদিকে ডিজিটাল যোগাযোগের এই সহজলভ্য মাধ্যম অনেক ঝুঁকিপূর্ণ তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে যা পাঠক হিসেবে আপনাকেই যাচাই বাছাই করে গ্রহণ ও বর্জন করতে হবে। আর ফেসবুক নিজেও অনুধাবন করতে পারছে ফেইক নিউজের কারণে তাদেরও গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে। তাই ফেসবুক ফেইক নিউজ রোধে পাঠককে সচেতন হবার জন্য ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ান, দ্য টাইমস ও ডেইলি টেলিগ্রাফের মতো খবরের কাগজে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।

ফেসবুক পাঠককে ১০ টি বিষয়ে সতর্ক হতে বলছে। যেমন সন্দেহজনক শিরোনামের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে, ইউআরএল বা ওয়েব এ্যাড্রেস খুব সতর্কভাবে খেয়াল করতে হবে, পাঠককে অবশ্যই সোর্স সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে হবে, সংবাদের ব্যবহৃত ছবি সতর্কভাবে খেয়াল করতে হবে, অন্য নিউজ পোর্টালে এধরনের সংবাদ রয়েছে কিনা যাচাই করে দেখতে হবে, সংবাদের তারিখ ও সূত্র সম্পর্কে যাচাই করতে হবে। সবশেষে বলতে চাই, আপনি নিজে যদি মনে করেন 'ফেইক নিউজ' যাচাই বাছাইয়ের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারেন নি, তাহলে আপনার গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যমের উপর নির্ভর করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। কারেন্ট এফেয়ার্স এডিটর, চ্যানেল এস টেলিভিশন লন্ডন ও একাত্তর টেলিভিশনের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি।

[email protected]

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন