মানুষের লড়াইকে সংগঠিত করা
আমাদের মানবাধিকার কমিশন আছে, তার একজন খুব সক্রিয় চেয়ারম্যান আছেন। মন্ত্রী এমপিদের মুখেও মানবাধিকারের কথা আমরা শুনি। কিন্তু সত্য কথা এই যে, রাষ্ট্রের চেষ্টাই হলো নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা করার দায় হতে মুক্ত থাকা। ক্ষমতা ব্যবহারের নিরঙ্কুশ সুযোগ যখন থাকে, বিরোধী পক্ষ যখন খুব দুর্বল হয়, বিচারবিভাগ কিংবা মানবাধিকার কমিশনের কাছে নিগৃহীতরা অভিযোগ জানিয়েও খুব একটা ফলাফল পায় না।
আমরা দেখেছি, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান একাধিকবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে পুলিশ-প্রশাসনকে দায়ী করেছেন, রাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন, রাজনীতিকেও অনেক ক্ষেত্রে সবক দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুব একটি ভ্রুক্ষেপ করেছেন বলে মনে হয় না। শুধু এই আমলে নয়, সব আমলেই মানবাধিকার লংঘনের সব অভিযোগকে সদর্পে এড়িয়ে গেছেন মানবাধিকার লংঘনকারীরা।
কিন্তু মানুষের লড়াইতো থেমে নেই। দেশ জুড়েই নিপীড়ত, নিগৃহীত, আদিবাসী, সংখ্যালঘুরা নিজের নিজের জায়গায় লড়ছে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো এসব টুকরো টুকরো লড়াইকে কখনোই একসাথে করতে পারেনি। ফলে এসব লড়াই থেকে সাফল্য আসেনি সেভাবে। আমাদের দেশে নির্বাচনের উপরই নির্ভর করে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ। মানবাধিকার রক্ষার লড়াই বড় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য শ্লোগান হলেও তাদের কাছে এটা কখনোই মূলধারার রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেনি।
বাম ধারার রাজনীতি যারা করেন, তাদের কাছে মানবাধিকারের বিষয়টি মূল্য পায় ঠিকই। কিন্তু বহুধা বিভক্ত ক্ষুদ্র এসব রাজনৈতিক সংগঠন বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে লড়াইয়ে কখনোই পেরে উঠছে না। কিন্তু এ কথাতো সত্য যে, মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্ন মূলধারার রাজনীতিতে আনতে হবে।
আসলে রাজনৈতিক দলগুলি তখনই কোনও বিষয়কে গুরুত্ব দেয়, যখন তার উপর একটা সামাজিক চাপ থাকে। এই সামাজিক চাপটা তৈরি করবে কে? অবশ্যই সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি।
বাজার অর্থনীতির কারণে নব্বইয়ের দশক থেকে আমাদের দেশ এক অদ্ভুত অবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে। এই নতুন বাজার অর্থনৈতিক নীতির ফলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আত্মসাৎ করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে সবার ভেতরে।একটা সময় ছিল লুটেরা শ্রেণি এটা করতো, সমাজ তাদের চিনতো। কিন্তু অবক্ষয় এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে মূল্যবোধ সম্পন্ন মধ্যবিত্তও শিখে গেছে সম্পদ আত্মসাৎ-এর প্রক্রিয়াটি।
শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদেরও এই বাজার অর্থনীতি ‘প্রিভিলেজড ক্লাস’ বানিয়ে ছেড়েছে। ফলে তারা নিরব কিংবা তারা কথা বলে যার যার রাজনৈতিক ও সামাজিক সুবিধাগত অবস্থান থেকে। এখন সমাজের এমন একটা অবস্থা যে তাঁরাই ক্ষমতাশালী, যাঁরা উচ্চবর্ণ, উচ্চশ্রেণি, শহুরে, শিক্ষিত। অন্য দিকে, গ্রামীণ, শ্রমজীবী মানুষ, প্রান্তিক মানুষ শুধু বেঁচে থাকার লড়াই করবে, তাদের সব অধিকার কেড়ে নেয়া হবে, কিন্তু তারা কিছু করতে পারবে না, তাদের পক্ষে কেউ দাঁড়াবে না। আবার যারা দাঁড়াবে, তারা হয় খুব ক্ষুদ্র, নয়তো তারাও একটা সময় সেই সম্পদ আত্মসাৎ চক্রের প্রলোভনে পা দিয়ে সটকে যাবে।
সাধারণ মানুষ এখনও তাঁদের অধিকার সম্বন্ধেই সচেতন নয়। এদের ভেতরে কাজ করা লোকের বড় অভাব যিনি বা যারা তাঁদের অধিকার আদায়ের লড়াইকে ইন্ধন জোগাবেন। মানবাধিকার যাঁরা ভঙ্গ করেন, তাঁরা এত ক্ষমতাশালী যে, লড়াইটা ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অসম লড়াই। কিন্তু যারা মানুষের জন্য রাজনীতি করেন বা সামাজিক অধিকার রক্ষার লড়াই করেন, তারা চেষ্টাতো ছেড়ে দিতে পারেন না। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তাদের কাছে এইভাবে লড়াই করা ছাড়া আর কোনও পথও নেই।
আগে গ্রাম্য প্রভাবশালীদের রাজনৈতিক চরিত্র ছিল না। এখন হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের হলেতো কথাই নেই। গণমুখী রাজনীতির অনুপস্থিতিতে, অত্যাচারিত মানুষ যে যার নিজের মতো করেই লড়ছে। সবচেয়ে কঠিন সংগ্রামটা করছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এরা মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠির লক্ষ্যবস্তু, আবার সরকারি দলের নেতাদের লোভও থাকে এদের সম্পদের উপর।
সমস্ত টুকরো টুকরো লড়াইকে একসঙ্গে সংগঠিত করা খুব দরকার। সেই চেষ্টায় দরকার মধ্যবিত্ত সমাজটাকে সরব করা। এই কাজটা যদি ঠিকঠাক করা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে রাজনীতি করতে পারবে না। সমাজের চাপটা খুব জরুরি। অন্যথায় মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী রাজনীতি মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই অস্তিত্বহীন করে দেবে।
এইচআর/এমএস