কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা : ভাববার সময় এখনই
আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য "Mental health in the workplace" অর্থাৎ “কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য”। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা সবার জন্য সাফল্য বয়ে আনে। কর্মজীবন হয় সুশৃঙ্খল ও উজ্জ্বল। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানও উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করে। আমাদের প্রত্যেকেরই অবদান রাখতে হবে একজন দায়িত্ববান কর্মী হিসেবে। সুস্থ কর্ম পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে তাই মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
ধরুন, আপনার সহকর্মীর আপনজন কেউ মারা গেছেন। এতে তিনি মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছেন। তার সেই কষ্ট, দুঃখ বা মনের খারাপ অবস্থা আমরা বুঝতে পারি। সহকর্মীর সেই মানসিক যাতনার ভাগিদার হই আমরা। তার খোঁজখবর নিই। প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে ছুটি দেয়া হলে আমরা সহকর্মীর অতিরিক্ত কাজের বোঝাও বহন করি নির্দ্বিধায়। আপনজনের মৃত্যুটা এক্ষেত্রে দৃশ্যমান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই মনের অসুস্থতার কারণটা আমরা জানতে পারি না। হয়তো বুঝতে পারবো, সহকর্মী অন্য সবার মতো সমান গতিতে কাজ করছে না।
বার বার ভুল করছে, আগের চেয়ে বেশি বিমর্ষ থাকছে অথবা সামান্য কারণেই চিৎকার চেঁচামেচি করছে ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে আমরা কেউ কেউ তার ঘাড়ে চেপে বসি। মনের খারাপ অবস্থা, যেমন কেউ যদি বিষণ্নতার কারণে মনমরা, হতাশ থাকে, তখন আমরা তার কাছ থেকে দূরে থাকা শুরু করি অথবা তাকে দূরে ঠেলে রাখি। কখনও কখনও মনে করি, তার মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান থেকেও দু’রকম পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। একই ব্যক্তি যখন শারীরিক সমস্যায় পড়েন, তখন তার জন্য একধরনের নীতি; আবার সে যখন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়, তখন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার ক্ষেত্রে বিরূপ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। অনেক সময় সে চাকরিও হারায়। কেন এই বৈষম্য?
সাধারণত কেউ মানসিক কষ্টে থাকলে আমরা তা দেখতে পাই না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যক্তি নিজে কিছু বলেন বা তার আচরণে ব্যতিক্রম কিছু চোখে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যাগুলো আচরণে প্রকাশ পেতে দেরি হয়। সেক্ষেত্রে সমস্যা কাটিয়ে উঠতেও অনেক সময় লেগে যায়। এই দায়ভার কার? সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তির, নাকি আমাদের সবার? মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতাই পারে শুরুতেই সমস্যার সহজ সমাধান করতে। আসুন দেখা যাক, মন, মানসিক স্বাস্থ্য বলতে আমরা কী বুঝি।
সাধারণভাবে মন বলতে আমরা বুঝি, দেখা যায় না, ধরা যায় না বা ছোঁয়া যায় না, নিরাকার এমন একটা কিছু। চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সবকিছুই মনের মতো চাই। মনের মতো বাসা, মনের মতো স্বামী বা স্ত্রী, মনের মতো চাকরি, মনের মতো বন্ধু। অথচ এই মনের মতো বিষয়টা কি, সেটাই আমরা বুঝে উঠতে পারি না। নিজের ক্ষেত্রে কিছুটা বুঝলেও অন্যের ক্ষেত্রে তা অধরাই থেকে যায়। কারণ এটা অদৃশ্য।
মন হলো ব্যক্তির চিন্তা ও চেতনার এমন এক শক্তি, যা নিজের ভেতর ও বাইরের জগৎ সম্পর্কে তার ভাবনা ও অনুভূতিকে সজাগ রাখে। আর মানসিক স্বাস্থ্য হলো আমাদের চিন্তা, মন ও আবেগের সুস্থতা, শৃঙ্খলা ও সামর্থ্য। এটা এমন ভালো থাকা, যাতে একজন ব্যক্তি নিজের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক চাপ মোকাবিলা করে সাফল্যের সাথে সৃষ্টিশীল কাজ করে যেতে পারে এবং সামাজিক অঙ্গনে অবদান রাখতে পারে। এভাবেই মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও কাজে প্রভাব ফেলে। মানসিক সুস্থতার সাথে একটি জীবনের সাফল্য এবং ব্যাপক অর্থে গোটা সমাজের ভালো-মন্দ জড়িত। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রাথমিক দায়ভার প্রতিষ্ঠান, কর্মী, সবার। একজন কর্মী যখন সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিজের কর্মস্থল বেছে নেন, তখন নতুন পরিবেশের সাথে তার নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সহজ হয়। সেই কর্মী ওই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ব্যাপারে কিছু কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। মনে করা হয়, মানসিক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তি বা যিনি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিচ্ছেন, তারা কাজে-কর্মে অক্ষম। অথচ বাস্তবতা হলো, সুচিকিৎসার মাধ্যমে যে কোন সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তি কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। কোন কোন ক্ষেত্রে সুস্থ ব্যক্তির চাইতেও বেশি কর্মদক্ষতা দেখাতে পারেন তিনি। মানসিক সমস্যায় পড়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন জরুরি সেবায় নিয়োজিত কর্মী, স্বাস্থ্য সেবাদানকারী এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা, উদ্বেগজনিত সমস্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তাই তাদের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
অধিকাংশ কাজের ক্ষেত্রে কিছু মাত্রায় মানসিক চাপ থাকাটা স্বাভাবিক। বরং স্বল্প মাত্রার মানসিক চাপ কাজে সফলতা বাড়ায়। এই চাপ যুক্তিসঙ্গতও বটে। তবে মাত্রাতিরিক্ত ও দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ সমস্যার কারণ হতে পারে। প্রশ্ন হলো, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপকে কখন আমরা সমস্যা বলে মনে করবো? যখন কর্মীর দায়িত্ব ও প্রতিষ্ঠানের চাওয়া-পাওয়ার মাঝে ব্যাপক অমিল তৈরি হয়, হয়তো তিনি ওই কাজের জন্য নিয়োগপ্রাপ্তও হননি, যাতে তার কোন ভূমিকা থাকার কথা নয় এবং যে দায়িত্ব পালনে তার কাছে সরঞ্জাম ও সহায়তা নেই, তখনই ব্যক্তি অতিরিক্ত মানসিক চাপে পড়েন। দীর্ঘমেয়াদী এই চাপ তার মধ্যে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগজনিত সমস্যা তৈরি করতে পারে, যার ফলে তিনি বার বার কাজে অকৃতকার্য হতে পারেন। তাই শুরুতেই মানসিক চাপের লক্ষণ সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে যে সব শারীরিক লক্ষণ দেখা যায়, তা হলো- বুকে ব্যথা, ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, প্রায়ই ঠাণ্ডা লাগা, যৌন বিষয়ে আগ্রহ কমে যাওয়া, পেশি টানটান ও শক্ত অনুভব করা, মাথা ও শরীর ব্যথা, ঘন ঘন শ্বাস ফেলা, অতিরিক্ত ঘাম, ক্ষুধামন্দা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে মানসিক লক্ষণগুলো হলো- হতাশ লাগা, অসুখী ভাব, অসন্তোষ, আত্মবিশ্বাস হারানো, পাপবোধ, অনিশ্চয়তায় থাকা, নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা, চিন্তার দ্রুত পরিবর্তন হওয়া, একই চিন্তা বারবার করা, ভুলে যাওয়া, দুঃশ্চিন্তা ইত্যাদি।
সচেতন থাকলে নিজের মন ও শরীরের যত্ন নিয়ে আমরা এ সব সমস্যা কমিয়ে আনতে পারি। যেমন- ইতিবাচক চিন্তা করা, নিয়মমাফিক জীবন-যাপন, নিজের প্রশংসা করা, মানসিক চাপের কারণ চিহ্নিত করে তা মোকাবেলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া, প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানো, দু’একটি শখের অভ্যাস গড়ে তোলা, বেড়াতে যাওয়া, নেতিবাচক কাজ বাদ দেওয়া, প্রার্থনা করা, ক্ষমা প্রদর্শন করা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, শিথিলায়ন করা, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া, পরিমিত বিশ্রাম নেয়া, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, ব্যায়াম করা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো ইত্যাদি। এরপরও মানসিক চাপ যদি আমাদের জীবন-যাপনে খুব বেশি প্রভাব ফেলে, তবে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানকেও ভূমিকা রাখতে হবে।
মনোবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে চালু রাখতে হবে নিয়মিত সেবা কার্যক্রম। তবেই কর্মীরা নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণে উপযুক্ত পরিবেশ পাবে; বাড়বে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ; কমবে বৈষম্য। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের ধারাবাহিকতাও থাকবে অক্ষুণ্ণ।
লেখক: চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, ব্রেন অ্যান্ড লাইফ হসপিটাল।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম