সুন্দরী প্রতিযোগিতা : সর্ষের ভূত
বিয়ে কি একটি অযোগ্যতা, যা উদ্ঘাটিত হ'লে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়? এটি কেমন অপরাধ? এতে সুন্দরী এভ্রিলের মুকুট যদি হাতছাড়া হয়েই যায় তাতেই বা কি আসে যায়? যে প্রতিযোগিতায় একজন নারীর শরীরের উপর তার নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করা হয়, আমি মনে করি সে ধরনের প্রতিযোগিতায় জিতে যাওয়া মানে একজন নারীর মানুষ হিসেবে হেরে যাওয়া। নারী ক্ষমতায়নের নামে নারীর শরীরকে কটাক্ষ করারই নামান্তর।
পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। তবে প্রথম প্রতিযোগিতাতেই বিশাল গোল বেঁধে গেছে। আর সেই গোলযোগের কারণ হচ্ছে সুন্দরীর আগের বিয়ের কলংক ফাঁস! বাংলাদেশের আমজনতা এখন সুন্দরীর বিয়ের ভিডিও দেখে তাকে সত্য গোপনের দায়ে পারলে নারায়ণগঞ্জের রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছেন। চলুন আমরা নিজেরাও আমাদের প্রচলিত কিছু সামাজিক আচার বিষয়ে একটু সত্যি বলে দুধে ধোয়া তুলসী হই।
এই আমরা নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য আমাদের কন্যা সন্তানদের মাধ্যমিক এবং উচ্চমধ্যমিক পর্যায়ের আগেই বিয়ের নামে একরকম ঘার ধাক্কা দেয়ার মতো করেই উঠে পড়ে লেগে যাই। বিয়ে টিকুক আর নাই টিকুক একবার বিয়ে হলেই আমাদের যেন স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলি 'যাক বাবা বাঁচা গেলো'। বাবা মায়ের কাছে সুপাত্র হলেও প্রেমের বিয়ে না মেনে নেয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে যেন একটি সামাজিক অহংকার হিসেবেই আমরা দেখি। অথচ মেয়ের মনের অবস্থা চিন্তা না করে একটি অপরিচিত পরিবারের কারি কারি মানুষের সামনে আমাদের নিজেদের উচ্চশিক্ষিত কন্যা সন্তানকেও পা, চুল, গায়ের রঙ, হাঁটাচলার পরীক্ষা দিতে বাধ্য করি। এই আমরাই নিজেদের কন্যা সন্তানকে যথা সময়ে বিয়ে না হ'লে 'আইবুড়ি' হিসেবে তিরস্কার করি, কটাক্ষ করি। আবার এই আমারাই নিজের কন্যা শিশুসন্তানকে বয়স্ক লোকের সাথে বেঁধে রেখে তাকে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য করি।
এই আমাদের মতো পিতামাতার কথা অমান্য করার কারণে শারমিন নামের বরিশালের মেয়েটি যখন পালিয়ে গিয়ে নিজের পিতামাতার নামে মামলা ঠুকে দেয়,তখন আমরা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলি বাবা-মা কি সন্তানের কখনোই অমঙ্গল চাইতে পারে? এই আমরাই শারমিনকে খারাপ, অবাধ্য বেয়াদব মেয়ে বলেছিলাম। এরপর এই শারমিনের কারণেই মেলানিয়া ট্রাম্প এর হাত হতে সাহসিকতার পুরস্কার গ্রহণ করে বিশ্বের কাছে এই আমরাই সাহসিকতার আইকন হতে পেরে গর্বিত হয়েছিলাম।
পাপ পুণ্যের কথা আমি কারে বা সুধাই! আমাদের দেশে যা বেয়াদবী, উন্নত দেশে তাই সাহসিকতা! কথা উঠেছে সুন্দরীর সত্য গোপন করে প্রতারণার আশ্রয় প্রসঙ্গে। আজ একটি কলামেও দেখলাম একজন নারী লেখক বলেছেন 'সুন্দরী সত্য গোপন করার দায় এড়াতে পারেন না'। সে ক্ষেত্রে শর্ত ভঙ্গ অবশ্যই অন্যান্য প্রতিযোগীদের জন্য ভাগ্য নির্ধারণের একটি বড় বিষয়। কারণ যারা এই প্রতিযোগিতার কোন শর্তই ভাঙেনি, তাদের জন্য এভ্রিলের বিয়ের সত্য গোপনের বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যথায় তাদের প্রতিও অবিচার করা হয়ে যাবে।
চলুন, বিয়ে বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখি। বিয়ে একজন মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত একটি বন্ধন। বিয়ের পর সম্পর্ক টেকানো বা না টেকানোর অধিকার একজন মানুষ মাত্রেরই মৌলিক অধিকার। সে সম্পর্কে বিয়ের পর স্বামীর সাথে একজন নারী জীবন যাপন করেছেন বা করেন নাই বা স্বামীর সাথে তার বোঝাপড়া হয়েছে বা হয়নি, তিনি স্পর্শিত না অস্পর্শিত সেই সম্পর্কের প্রমাণ কোন স্বীকৃত সামাজিক প্রতিযোগিতার শর্ত হতে পারেনা। এই শর্ত ঘৃণ্য, অমানবিক, অরুচিকর এবং সর্বোপরি নারীর জন্য অবমাননাকর। অবিবাহিত থাকার শর্তটি নারীর সৌন্দর্য এবং নারীর অস্তিত্বের প্রতি অত্যন্ত অসম্মানজনক। একজন নারীর প্রজনন ক্ষমতা তার এক অনন্য সৌন্দর্য। কোনভাবেই সে ক্ষমতাকে ছোট করা মানে নারীর চিরায়ত সৃষ্টিশীলতাকে অবজ্ঞা করা।
২০১৫ সালের মিস নিউজিল্যান্ড সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজকরা বিয়ে, সন্তান ধারণ বা গর্ভপাতের বিষয়গুলোকে সুন্দরী প্রতিযোগিতার শর্ত হিসেবে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারণ তাঁরা মনে করছেন পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। বদলে যাওয়া পৃথিবীর নতুন নতুন পরিপ্রেক্ষিত গুলোকে বিবেচনায় আনতে প্রতিনিয়তই বদলাতে হবে আমাদের পুরানো আইনকানুন এবং মানসিকতা।
এক সময় রুপান্তরিত হওয়া মেয়েরা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারতেন না । এখন বেশ কয়েকটি দেশেই সে শর্ত শিথিল করেছে। কারণ এ ধরনের শর্ত প্রতিযোগীদের জন্য শোভনীয় ও যৌক্তিক নয়। এমন কথা কি বলা যায় না যে, একজন মানুষ সে নারী হোক বা পুরুষ হোক সমস্ত প্রতিকূলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যদি সে শুধু তার পরিশ্রম, মেধা, আর যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সাফল্যর মুকুট ছিনিয়ে নেয়, তবে আমরা কেনো ফেলে আসা অতীত দিয়ে তার যোগ্যতা পরিমাপ করবো? এ ধরনের প্রতিযোগীতার আয়োজন নারীর যোগ্যতার পরিমাপের জন্য কি অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়? তাছাড়া একজন মানুষের ফেলে আসা বৈবাহিক জীবন কি কখনো কলংক হতে পারে? যে কোন চাকরি বা প্রতিযোগিতা তা যে কোন ক্ষেত্রেই হোক না কেনো, শর্ত হচ্ছে সেই পেশা বা পারফরমেন্স এর জন্য এমন একটি যোগ্যতা বা গুণ যার অনুপস্থিতিতে সে কাজটি সম্পন্ন করা সহজ নয়। সেটি শারীরিক বা বুদ্ধিভিত্তিক যাই হোক না কেনো। আমরা অনেকেই জানি যে এয়ারলাইন্স পেশায় ফ্লাইট স্টুয়ারডেস এর চাকরিতে নারীদের অবিবাহিত হওয়ার একটি শর্ত ছিলো ।
১৯৩৫ সালে এয়ারলাইন্স এর এ পেশার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রান্সকন্টিনেন্টাল এবং ওয়েস্টার্ন এয়ারলাইন্স মহিলাদের ৪৩টি পদের জন্য শুধু অবিবাহিত নারীদের আহ্বান করে। সে সময় তা অনেকের মধ্যে এ শর্তের কারণে হতাশার সৃষ্টি করেছিল। কালের পরিক্রমায় এয়ারলাইন্স ইন্ডাস্ট্রি তাদের ভুল শুধরে নিয়েছে । ১৯৮০ সালে নারী কর্মীদের অবিবাহিত থাকার শর্তটি বাতিল করা হয়। হয়তো আমাদের দেশেও এই অশোভন শর্তটি আত্মমর্যাদার প্রশ্নে বিশদভাবে আলোচিত হবে এবং এরুপ হীন যোগ্যতাকে বিচারক এবং আয়োজকরা বাতিল করতে শিখবে। আর আমরাও সেই মেয়েকেই যোদ্ধা হিসেবে চাইবো যে নারী স্রোতের বিপরীতে ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে শিখবে।
যে মেয়ে শারমিনের মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়াবে নিজের বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। আমরা দেখেছি এভ্রিল নামের এই মেয়েটি একটি সাধারণ দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসে নিজেকে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশের সেরা উইমেন বাইক রাইডার হিসেবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এভ্রিল নামের মেয়েটির সাফল্যের এই বিষয় নারীর জন্য শেকল ভাঙার গান। এভ্রিল মেয়েটি সুন্দরী প্রতিযোগিতার মুকুট হারালেও তার জন্য আমার এক বিন্দুও বা আফসোস নেই। কারণ এই মেয়েটি যখন পুরুষের মতো প্রচণ্ড প্রতাপে বাইক চালিয়ে সকলকে পেছনে ফেলে সফল হতে পেরেছে, তখন আমি এভ্রিলের মতো মেয়েদের মধ্যে অসম্ভব লুকায়িত সম্ভাবনার প্রত্যয় দেখতে পেয়েছি ।
আমাদের দেশের নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে তার এই অর্জনকে উদাহরণ হিসেবে কাজে লাগানো যায়। মেয়েটি যেভাবে বাইক রাইডার হিসেবে আত্মবিশ্বাসের সাথে নারীর প্রতিনিধি হিসেবে একটি অনন্য উচ্চতায় তার অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে,তাতে আমার মনে হয় নারী নিপীড়ন আর ধর্ষণের এই আকাল সময়ে খুব সহজেই সে নারী ও শিশুর আত্মরক্ষার আইকন হয়ে গড়ে উঠতে পারে। যা হোক, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিবাহের এই শর্তটি শিথিল করা হলে যে সকল মেয়েরা বাল্যবিবাহ বা অনাকাঙ্খিতভাবে গর্ভপাতের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে সকল মেয়েরা মাথা উঁচু করে বাঁচার সাহস পাবে।
লেখক : কলামিস্ট। বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত।
এইচআর/পিআর