রোহিঙ্গা নবজাতকের নাগরিকত্ব কি হবে?
১৯৮৩ সালের আগে ব্রিটেনে কারো জন্ম হলেই জন্মসূত্রে তাকে ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো। আর এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই তার গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে ইংল্যান্ড ভ্রমনে চলে আসতেন। বিমান বন্দরেও তাই গর্ভবর্তীদের ভ্রমণ করতে দেখলেই সন্দেহের চোখে দেখা হতো। ব্রিটেনে সন্তানের জন্ম হলেই ব্রিটিশ নাগরিক হবে এমন ধারণা থেকে অনেক ইমিগ্র্যান্ট পরিবারের মধ্যে অধিক সন্তান নেওয়ার প্রবণতাও ছিলো লক্ষ্যণীয়।
১৯৮৩ সালের পর ব্রিটেন জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব প্রথা তুলে দেয়। চালু হলো পিতা মাতার কেউ একজন অন্তত নাগরিকত্ব বা স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি না থাকলে সন্তানও ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাবে না। অথবা ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া শিশুটি অন্তত সাত বছর ব্রিটেনে বসবাস করার পর ব্রিটেনে থাকার অনুমতি পাবে। ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জটিল বিষয়টি নিয়ে আজ বিশদ আলোচনা করতে চাই না। তবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনটি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আইনের অনুসরণে তৈরি করা বিধায় শুরুতেই ব্রিটিশ নাগরিকত্বের বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসলাম পাঠকদের সুবিধার জন্য। সম্প্রতি রোহিঙ্গা নবজাতকদের নাগরিকত্ব নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে বলেই এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ধারণা পরিস্কার হওয়া দরকার।
নোম্যান্স ল্যান্ডে বা শরণার্থী ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা নবজাতকদের পরিচয় কি হবে? আসলে এই প্রশ্নটির মধ্যেই উত্তর রয়েছে। রোহিঙ্গা পিতা-মাতার সন্তান রোহিঙ্গাই তো হবার কথা, তাদের তো বাঙালি হবার কথা না! এই শিশুরা তাহলে কোন দেশের নাগরিক? উত্তর হলো, রোহিঙ্গারা যে দেশের নাগরিক তারাও সেই দেশের নাগরিক, বলছিলেন ব্রিটেনের অভিবাসন বিশেষজ্ঞ তাজ শাহ। লন্ডনে তাজ শাহ টেলিভিশনের মাধ্যমে আইনি পরামর্শমূলক অনুষ্ঠান করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন।
তাজ শাহ বললেন, রোহিঙ্গা শিশুদের বাবা-মা উভয়ই যদি বাংলাদেশের নাগরিক না হন, তাহলে বাংলাদেশ সীমান্তে বা শরণার্থী ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া শিশুটির নাগরিকত্বও তার বাবা-মায়ের নাগরিকত্বের উপর নির্ভর করবে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪ শ' শিশু নোম্যান্স ল্যান্ডে বা শরণার্থী ক্যাম্পে জন্ম নিয়েছে এবং রোহিঙ্গা গর্ভবর্তী নারীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এই ৪ শ' নবজাতক ও জন্মের অপেক্ষায় থাকা সেই ২০ হাজার শিশুর নাগরিকত্ব হবে তাদের বাবা-মায়ের নাগরিকত্ব যে দেশের, সেখানেই।
ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজির তথ্য অনুয়ায়ী রোহিঙ্গারা আসলে দেশহীন। মিয়ানমারে যে ১৩৫ টি ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা রয়েছে সেই ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার তালিকায় রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের সুপারিশ গুলোর অন্যতম হলো রোহিঙ্গাদের জাতিগত স্বীকৃতি প্রদান। বাংলাদেশে আসার আগে থেকেই রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে দেশহীন হিসেবে বসবাস করে আসছিলো। ব্রিটেনের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী ব্যরিস্টার মনোয়ার হোসেন বলছেন, রোহিঙ্গারা যেহেতু দেশহীন তাই তাদের সন্তান ও তাদের পরিবারে জন্ম নেওয়া ভবিষ্যতের সন্তানটিও দেশহীন হয়ে জন্ম নেবে। সে যেখানেই জন্ম নিক, সেটি হতে পারে মিয়ানমার, বাংলাদেশ কিংবা নোম্যান্স ল্যান্ড অথবা শরণার্থী ক্যাম্পে। তাহলে এই রোহিঙ্গারা তো বাংলাদেশে বছরের পর বছর থাকছে, সম্প্রতি আসা ৫ লাখ রোহিঙ্গা কবে মিয়ানমার সরকার ফেরত নেবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
অনন্তকাল কি এই রোহিঙ্গারা দেশহীন থেকে যাবে? সেই সূত্র ধরে আবারো ব্রিটেনের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ব্রিটেনে রিফিউজিরা ৫ বছর থাকার পর স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করতে পারে। সেই অর্থে আরো এক বছর ন্যাচারালাইজেশন করার পর সে নাগরিকত্ব পেতে পারে। তাছাড়া একজন রিফিউজির নাগরিক হিসেবে সকল প্রকার সুবিধা পাবার অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে জেনেভা কনভেনশনে।
ব্রিটেন রিফিউজি অ্যাক্ট ১৯৫১ ও জাতিসংঘের ট্রিটি ১৯৬৭-এ স্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ায় শরণার্থী নিতে বাধ্য এবং শরণার্থীদের নাগরিক সুবিধা দেওয়ার ব্যপারেও ব্রিটেনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই বিশ্বের যে সকল দেশ জাতিসংঘের এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছে তারাই রিফিউজি নিতে বাধ্য থাকবে এবং চুক্তি অনুযায়ী শরণার্থীদের সকল সুবিধা দেবে। বাংলাদেশ যেহেতু এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশ না, তাই রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে মানতে বাংলাদেশ বাধ্য নয়। তেমনি এই শরণার্থীরাও ভবিষ্যতে বাংলাদেশে রিফিউজি হিসেবে সকল নাগরিক সুবিধা দাবি করতে পারবে না।
ব্যরিস্টার মনোয়ার হোসেন একটা 'কিন্তু'র কথা মনে করিয়ে দিলেন।১৯২৬ সালের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আইন যেটা পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সংশোধিত হয়েছে, সেখানে বলা আছে, বাংলাদেশ সরকার চাইলে যে কোনো দেশের নাগরিককে তার অবস্থা বিবেচনা করে নাগরিকত্ব দিতে পারে। এখন রোহিঙ্গাদের অবস্থা বিবেচনা করে সরকার এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শিশুদের নাগরিকত্ব দেবে কিনা সেটি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের বিবেচনার বিষয়। তবে এই শিশুরা যদি ৭ বছর বাংলাদেশে অবস্থান করে তাহলে তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে।
এছাড়াও বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্বের বিধান রয়েছে বাংলাদেশে। কোনো রোহিঙ্গা যদি কোনো বাংলাদেশি নাগরিককে বিয়ে করে এবং তাদের সন্তান জন্ম নিলে তাদের নবজাতক বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পাবে। তবে সরকারের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার ব্যপারে এক ধরনের নজরদারির কথা শুনেছি। এটির আইনগত দিক নিয়ে আলোচনার সুযোগ আছে বটে। তবে শুধু রোহিঙ্গাদের বিয়ের ব্যপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ না করে সরকার যদি বিদেশী নাগরিক বা স্টেইটলেস পিপলদের সাথে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিবাহ বন্ধনে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে তাহলে রোহিঙ্গা-বাঙালি মিথ্যে বিয়ে (শ্যাম ম্যারেজ) ঠেকানো যাবে। তবে এই রোহিঙ্গারা যে খুব সহসা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না সেটি নিশ্চিত।
কূটনৈতিক দর কষাকষিতে যদি ৫ বছর কিংবা ৭ বছর সময় লেগে যায় তাহলে ভবিষ্যতে এই ১০ লাখ রোহিঙ্গা দ্বিগুণ হতে খুব বেশি সময় নেবে না। জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকা এই রোহিঙ্গাদের তখন নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি ভোটের অধিকারের দাবি চাওয়া অবাস্তব কিছু হবে না।
লেখক : কারেন্ট এফেয়ার্স এডিটর, চ্যানেল এস টেলিভিশন লন্ডন ও যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি একাত্তর টেলিভিশন।
এইচআর/পিআর