কী হবে যদি পৃথিবী বাসযোগ্যতা হারায়?
উত্তর কোরিয়ার ‘মিসাইল ম্যান’ আর আমেরিকার ‘মিসটেকেনলি ইলেকটেড প্রেসিডেন্ট’ কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাকাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছেন। নিউক্লিয়ার শক্তির মহড়া দেখানোর প্রতিযোগিতায় চীন-জাপান-ইরান-পাকিস্তান-ভারত ‘এলাম বলে’ভাব দেখাচ্ছে বেশ। জাতিগত গণহত্যা করেও মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং লাইং ইজ কন্টিনিউয়াসলি লাইং। সৌদি যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ছে ইয়েমেনের হাসপাতালে। উট পাখিসম সংঘ-গোষ্ঠীর মুরব্বিপনা মুখ গুঁজে আছে বলে সিরিয়ান শিশু আয়লান নিথর দেহ নিয়ে বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে।
পৃথিবীতে খাদ্যের কোন অভাব না থাকলেও আফ্রিকান শিশুরা দুর্ভিক্ষের আঁচে পুড়ছে বছরের পর বছর। অর্থনৈতিক যুদ্ধ শেয়ার মার্কেটের ধস, ব্যাংকের টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়ার মতো দুর্বিপাক বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মনে করিয়ে দেয় ‘কাঁচকলা’ নামে উপাদেয় এক সবজি আছে বটে বাজারে এখনো। আর মাথার উপরে গনগনে সূর্যটা তো আরও তপ্ত হয়ে ঘন্টা বাজিয়ে দিচ্ছে বারোটার। সব মিলিয়ে এই পৃথিবী যে খুব বেশি দিন বাসযোগ্য থাকছে না, তা বুঝতে পারাটা কঠিন কাজ নয়। তবে যতটা সময় লাগবে বলে ভেবেছিলাম আমরা, বিজ্ঞানীরা বলছেন, আসলে তার চেয়েও অনেক অনেক দ্রুততার সাথে পৃথিবীর বারোটা বাজছে। আজকে যে কিশোর, তার জীবদ্দশায় ঘটনাটি ঘটবে না তো! পুরো পৃথিবীটা যদি আগুনমুখো চুলো হয়ে যায়, সাগরের উচ্চতা আশংকানুযায়ী সেই রকম বেড়ে গেলে কী হবে? নিজে বাঁচলে বাপের নাম বলেই আর সব প্রাণের কথা বাদ দিয়ে মানুষকূলের কথাই ভাবতে চাইছি। এই চুলো বানানোর কৃতিত্ব যে মানুষের, তাদের কী হবে যদি পৃথিবীটা বাসযোগ্যতা হারায়?
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যত কথাই হয়, তাতে কখনোই সময়সীমা নিয়ে কিছু বলা হয় না। কবে আসবে রোজ কিয়ামত? গত বছরের শীতকালটায় কীরকম গরম পড়েছিল, তা সচেতনভাবেই ভুলে থাকছি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আয়েশে। উত্তর মেরুতে তো আর আমার পা পড়েনি, কাজেই ওখানে বরফ গলছে শুনতে পেলেও এ কান ও কান করে কথাগুলো উড়িয়ে দিয়েছি। ওদিকে নরওয়েতে সত্যিই কিন্তু বীজ সংরক্ষণের ভল্ট তৈরি করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডুম’স ডে’ বা ‘রোজ কেয়ামত’, যেখানে মহাবিপর্যয়ে যদি পড়তেই হয়, তার পরের দশ বছর গোটা পৃথিবীর মানুষদের মাঝে খাদ্যশস্য বিতরণ করা সম্ভব হবে।
এ খবর শুনে হা হা করে হেসেছেন যমদূত। কেননা, তিনি জানেন, উত্তর মেরুর ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত অঞ্চলে ১.৮ ট্রিলিয়ন টন কার্বন জমা আছে, যা কিনা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে থাকা কার্বনের দ্বিগুণেরও বেশি আর যদি এই পরিমাণ কার্বন মুক্ত হয়, তবে এটি মিথেনের বাষ্প হয়ে উদগারিত হবে, যা কিনা পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তোলা গ্রিন হাউজ গ্যাসগুলোর চেয়েও চৌত্রিশ গুণ বেশি হবে পরিমাণে। আর্কটিক অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত কার্বনের ফাঁদ ঘিরে রেখেছে আমাদের, যেদিন মুক্তি পাবে, সেদিন এই হিম মৃত্যু বাষ্পের আকার নিয়ে পৃথিবী এখন যতটা উত্তপ্ত, তার চেয়ে ৮৬ গুণ বেশি উত্তপ্ত করে তুলবে।
এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে চোখ-কান খোলা রেখে সাম্প্রতিক কালের স্যাটেলাইট ডাটা কি বলছে, জেনে নিন না। ১৯৯৮ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার যে গতিতে বাড়ছিল, তা এখন দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। এ বছরের মে মাসে অ্যান্টার্কটিকায় এক বিশাল বরফের চাঁই ফাটল ধরিয়ে গলতে শুরু করে বলে স্যাটেলাইট ডাটা থেকেই জানা গেছে। এরপরও বোধে স্পন্দন নেই, কেননা দু’দশক ধরে হলিউডের জম্বি মুভিগুলো দেখতে দেখতে আমরা মৃত্যুকে ভয় পেতে ভুলে গেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের আতঙ্ক সামষ্টিক হয়ে গিয়ে এখন আর ব্যক্তিকে আলোড়িত করতে পারছে না। আর ট্রাম্প বাবাজি যখন ‘মরবই যখন আয়েশ করে মরি’ তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ভোগবিলাস চলমান রাখার সুবিধার্থে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা না কমানোর ঘোষণা দিয়ে প্যারিস চুক্তি থেকে সরে এলেন, তখন বাকিরা তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলছেন, আমেরিকা মুরব্বির কথার উপরে কথা থাকতে নেই।
যেহেতু কথা নেই, সেহেতু কোমর বেঁধে পারমাণবিক বোমা কে কত জোরে বিস্ফোরিত করতে পারে, তার পরীক্ষা করলে দোষ কি? মরবই যখন, মরার আগে জানিয়ে যাই আমিই সবচেয়ে বড় বাপের ব্যাটা ছিলাম। ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর পরিবেশ যদি কখনো আবারো থিতু হয়, নতুন প্রাণের উদ্ভব হয়, তখন তারা যদি গবেষণা করে জেনে নেয় পুরাকালের সেরা বীর কে বা কারা ছিলেন, তাহলে বেশ হয়, তাই না? বুঝতে পেরেছেন তো, কেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জন উন পারমাণবিক রসদবাহী মিসাইল আকাশে ছুঁড়ে শিশুর মতো হাততালি দিয়ে ওঠেন কেন, কেনই বা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকা কেবলি আমেরিকানের বলে অ-আমেরিকানের বুকে ঘৃণার তীর ছোঁড়েন কেন, কেনইবা আইএসএস-তালেবান-বোকো হারাম-দের জন্ম হয়, কেনই বা মিয়ানমার রোহিঙ্গা নামক এক গোটা জাতিকে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলার অমানবিক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সভ্য সমাজে তা নিয়ে বড়াইও করে। পিপীলিকার পাখা ওঠে মরণের তরে, মনে পড়ে গেছে, তাই না?
বৈজ্ঞানিক সত্য আর কল্পকাহিনীর মাঝখানে বাস করতে করতে কল্পবিজ্ঞানকেই বিজ্ঞান হয়ে উঠতে দেখছি এ কালে। আর তাই মিয়ামি আর বাংলাদেশকে একই টেবিলে ফেলে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা, আগামী শতক আসতে আসতে এই দু’টি এলাকার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঠেলায় টিকে থাকার সুযোগ কতটুকু আছে, তা নিয়ে। পৃথিবী এর আগে আরও পাঁচবার বিপুল বিলুপ্তির মাঝ দিয়ে গেছে, যার কোনটিই মানুষের চোখের সামনে ঘটেনি। এবার ঘটবে। উল্কাপাতের আঘাতে ডায়নোসরদের মৃত্যুর কাহিনী যে শিশু এখন ক্লাশের বইয়ে পড়ছে, তাকে ভাববার একটু সুযোগ কি দেওয়া যায় না যে, ডায়নোসরের মৃত্যুর কারণ উল্কাপাত নয়, হয়তো সেবারও গ্রিনহাউজ গ্যাসই আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল।
২৫২ মিলিয়ন বছর আগে কার্বন গ্যাসটি পৃথিবীকে পাঁচ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করেছিল, তখন আর্কটিক মিথেন মুক্তি লাভ করে পৃথিবীর সে সময়কার প্রাণের শতকরা ৯৭ ভাগকে বিলুপ্ত হতে বাধ্য করেছিল। খেয়াল করুন, ডায়নোসররা কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করতো না, ওরা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ। সে জায়গায় আমরা মানুষরা তো কার্বন বেটাকে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করতে খুব সাহায্য করছি। স্টিফেন হকিং এ কারণেই তো মানুষকে আগামি শতক আসার আগেই অন্য গ্রহে কলোনি তৈরি করতে বলেছেন, আর সে কথা শুনে বিজ্ঞানী এলন মাস্ক জানিয়েছেন, আগামী ৪০ থেকে ১০০ বছরের ভেতর মঙ্গল গ্রহে বাসাবাড়ি বানিয়ে ফেলার দারুণ পরিকল্পনা করে ফেলেছেন তিনি।
মানুষের যা স্বভাব, এরপর কাড়াকাড়ি শুরু হবে মঙ্গল বা বাসযোগ্য গ্রহের জমি দখল করা নিয়ে। বরাবরের মতোই শক্তিশালী যারা, তারাই স্বর্গে যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প-কিম জন উন-শি জিনপিং-শিনজো আবে-ভ্লাদিমির পুতিন-সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাগণ পৃথিবী ছেড়ে গেলে আপনি আমি খুশি হলেই বা কি, বলুন? পৃথিবীতে যারা রয়ে যাব, তারা বাঁচব কী করে?
লেখক : শিশুসাহিত্যিক।
এইচআর/জেআইএম