একাত্তরে শেখ হাসিনা : জীবনের অর্ধেকটা কেটেছে প্রতিকূল স্রোতে
একাত্তর বছরে পা দিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পেছনে ফেলে আসা সত্তর বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় তিনি প্রতিকূল স্রোতে নৌকা বেয়ে চলেছেন। বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, সহযাত্রীদের ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা উষ্ণ রক্তে স্নাত হয়েছেন, বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। তবু থামেনি তাঁর অভিযাত্রা। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে এক বৈরি সময়ে তিনি নৌকার হাল ধরেছিলেন। তাঁর অনভিজ্ঞ কিন্তু সাহসী আর দৃঢ় হাতেই ডুবন্ত নৌকা জাগতে শুরু করে। বহু ঝড়ঝাপটা সামলে, বিপদসঙ্কুল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তিনি নৌকাকে নিরাপদে তীরে ভিড়িয়েছেন। একবার নয়, বারবার। কালের পরিক্রমায় নৌকা সওয়ারীদের কাছে আজ তিনিই শ্রেষ্ঠ কান্ডারি।
শেখ হাসিনার জীবনগাথা যেন এক রুপকথার গল্প। দুঃখিনি রাজকন্যার দুঃখকষ্ট, রোমাঞ্চকর নানা ঘটনার কোনটিরই ঘাটতি নেই তাঁর জীবনে? তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। মানুষের শ্রদ্ধা, ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন তাঁরা পুরো পরিবার। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে হত্যা করল সেনাবাহিনীর বিপথগামী একটি অংশ, রাতারাতি চারপাশটা বদলে গেল শেখ হাসিনার। তিনি ও তাঁর বোন শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু তাদের জীবনে নেমে আসে এক দুর্বিষহ সময়। শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘যারা তাঁর পিতার করুণায় নিজেদের আখের গুছিয়েছেন এমন মানুষেরাও (কিছু ব্যতিক্রমী ছাড়া) মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ এদেশ, সেদেশ ঘুরে শেষে বোনসহ শেখ হাসিনার আশ্রয় মেলে ভারতে। সেখানেই ৬ বছর আশ্রিত জীবন কাটাতে বাধ্য হন জাতির জনকের কন্যা।
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তিনি। এর আগেই ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। জাতির জনককে হারিয়ে তখন ধুকছে আওয়ামী লীগ। দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বিধ্বস্ত এ দলটিকে পুনর্গঠন করা তরুণ শেখ হাসিনার জন্য সহজ কাজ ছিল না। একদিকে সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই, অন্যদিকে দলকে সংগঠিত করা। একদিকে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ ও অন্যদিকে পুরুষ শাসিত সমাজে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। এর উপর দলের অভ্যন্তরেও কম বয়সী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা। ফলে দলে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাও ছিল তাঁর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এসব কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো একযোগে মোকাবেলা করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তিনি বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্য্যের সঙ্গে একে এক সব বাধাই ডিঙ্গিয়ে গেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করতে না পারলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ (যদিও বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে)। এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বাধিক সময় দায়িত্ব পালনের রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন তিনি। ৩ মেয়াদে প্রায় ১৪ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। তিনি এ সময়কালে দেশের চমকপ্রদ বহু উন্নয়ন করতে সফল হয়েছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন, ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করে ছিটমহল সমস্যার সমাধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অনন্য অর্জন।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগানকে সামনে রেখে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ হাসিনার দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্যে দিয়েই মূলত উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণের এক অবিশ্বাস্য যাত্রা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন শেখ হাসিনা। তিনি ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের আগেই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। এরই মধ্যে সেই লক্ষ্য পূরণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। এ উন্নয়ন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। শেখ হাসিনা তাঁর কর্মের জন্য পেয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, সম্মাননা ও পুরস্কার। সম্প্রতি মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞের শিকার কয়েকলাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া ও তাদের পাশে দাঁড়ানোয় বৃটিশ গণমাধ্যম শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ নামে আখ্যা দিয়েছে।
শেখ হাসিনার এতসব অর্জনের পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনাকে কমপক্ষে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। এসব হামলায় প্রতিবারই শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী হতাহত হয়। সবচেয়ে নিকৃষ্টতম হামলাটি চালানো হয় বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ও গুলি চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও মারা যান ১৯ নেতাকর্মী। পঙ্গু হয়ে যান কয়েকশত নেতাকর্মী।
ক্ষমতায় থেকেও শেখ হাসিনার স্রোতের প্রতিকূলে নৌকা বাওয়া থেমে নেই। সরকার প্রধান হিসেবে তিনি যেভাবে মানুষের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, তেমনটা দেখা যাচ্ছে না আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ মন্ত্রী, এমপির ক্ষেত্রে। বেশির ভাগ মন্ত্রী, এমপি, নেতারাই ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে। তিনি বারবার তাগিদ দিলেও মন্ত্রী, এমপিরা জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও রয়েছে তুঙ্গে।
অন্যদিকে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখনো দেদার দুর্নীতি চলছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান থেকে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এগিয়ে আসছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। সে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়া এবং সেখানে জয়লাভ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জনবিচ্ছিন্ন মন্ত্রী-এমপি আর তৃণমূলে কোন্দলে জর্জরিত সংগঠন নিয়ে সে চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে শেখ হাসিনাকেই দেখাতে হবে নতুন কোন চমক। আমরা সেই চমক দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
শুভ জন্মদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/আরআইপি