ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কূটনৈতিক সফলতা পেলেও রোহিঙ্গা-রাজনীতিতে শেখ হাসিনা সফল হবেন কি?

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ০৪:০৩ এএম, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনা যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে আমলে নিতে শুরু করেছে তার প্রমাণ হলো, এই প্রস্তাব দেওয়ার মাত্র একদিনের মাথায় নিরাপত্তা পরিষদে নতুন করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে যে, শেখ হাসিনার প্রস্তাব ও এর সম্ভাব্য প্রয়োগ নিয়ে আলোচনাই হবে নিরাপত্তা পরিষদে। সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনার রোহিঙ্গা-কূটনীতি যে সফলতার মুখ দেখতে যাচ্ছে তাতে আরো সন্দেহ থাকে না এ কারণেই যে, চীন ও ভারতও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের সাবেক অবস্থান থেকে ক্রমশঃ সরে আসছে কিনা সে প্রশ্নও এখন সাধারণ মানুষের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে।

এর আগে চীন ও ভারত যেভাবে মিয়ানমারের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিল এবং রাশিয়াও তাতে সুর মিলিয়েছিল তাতে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা-বিরোধী রাজনৈতিক মহল প্রকাশ্যেই ঢোল পেটাতে শুরু করেছিল যে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে এবং শেখ হাসিনার রোহিঙ্গা-কূটনীতি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই চীনা রাষ্ট্রদূতের টেকনাফে গিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোনালাপের পর এই ঢোলকধারীদের গলার স্বর একটু হলেও ম্রিয়মান হতে থাকে। কিন্তু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গিয়ে শেখ হাসিনা যখন রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে একেবারেই একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন এবং সর্বত্রই আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন তখন কারো কারো আশার গুড়ে ছাই পড়ে এটা ভেবে যে, তার মানে কি শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুরও একটি আন্তর্জাতিক মানের সমাধান করে ফেলতে যাচ্ছেন? তিনি কি তবে রোহিঙ্গা-রাজনীতিতেও তার বিরোধীদের মুখে ঝামা ঘঁষে দিতে সফল হয়ে যাচ্ছেন?

টেলিভিশন খুললেই টক শো’য় অংশগ্রহণকারীরা এতোদিন মুখে ফেনা তুলে ফেলছিলেন এই বলে যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ কূটনৈতিক ভাবে ব্যর্থ এবং আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। এমনকি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলটির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক-এর সদস্যরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে যতোগুলো গোলটেবিল বা আলোচনা অনুষ্ঠান করেছেন প্রত্যেকটিতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বার বার এ প্রশ্নই তুলেছেন যে, বাংলাদেশ তথা শেখ হাসিনা কেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে শক্তি প্রয়োগে পিছিয়ে পড়ছে? তারা কোনো রকম সূত্র উল্লেখ ও প্রমাণ ছাড়াই কাল্পনিক ১৭/১৮ বার মিয়ানমারের সেনা-বিমান বাংলাদেশের আকাশসীমা লংঘন করেছে বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে শক্তিহীন, নতজানু ইত্যাকার নেতিবাচক অভিধায় অভিযুক্ত করে দেশের মানুষকে উস্কে দিতে চেয়েছে।

তারা যে এসব বলে বাংলাদেশের সেনা বাহিনীকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে চেয়েছে সেটি বোঝার জন্য রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হতে হয় না, সাধারণ বুদ্ধিতেই সেটা বোঝা যায়। কিন্তু সরকার ও সেনা বাহিনী তাদের এই ক্রমাগত উস্কানিতে কোনো ভাবেই উত্তেজিত হয়নি, বরং বিষয়টিকে কূটনৈতিক ভাবে কীভাবে সমাধান করা যায় সে পথই খুঁজেছে দৃঢ়ভাবে, যার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনার রোহিঙ্গা-কূটনীতির ভেতর। এছাড়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ও সংস্থাগুলিসহ ভারত ও চীনের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক আলোচনা বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য একই সঙ্গে সাহায্য-সহযোগিতা প্রার্থনার সঙ্গে তাদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে বাংলাদেশ যে খানিকটা হলেও সফল হয়েছে সেকথা এখন জোর দিয়েই বলা যায়। কারণ ইতোমধ্যেই মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া ছাড়াও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মুখ খুলেছে, এতোদিন যেকথা তারা স্বীকারও করেনি।

কিন্তু বাংলাদেশ মিয়ানমারের এই প্রস্তাবে এখনও সাড়া দেয়নি কারণ বাংলাদেশ মনে করছে যে, আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুটির একটি স্থায়ী ও টেকসই সমাধানে কী করে পৌঁছানো যায় সেটি নিশ্চিত করতে। এ জন্য কেবল বাংলাদেশ-মিয়ানমার নয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা-নিধন প্রকল্পে যে বা যেসকল পক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে গেছে তাদের অংশগ্রহণও জরুরি। কারণ, রোহিঙ্গা ইস্যুটি কোনো সাধারণ ও সরল ইস্যু নয়, এর পেছনে রয়েছে ভৌগোলিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল ও কুটিল সমীকরণ। দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় তার সাময়িক সমাধান হয়তো এলেও আসতে পারে কিন্তু স্থায়ী ও টেকসই কোনো সমাধান এতে আসবে না।

ফিরে যাই জাতিসংঘে শেখ হাসিনার প্রস্তাবসমূহ ও এর সম্ভাব্য সফলতা প্রসঙ্গে। শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য একটি ‘সেইফ জোন’ প্রতিষ্ঠা, নিপীড়িত-নির্যাতিতদের সুরক্ষা দেওয়া এবং কফি আনান কমিশনের পরামর্শ বাস্তবায়নকে মূল প্রস্তাবনা ধরে নিয়ে যদি আমরা এগোই তাহলে এগুলোর সঙ্গে কারোরই দ্বি-মত পোষনের সুযোগ নেই, এমনকি মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো রাষ্ট্রপ্রধান আং সান সু চি’ও তার বক্তব্যে এসব বিষয়গুলো ভাসা ভাসা হলেও ছুঁয়ে গেছেন, সামরিক কর্তৃপক্ষের ভয়েই হোক কিংবা তার অপ্রতুল ক্ষমতার কারণেই হোক সু চির পক্ষে এর বেশি বলা হয়তো সম্ভবও ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা কি পারবে শেখ হাসিনার এসব প্রস্তাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে?

আগেই বলেছি, ইতোমধ্যেই নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরেকটি বৈঠক আহ্বান করেছে এবং মূলতঃ এই প্রস্তাবনাই সে বিষয়ে মূল বিষয়বস্তু হওয়ার কথা। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানে পৌঁছানোর জন্য মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া হয়েছে। গত দু’দিনে (জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরে) রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই যে, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি বিবৃতি দিয়েছেন যাতে অবিলম্বে “মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাভাষী মুসলিমদের” ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ এবং বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী চার লাখেরও বেশি শরণার্থীদের ব্যাপারে মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হয়েছে।

যদিও মালয়েশিয়া আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই বিবৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে কারণ এতে মিয়ানমার থেকে আগত শরণার্থীদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। মালয়েশিয়া স্পষ্ট করেই বলেছে যে, রোহিঙ্গা সমস্যাকে জাতিসংঘ স্পষ্টভাবে মিয়ানমার কর্তৃক জাতিগত নিধনের প্রাথমিক নিদর্শন হিসেবে উল্লেখের পরও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিবৃতিতে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়াকে নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ বলে মনে করে মালয়েশিয়া। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ যে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে তা শেখ হাসিনার প্রস্তাবনাকে সর্বোতভাবে সফলতা না দিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ যে একটি দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে তা প্রমাণ করে এবং জাতিসংঘ এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে থাকলে ভবিষ্যতে এসব প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সফলও হতে পারে।

কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যে চিরাচরিত বিরোধিতা সেটি বিএনপি-জামায়াতপন্থি রাজনীতিবিদরা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন আবারও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া শেখ হাসিনার প্রস্তাবনাকে নাকচ করে দিয়ে। শেখ হাসিনার প্রস্তাবকে অগ্রহণযোগ্য দাবি করার পেছনে কী কারণ রয়েছে সেটি বিএনপি স্পষ্ট করে বলেনি যদিও, ফলে আমরা ধরে নিচ্ছি যে, যেহেতু প্রস্তাবটি শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এসেছে সেহেতু তারা এর বিরোধিতা করছে। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন যে, অতীতে বিভিন্ন দেশে ‘সেইফ জোন’ গঠন করার যে সকল উদাহরণ রয়েছে তার সবগুলোর পরিণতি সফল হয়নি, তবে যেসব ইতিবাচক উদাহরণ রয়েছে ‘সেইফ জোন’ গঠনের সেগুলোও কিন্তু কম নয়। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও আন্তর্জাতিক তৎপরতায় দু’টি ‘সেইফ জোন’ গঠনের উদাহরণ রয়েছে যা অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত ‘সেইফ জোন’ কেন সফল হবে না সে বিষয়ে কোনো আলোচনা না করে একে নাকচ করে দেওয়ার অর্থই হলো, বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি না করে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করা, যা আমাদের দেশে রাজনীতির একটি মূল বৈশিষ্ট্য। আমরা লক্ষ্য করে থাকি যে, শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক ভাবে বন্ধুহীন প্রমাণ করার মধ্যে এক ধরনের বিমল আনন্দ রয়েছে এবং শেখ হাসিনা-বিরোধী শিবিরটি এই কাজ করে যে বাংলাদেশের চরম ক্ষতি সাধন করে থাকেন তা তারা হয়তো বুঝতেও পারেন না, তারা মনে করেন যে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেতো এক হাত নেওয়া হলো, এতেই তাদের সুখ। বলাই বাহুল্য, এদেশের রাজনীতিতে এই পন্থীরা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বিস্তৃতই কেবল নয়, আন্তর্জাতিক দোসরদের নিয়ে তারা ক্ষমতাবানও। এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতেও তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক, দু’ভাবেই কোমর বেঁধে নেমেছেন শেখ হাসিনা বিরোধিতায়। তাতে শেখ হাসিনার ক্ষতি কতোটুকু হবে তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই কিন্তু দেশের ক্ষতি যে হবে ষোলো আনার ওপর আরো দু’আনা অর্থাৎ আঠারো আনা তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ এই দেশজ শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পাক, আন্তর্জাতিক শত্রুদের মোকাবিলা তাতে সহজতর হবে অন্তত।

ঢাকা, ২৫ সেপ্টেম্বর, সোমবার, ২০১৭
লেখক : দৈনিক আমাদের অর্থনীতির নির্বাহী সম্পাদক।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন