ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

চালবাজি বন্ধ হোক

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ০৪:১৫ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সরকার যতই বলুক সঙ্কট নেই, কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ সবাইকে বাজারে যেতে হয়, চাল কিনতে হয়। তাই চালের দামের তথ্য জানার জন্য সাধারণ মানুষকে মন্ত্রীদের বক্তব্য বা গণমাধ্যমের খবরের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। মানুষ সরাসরি জানতে পারে, চালের দাম বাড়ছে না কমছে।

বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম একবার বাড়লে আর সহজে কমে না। কমলেও যতটা বেড়েছে, ততটা নয়। তাই কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে কোনোকিছুর দাম একবার বেড়ে গেলে তা আর কখনোই আগের জায়গায় ফেরে না। বাংলাদেশে প্রায়শই বিভিন্ন পণ্যে ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। যারা নিয়মিত সে সব পণ্য কেনেন, তারা জানেন, ১০ ভাগ ডিসকাউন্ট দেয়ার আগে গোপনে ১৫ ভাগ দাম বাড়িয়ে নেয়া হয়। চালের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কেজিপ্রতি ১৪/১৫ টাকা দাম বাড়ার পর সরকারের চাপের মুখে মিল মালিকরা ২/৩ টাকা দাম কমাতে রাজি হয়েছেন। যদিও চারদিন পরও তার খুব একটা প্রভাব খুচরা বাজারে পড়েনি।

আমি বলছি না, সরকার কিছুই করেনি। কিন্তু ছেলেবেলায় শিখেছি, আপনি সারাদিন পাথর ঠেললেন, কিন্তু পাথরটি যদি একটুও না সরে, তাহলে তা কাজ বলে গণ্য হবে না। এখন সরকারের চেষ্টায় যদি চালের বাজার আগের অবস্থায় ফিরে না যায়, তাহলে তা কাজ বলে গণ্য হবে কি?

মার্চ মাসে হাওর এলাকায় অকাল বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেই ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতে মে-জুন মাসে দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক বন্যা ভাসিয়ে নিয়েছে ক্ষেতের ফসল। তাই এবার যে চালের বাজারে ঝামেলা হবে, সেটা সবাই আগে থেকেই ধারণা করছিলেন। সরকার কী জানতেন না? জানলে আগে ব্যবস্থা নেননি কেন? চাল আমদানির শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে তিন দফা সময় নিতে হলো কেন? সরকারের এই সিদ্ধান্তহীনতার কারণে শুল্ক কমানোর সুফল ব্যবসায়ীরা পেলেও সাধারণ মানুষ পায়নি।

সরকার বলছে, চালের মজুদ কিছুটা কমেছে, তবে এখনও যা আছে, তা পর্যাপ্ত। কিন্তু বন্যা সূত্রে পাওয়া সুযোগটা যে ব্যবসায়ীরা কাজে লাগাবে, তা তো অনুমিতই ছিল। বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রেই নৈতিকতার বালাই নেই। আপনি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিভাবে উচ্চ নৈতিকতা আশা করবেন। চালের দাম আকাশ ছোঁয়ার পর এখন সবাই মিলে দৌড়ঝাঁপ করে লাভ কি?

আমাদের একটা অতি পুরোনো অভ্যাস আছে। কোনো কাজ গুবলেট করে ফেললেই দায়টা অপরের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া। এই যেমন চালের বাজার পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হওয়ার পর খাদ্যমন্ত্রী দায় চাপালেন মিল মালিক আর সাংবাদিকদের ওপর। ভারত চাল রপ্তানি করবে না, অসমর্থিত সূত্রের এমন একটি খবর কোনো কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বটে। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে, এমন একটি স্পর্শকাতর খবর প্রকাশ ঠিক হয়নি। কিন্তু এই একটি খবরেই চালের দাম আকাশ ছুয়েঁছে, এটা ঠিক বিশ্বাস হয় না আমার। গণমাধ্যমের এত ক্ষমতা তা জানা ছিল না। অশুভ চক্রটি একে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে।

চাল নিয়ে যখন তুলকালাম, পাশাপাশি তুলকালাম মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে রোহিঙ্গাদের ঢল নিয়ে, তখন খাদ্যমন্ত্রী চাল কেনার চুক্তি করতে সস্ত্রীক মিয়ানমার গিয়েছিলেন। তিনি গিয়েছিলেন ১০ লাখ টন চাল কেনার চুক্তি করতে। কিন্তু অনেক জল ঘোলা করে মিয়ানমার মাত্র এক লাখ টন আতপ চাল রপ্তানি করতে রাজি হয়েছে, তাও চড়া দামে। এই চাল বাংলাদেশে পৌঁছতে পৌঁছতে ডিসেম্বর লেগে যাবে। ততদিনে আশা করি চালের বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।

মিয়ানমারের সৃষ্ট সমস্যার কারণে বাংলাদেশের কাঁধে যখন ১০ লাখ রোহিঙ্গার দায়, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যখন গোটা বিশ্ব সোচ্চার, মালদ্বীপ যখন মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, একই আবেগ যখন বাংলাদেশের জনমানুষের; তখন খাদ্যমন্ত্রীর মিয়ানমার সফর ভুল বার্তা দিয়েছে সব মহলে। মিয়ানমার এখন সবাইকে বলতে পারবে, দেখো কিছুই হয়নি। সব স্বাভাবিক। বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে চাল কিনছে। মাত্র এক লাখ টন চালের বিনিময়ে মিয়ানমার তার ধসে পড়া ভাবমূর্তি ঠেকা দেয়ার সুযোগ পেলো।

মিয়ানমার আমাদের কাছে এক লাখ টন আতপ চাল বিক্রি করবে। কিন্তু মিয়ানমারের পাঠানো রোহিঙ্গাদের মত এই আতপ চালও আমাদের গলার কাঁটা হবে। চালের বাজারে আগুন লাগার পর সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুরু করেছে। গতবছর খোলাবাজারে চালের দাম ছিল ১৫ টাকা। এবার সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ টাকা কেজি। কিন্তু খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে আতপ চাল। আর বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাকার সাধারণ মানুষ আতপ চাল খেয়ে অভ্যস্ত নয়। পিঠা বা রুটি বানানোর কাজেই বেশিরভাগ মানুষ আতপ চাল ব্যবহার করে। তাই খোলা বাজারে আতপ চাল বিক্রির সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ খুশি হতে পারেনি।

তাই মিয়ানমার যখন ডিসেম্বরে আতপ চাল পাঠাবে, তখন সে চাল লইয়া আমরা কী করিবো, পিঠা খাইবো? তবে খোলাবাজারে আতপ চাল বিক্রি নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, 'এই আতপ চালের মান খুবই ভালো। শুরুতে ক্রেতারা এটা বুঝতে পারছে না। পরে এটাই মানুষ খুঁজে খুঁজে কিনবে।' খাদ্যমন্ত্রীর কথায় মনে হচ্ছে, চালের দাম আরো বাড়বে। তখন মানুষ নিরূপায় হয়ে খুঁজে খুঁজে আতপ চাল কিনবে।

চালের বিষয়টি পুরোটাই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তবু বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে ধন্যবাদ। তিনি দায়িত্ব নিয়ে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। পুরোপরি সফল না হলেও দামের ঊর্ধ্বগতিতে বাঁধ দিতে পেরেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যমন্ত্রী সম্পৃক্ত না হলে বিষয়টিতে লেজেগোবরে হয়ে যেতো। বাণিজ্যমন্ত্রী কখনো ধমক দিয়ে, কখনো বৈঠক করে মিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। এটা তো বাস্তবতা, ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিলে তারা সঙ্কট আরো জটিল করে তুলবে। তখন আর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর মিল মালিকদের সাথে বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি ২/৩ টাকা কমানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাও কিভাবে? চাল বহনে পাটের ব্যাগের বদলে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার করতে দিলে কেজিপ্রতি ২ টাকা কমানো সম্ভব। তাই পাটশিল্পের ক্ষতি জেনেও প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেই বৈঠকের পর পাইকারী বাজারে দাম কিছুটা কমলেও খুচরা বাজারে এখনও তেমন প্রভাব পড়েনি।তবে আমরা জানি সরকার শুধু ব্যবসায়ীদের আশ্বাসের ওপর ভরসা করে বসে নেই। ইতিমধ্যেই বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো চাল আমদানিতে মাঠে নেমেছে। আশা করা যায়, শিগগিরই পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে চাল আবার দুই মাস আগের দামে ফিরে যাবে বলে মনে হয় না।

খাদ্যমন্ত্রী যেমন চালের দাম বাড়ার জন্য মিডিয়াকে দায়ী করেছেন, বাণিজ্যমন্ত্রীও করেছেন। ১৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে তিনি বলেছেন, ‘চালের দাম শুধু বাড়ছেই, এমন নিউজ আপনারা আর করবেন না। আপনারা পজিটিভ নিউজ লেখেন- চালের দাম কমেছে। উৎপাদন ভালো হয়েছে।’

আমি মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলছি, সাংবাদিকদদের দায়িত্ব পজিটিভ বা নেগেটিভ নিউজ করা নয়; সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ নিউজ করছে। চালের দাম যদি কমে, সাংবাদিকরা তাই লিখবে। কিন্তু দাম বাড়লে তো আর কমছে লেখা সম্ভব নয়। আপনারা কৌশলে হোক, চাপ দিয়ে হোক, ভয় দেখিয়ে হোক; ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করুন; চালের সরবরাহ বাড়ান, আমদানী করুন। চালের বাজার স্থিতিশীল হলে আমরা আর উল্টা কথা লিখবো না। চালের বাজার অস্থিতিশীল হলে সবারই ক্ষতি।

চালের দাম বাংলাদেশে একটা স্পর্শকাতর ইস্যু। বাঙালিকে বলাই হয় ভেতো বাঙালি। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। মায়েরাও চান তাদের সন্তানরা থাকুক দুধে-ভাতে। তাই চালের দাম বাড়লে টান পড়ে মায়ের হাঁড়িতে। আবার মৌসুমে যখন চালের দাম অস্বাভাবিক কমে যায়, তখন লাথি পড়ে কৃষকের পেটে। তাই সরকারের দায়িত্ব চালের বাজারের ভারসাম্যটা বজায় রাখা, দামের লাগামটা নিজেদের হাতে রাখা। এই লাগামটা ছুটে গেলে আসলে সবই ছুটে যায়। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের উন্নয়নের জোয়ারও পথ হারাবে। সাধারণ মানুষের দু’বেলা দু’মুঠো ভাত চাই আগে। ভাতের বদলে আলু খেতে বলেন, আর বার্গার খেতে বলেন; আমাদের পোষাবে না।

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
[email protected]

resume

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন