গোড়া কেটে আগায় পানি দিচ্ছেন সু চি!
আমি আগেই বুঝে গিয়েছিলাম, অং সান সু চি নিছকই পশ্চিমা বিশ্বের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বানানো এক ‘গণতান্ত্রিক নেত্রী’। আসলে গণতন্ত্র বা মানবাধিকার বা মানবতার ধারণাই তার পরিষ্কার নয়। তিনি নিছকই একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী বর্মী। মানবতার প্রশ্নে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন হারাতে চান্ না, চান না সেনাবাহিনীর আস্থা নষ্ট করতে। এমনিতে আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে অং সান সু চি’র মনোভাব টের পাচ্ছিলাম। তবুও আমরা আশায় ছিলাম, শেষ মুহূর্তে তার মনে পরিবর্তন আসতে পারে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের চাপ আর আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যাশার ভার তাকে বদলে দিলেও দিতে পারে। কিন্তু হা হতোস্মি, সু চি বদলাননি। আবারও প্রমাণ করলেন তিনি ক্ষমতালোভী এবং মিয়ানমার মেনাবাহিনীর ক্রীড়নক মাত্র।
বিশ্ব বিবেক যখন রাখাইন রাজ্যে পরিকল্পিত গণহত্যা ও জাতি নিধনের নিন্দায় সোচ্চার; তখন সু চি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন। গত ২৫ দিনে ৬ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মমতায় প্রাণ হারিয়েছে তিন হাজারের বেশি মানুষ। আর এখন সু চি কারণ খুঁজছেন, কেন রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাচ্ছে! সু চি ওপরে ওপরে কারণ খুঁজবেন, মানবাধিকারের কথা বলবেন, আহা উহু করবেন; আর তার দেশের সেনাবাহিনী আগুন লাগিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ছারখার করে দেবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুটি একদমই মিয়ানমারের সৃষ্টি। মিয়ানমার শত শত বছর ধরে রাখাইন রাজ্যে থাকা রোহিঙ্গাদের দিনের পর দিন অস্বীকার করবে। অজুহাত খুঁজবে তাদের নিশ্চিহ্ন করার। আর তাদের নেত্রী খুঁজবেন কারণ! ৬ লাখ মানুষ কেন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, এটা যদি সু চি না জানেন; তাহলে তার উচিত পদত্যাগ করে কারণ বের করা। সু চি যদি গাছের গোড়া কেটে সবাইকে দেখানোর জন্য আগায় পানি ঢালেন, সেই গাছ কি বাঁচবে? সু চি যদি জেগে ঘুমের ভাণ করেন, তাহলে তাকে কে বাঁচাবে। সু চি যদি সত্যি সত্যি জানতে চান কেন তার দেশের মানুষ পাশের দেশে ক্যাম্পে মানবেতর দিন কাটায়, তিনি বাংলাদেশে এসে ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে পারেন। তিনি রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করে দেখতে পারেন, কিভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে সু চি বলেছেন, রাখাইন সহিংসতায় সব মানুষের দুর্ভোগ গভীরভাবে অনুভব করেন তিনি। হা হা হা। যিনি মানবাধিকার লঙ্ঘণ করছেন, তিনিই যদি নিন্দা জানান, কেমন লাগে। নিপীড়ন যদি বন্ধ না হয়, তার গভীর অনুভবে কী যায় আসে।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা একজন বড় এবং মহৎ নেতার গুণ। কিন্তু সু চি তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি মহৎ তো ননই, বড় নেতাও নন। তাকে পশ্চিমা মিডিয়া বড়’র মত করে রেখেছে মাত্র। অং সান সু চি তার ভাষণে একটাই অর্ধসত্য বলেছেন। এতদিন তিনি বলছিলেন, রাখাইনে পরিস্থিতি শান্ত আছে। সেখানে সবাইকে সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তিনিও বুঝে গেছেন কথার শাক দিয়ে বাংলাদেশমুখি শরণার্থীর ঢলের এত বড় মাছ ঢাকা যাবে না। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি স্বীকার করেছেন, রাখাইন থেকে মুসলমানরা বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছে। এই স্বীকারোক্তি অর্ধসত্য। কারণ রাখাইন থেকে শুধু মুসলমানরা পালাচ্ছে না। ধর্ম নির্বিশেষে সেখানে সব রোহিঙ্গাকে মেরে, পুড়িয়ে, ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিদ্বেষটা নিছক ধর্মীয় নয়, জাতিগত। সু চি তার ভাষণে রোহিঙ্গা শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। কারণ তিনি মনে প্রাণে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বই স্বীকার করেন না।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সূত্র আছে কফি আনান কমিশনের সুপারিশে। সু চি মুখে মুখে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বললেও, বাস্তবে করছেন তার উল্টো। নইলে আনান কমিশনের রিপোর্ট দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী কেন এমন পোড়ামাটি নীতি নিয়ে মাঠে নামবে। পুলিশ ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার যে বাহানা দেয়া হচ্ছে, ধরে নিচ্ছি তা সত্যি। তাহলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সেই ‘সন্ত্রাসী’দের খুঁজে বের করুক, তাদের আইনের আওতায় আনুক। কিন্তু হামলাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যে মিয়ানমার গোটা একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার মিশনে নেমেছে। এবং ২৫ দিন ধরে একই কাজ করে তারা তাদের মিশন প্রায় শেষ করে এনেছে। তাদের লক্ষ্যটা পরিষ্কার, সব রোহিঙ্গাকে তাড়িয়ে দিয়ে সীমান্তে স্থল মাইন বসিয়ে তাদের ফেরার পথ বন্ধ করে দেয়া।
রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি, এর সমাধানও তাদের হাতেই। প্রথম কথা হলো মিয়ানমারকে স্বীকার করে নিতে হবে যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। দুই শ’ বছর আগে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ হয়তো এখনকার বাংলাদেশের সীমানা থেকে তখনকার বার্মায় গিয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনেকে হাজার বছর ধরে আরাকানে বাস করছে, সেটাও তো সত্যি। মিয়ানমারের যুক্তি মানতে হলে, পৃথিবীর অনেক দেশের হিসাব-নিকাশ ওলটপালট হয়ে যাবে। ৪৭এর দেশভাগের সময় বা ৬৫এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ভারত-পাকিস্তানে অনেক মানুষ দেশ বদল করেছেন। তাদের কি এখন ফিরিয়ে নেয়ার দাবি তুলছে কেউ। মিয়ানমারের দাবি মানলে তো আমেরিকা খালি হয়ে যাবে। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও ফিরে যেতে হবে জার্মানিতে। তাই সমস্যার মূলটা আগে স্বীকার করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। তাদের চলাচলের স্বাধীনতা দিতে হবে, পড়াশোনার সুযোগ দিতে হবে, চাকরির সুযোগ দিতে হবে। সমস্যাটা সু চি জানেন, কিন্তু স্বীকার করেন না।
সু চি তার নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘যখন মানুষের নিপীড়ন গ্রাহ্য করা হয় না, তখন সংঘাতের বীজ বপন করা হয়।’ এটাই সমস্যার মূল। এটা যদি সু চি বুঝতেন তাহলে সমস্যা এত দূর গড়াতো না। সমস্যা সমাধানে সু চি যদি সত্যি আন্তরিক হন, তাহলে রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা এক্ষুণি বন্ধ করতে হবে। তার দাবি অনুযায়ী যারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। এবং তাদের যথাযথ পুনর্বাসন এবং স্বীকৃতি দিতে হবে। সমস্যা মিয়ানমার তৈরি করেছে, সমাধানও তাদেরই করতে হবে। কিন্তু তারা যদি সমাধান না করে, তাহলে? তাহলে বিশ্ববাসীকে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কার্যকর চাপের কথা বলছি, কারণ গত ২৫ দিনে নানা রকমের বিবৃতি, নিন্দা, চাপের পরও মিয়ানমার কর্তপক্ষ কিন্তু তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সু চি পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক চাপে তারা ভীত নন। সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে পারলে মিয়ানমার কিন্তু আলগা ভাব দেখাতে শুরু করবে। তাই এখনই চাপ আরো বাড়াতে হবে, যাতে তারা ভীত হন। এব্ং আলটিমেটাম দিয়ে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। বিশ্বের সব নেতা এখন নিউইয়র্কে। তাই এখনই সময়। মিয়ানমারের সাথে অনেকের স্বার্থ জড়িত। কিন্তু স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে মানবতাকে। টেকনাফে যে মানবতা কেঁদে মরছে, তা সবাইকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বেড়াল মিয়ানমারের গলায় চাপের ঘণ্টাটা বাঁধবে কে?
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
[email protected]
এইচআর/পিআর