ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বোকার বাক্স

নাসরীন মুস্তাফা | প্রকাশিত: ০৪:০৯ এএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

একটু দেরিতেই পড়েছিলাম বইটা। চার্লি এন্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি। রুয়াল দাল-এর লেখা এই বইটা আমার কিশোর বেলা পেরিয়ে বড়দের পথে চলা মনটাকে কাঁদতে বলেছিল। 

এখনো মনে আছে চার্লির কথা। ছোট্ট ছেলে চার্লি শহরের এক কোণে দাদা-নানা-নানি-দাদি-বাবা-মা’কে নিয়ে ভাঙ্গাচোরা এক বাড়িতে থাকে। শহরের আরেক কোণে থাকে  চকলেট ফ্যাক্টরি’র খেয়ালি মালিক। মাত্র পাঁচটা চকলেটের প্যাকেটের ভেতর গোল্ডেন টিকিট পুরে দেয় সে। পাঁচটি শিশুর হাতে পড়ে টিকিটগুলো। এরা সুযোগ পায় বাবা-মাসহ একটা গোটা দিন চকলেট ফ্যাক্টরিতে কাটানোর। চার্লি সুযোগ পেয়েছিল। কে এই চার্লি? পড়তে পড়তে আমি-ই হয়ে গেলাম চার্লি। আমার হাতে গোল্ডেন টিকিট। ঢুকলাম ফ্যাক্টরিতে। তারপর ঘটতে থাকল আশ্চর্য সব ঘটনা, আমারই চোখের সামনে। আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষের ভেতর তখন চকলেট ফ্যাক্টরি।

এতকাল পরে খুঁটিনাটি সবকিছু মনে নেই, মনে থাকার কথাও নয়। তবে আশ্চর্য শিহরণ, ভয়-উত্তেজনা, বিস্ময় আর যা যা অনুভূতির নাম করা যায়, তার অনেকগুলোই আমার অভিজ্ঞতাতে এসেছিল, যা এখনো টিকে আছে। কেননা, বইটি আমি পড়েছিলাম। সেই থেকে রুয়াল দাল বললেই আমি সচকিত হয়ে উঠি। মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঘণ্টা বেজে ওঠে। জেগে ওঠে উম্পা-লুম্পা বামনদের সেই আশ্চর্য জগত, যার স্রষ্টা এই অসামান্য লেখকটি। তিনি নাকি রাতে তাঁর ছেলেমেয়েদের আজব চকলেট ফ্যাক্টরি আর তার মালিক ওনকা ও ছোট্ট চার্লির গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। পড়া আর দেখার মধ্যে এতটাই ফারাক! কতটা ফারাক? রোয়াল দাল এ নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। আশ্চর্য জগত নির্মাণ করতে পারা রোয়াল দাল টেলিভিশন দেখার কাজটা শিশুদের জন্য উপকারী কি উপকারী নয়, তা নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর মতে, টেলিভিশন সেটের কাছে ধারেই শিশুদেরকে যেতে দেওয়া যাবে না কখনোই, কখনোই যাবে না, (NEVER, NEVER) আর তাই সবচেয়ে ভাল হচ্ছে এই বোকামির বস্তুটাকে ঘরেই না আনা!তিনি লিখেছেন, ‘প্রায় প্রতিটি ঘরে আমরা ওদেরকে দেখছি স্ক্রিনের সামনে বসে আছে তো বসেই আছে।’ আসলেই তাই। আমাদের প্রায় প্রতিটি ঘরে টেলিভিশন আছে, সেটার একটা স্ক্রিন আছে, তার দিকে তাকিয়ে আছে আমাদের ছেলেমেয়েরা।

এরপর এল মোবাইলের স্ক্রিন। স্মার্টফোনেরও স্ক্রিন আছে, সেটাও দেখায় না এমন কিছু নেই। ক্লাস ওয়ানে পড়া বাচ্চার চোখের একদম কাছে বাবামায়ের বয়সী বড়দের বিছানার প্রেমটাকেও হাজির করে দেয়। ওরা দেখে। না না, ওরাও গপ্প করে, হাসে, নাচে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও চোখটা সরায় না স্ক্রিন থেকে। হিপনোটাইজ শব্দটি মনে পড়ে যায় ওদেরকে দেখলে। বাচ্চাগুলো হিপনোটাইজড হয়ে গেছে। হাতিঘোড়া, ঘোড়ার ডিম যা দেখছে, তা-ই চোখ দিয়ে গিলছে।

বাবামায়েরা কিন্তু খুশি। কেননা, টিভির সামনে ওরা তো বসেই আছে। জানালার গ্রিল বেয়ে উঠে পড়া, সোফার কুশন ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারামারি করা, একজন আরেকজনকে ঘুষি দিয়ে ফেলে দিয়ে, বল ছুঁড়ে জিনিসপত্র ভেঙ্গেচুরে ফেলে আমাদেরকে মোটেও বিরক্ত করছে না ওরা।  এর ফলে আমরা টেক্সট চ্যাট-ভয়েজ চ্যাট-ভিডিও কল হ্যানোত্যানো করতে পারছি। একবারও কি ভাবছি, প্রাণপ্রিয় সন্তানের এ কী দশা করছি নিজের হাতে?

কি দশা করছি, তা বলেছেন রোয়াল দাল। সেই তালিকায় কষ্ট করে একটু চোখ বুলাই।

১. শিশুদের মস্তিষ্কের অনুভূতিকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

২. শিশুদের কল্পনাশক্তি মরে যাচ্ছে।

৩. শিশুদের মনটায় ময়লা-আবর্জনার মতো আজেবাজে বিষয় জমে যাচ্ছে আর ওর চিন্তা প্রক্রিয়ায় তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। 

৪. শিশুকে অতি মাত্রায় বোকা-বেবুঝ আর কোন দিকে মনোযোগ দিতে না পারার মতো ‘কানা’ বানাচ্ছে।

৫. কোন ফ্যান্টাসি বা রূপকথার রূপ-রস-গন্ধ শিশুটি আর বুঝতে পারছে না। রূপকথার রাজ্যে যেতে পারে না ও। রূপকথার রাজ্যের মাটিতে পা রেখেও টের পায় না কোথায় দাঁড়িয়ে আছে ও!

৬. মস্তিষ্ক দিনকে দিন নরম হতে থাকে পনিরের মতো।

৭. চিন্তা করার শক্তি কমে যায়, এক সময় চিন্তাই করতে পারে না। কেননা, চিন্তাশক্তি হয়ে যায় পাথরের মতো স্থির।

৮. শিশুটা এক সময় আর ভাবতে পারে না। ভাবে না। কেবলি দেখে!

জানি, আমাদের শিশুদের এছাড়া আর কোন উপায়ও তৈরি করে দিতে পারছি না আমরা। খেলার মাঠ নেই। সুস্থ বিনোদনের চর্চা নেই। করবোটা কি তবে? 

আচ্ছা, টেলিভিশন নামক দানবটা বাড়িতে ঢোকার আগে বাচ্চারা কি করত? আমাদের শিশুকালে আমরা টেলিভিশন পাইনি, তখন কি করেছি? ভুলে গেছি? না কি জানিই না?তাহলে মনে করিয়ে দেই। টেলিভিশনহীন পৃথিবীতে আমরা বড় হয়ে উঠেছি বই পড়তে পড়তে। আমরা পড়েছি। কেবল পড়েছি। পড়তে পড়তে বড় হয়েছি। আরও বেশি পড়েছি। বেশি বেশি। আমাদের আদ্ধেক জীবন গেছে বই পড়তে পড়তে! বইভরা আলমারি দেখে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছি। বন্ধুর বাড়ি থেকে বই ধার করে এনে পড়েছি। বন্ধুকে ধার দিয়েছি আমার বই। বইয়ের জন্য ঝগড়া করেছি। বইয়ের জন্য বন্ধু হয়েছি। 

আমার ঘরটার কথা মনে পড়ে যায়। আলমারিতে জায়গা হয় না, গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে, শোবার ঘরে, বিছানায় গড়াগড়ি খায় কত বই! অপেক্ষা আছে, কখন পড়ব ওকে। মলাট ওল্টালেই দারুণ দুনিয়া লাফিয়ে ওঠে চোখের সামনে। হাজারো মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা ঢুকে পড়ে আমার জীবনে, আমাদের জীবনে। আমার ভাই বাড়ি থেকে পালিয়ে চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিল। জাহাজের খালাসি হওয়ার স্বপ্ন ছিল ওর। সমুদ্রে ঝড় উঠবে। কোন এক নির্জন দ্বীপে গিয়ে পড়বে ও। তারপর কি হবে? হবে রবিনসন ক্রশো। ড্যানিয়েল ডিফো বাড়িছাড়া করেছিল ওকে, ও হতে চেয়েছিল রবিনসন ক্রুশো। আহা! 

রোয়াল দাল হাহাকার করে লিখেছেন, ‘ওহ্ বই, যে বইগুলো তারা চিনত, সেইসব শিশুরা বাস করত বহু যুগ আগে!’ সেই সব বইয়ে ড্রাগন, জিপসি, রাজারানি, নীল তিমি, গুপ্তধনের খোঁজ মিলত। ক্যাপ্টেন হুক এক চোখে কাল কাপড় বেঁধে খট্ খট্ করে এসে দাঁড়াত ভয় দেখাতে। মানুষখেকো কঙ্গের গহীন জঙ্গলে টেনে নিয়ে যেত সেইসব শিশুদের। কথা বলা খরগোশ সেই সব শিশুদের সামনেই কেবল কথা বলত। উটের পিঠে কেন কুঁজ, কোন্ শেয়ালে লেজ কাটা গেল এ্যাতোসব জিজ্ঞাসা জন্ম নিত কেবল সেইসব শিশুদেরই মনে, যারা বেঁচে ছিল বহু যুগ আগে। 
আমাদের শিশুরা কেন বঞ্চিত হচ্ছে? কী অপরাধ ওদের? রোয়াল দাল দুই হাত জোড় করে কাকুতি মিনতি করে বলছেন, ‘সো প্লিজ, ওহ্ প্লিজ, উই বেগ, উই প্রে, গো থ্রো য়্যুর টিভি সেট অ্যাওয়ে, এন্ড ইন ইটস প্লেস য়্যু ক্যান ইনস্টল আ লাভলি বুকশেল্ফ অন দ্য ওয়াল।’

ঘরের টেলিভিশনটা সরিয়ে ফেলে (ঘর থেকে বের করে দিয়ে) সেখানে বইয়ের আলমারি বসাতে এগিয়ে আসবেন কে? আর যদি আসেনও, সত্যিই টেলিভিশন সরিয়ে দিয়ে বইয়ের আলমারি বসিয়ে দেন, হবেটা কি? বাচ্চারা কি নেড়েচেড়ে দেখবে কোনটাকে? পাতা উল্টাবে? কোন শব্দ কি চলে যাবে ওর দৃষ্টি থেকে মস্তিষ্কের চিন্তা কেন্দ্রে?
রোয়াল দাল বলছেন, যাক্ না এক সপ্তা, দুই সপ্তা। কিছু যে পড়ার আছে, এই বোধ নাকি জাগবেই। আর একবার যদি বোধটা জেগেই ওঠে, তখন কি হবে? মধু! মধু!ভোরের সূর্যের নরম আলো জানালার ফাঁক দিয়ে আস্তে করে ঘরে ঢোকে যেমন করে, তেমনি করে বোধের আলো একটু একটু করে ঢুকতে থাকবে শিশুর নরম মনের আঙ্গিনায়। তারপর ও গ্রহণ করতে থাকবে পৃথিবীর আনন্দসমূহ। মহাবিশ্ব থেকে আনন্দের পিন্ড ছুটে আসবে কেবল ওর মনের ভেতর ঢুকে পড়ার জন্য। এই আনন্দ টেলিভিশনের স্ক্রিনে দেখা মহাকাশ থেকে ছিটকে পড়া উল্কাপিন্ড কখনোই দিতে পারে না।তারপর কি হবে?রোয়াল দাল গ্যারান্টি দিয়ে বলছেন, ‘এরপর প্রতিটি, প্রত্যেকটি শিশু আপনাকে ভালবাসতে শিখবে আপনি যা করলেন ওর জন্য, তার বিনিময়ে।’

(পুনশ্চঃ)হলিউডে বানানো হ’ল ‘চার্লি এন্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি’ চলচ্চিত্রটি। জনি ডেপ আছেন। নিজের বাচ্চাদের তুমুল আগ্রহ, ছবিটা দেখতেই হবে। আমি জানি, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না। বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে আবারো বইটি পড়া শুরু হয়েছিল। নতুন করে আবারো ঢুকে গেলাম চার্লি হয়ে আরো দুই চার্লিকে সাথে নিয়ে সেই চকলেট ফ্যাক্টরিতে। পড়া শেষ হলে ছবিটি দেখতে বসেছিলাম। ঘোলটা খারাপ লাগেনি। তবে তা আমার অনুভবের হুবহু প্রতিরূপ নয়। হওয়া সম্ভবও নয়। তুলনা করতে বললে আমি অবশ্যই বইটার পক্ষে কথা বলব। সত্যজিত রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ কিছুতেই বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যাধের ‘আম আঁটির ভেঁপু’কে অতিক্রম করতে পারেনি, আমার ভেতরকার দুর্গা পর্দায় আসেনি।আফসোস!

লেখক : শিশুসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন