কবে থামবে এ বর্বরতা!
পঞ্চম শতক। রোমান সাম্রাজ্য। অ্যাটিলা দ্য হানের বর্বর বাহিনী আক্রমণ করেছে পূর্ব সাম্রাজ্যের নগরগুলোতে। জনপদে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চলছে। রোম যখন আক্রান্ত হয় তখন রেহাই পায় না অবোধ শিশুরাও। তছনছ হয়ে যায় পুরো রোমান সভ্যতা।
বারো’শ শতক। বুখারা। চেঙ্গিস খানের মোঙ্গলবাহিনী ঘেরাও করে রেখেছে শহর। শহরের অবস্থা নাজুক। বুখারার আমির সিদ্ধান্ত নেন আত্মসমর্পণের। শর্ত থাকে নগরীতে হত্যাকাণ্ড চালানো চলবে না। কিন্তু বিনা যুদ্ধে আত্ম সমর্পণের পর হত্যা, লুট, অগ্নিকাণ্ড ও ধর্ষণের স্রোত বয়ে যায়। বুখারার পুরুষদের হত্যা করা হয় নির্বিচারে। শিশুদের মধ্যে ছেলেদের হত্যা করা হয়। ছোট মেয়েদের রাখা হয় দাসী হিসেবে। আর নারীর উপর চলে বর্বর নির্যাতন ও ধর্ষণ।
চতুর্দশ শতক। দিল্লি আক্রমণ করে তৈমুর লংয়ের বাহিনী। লুণ্ঠন, হত্যা ও ধর্ষণের তাণ্ডব বয়ে যায়। দিল্লি শহর পরিণত হয় শ্মশানে। ১২০৯ সাল থেকে শুরু হয়ে দশ বছর ধরে চলা খ্রিস্টীয় ধর্মের দুই বিভাগের মধ্যে চলা গণহত্যায় ফ্রান্সে প্রাণ হারায় ১০ লাখের বেশি মানুষ। সেই সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যার তুলনায় এই গণহত্যা ছিল ধর্মের নামে চলা দাঙ্গার মধ্যে ভয়াবহতম।
১৯১৫ সাল, তুরস্ক। তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ১৯১৫ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠিকে বিতাড়ন করা হয় তাদের মাতৃভূমি থেকে। সে সময় নির্বিচারে ধর্ষণের শিকার হয় আর্মেনিয়ান বংশোদ্ভূত নারীরা। হত্যা করা হয় শিশুদের। দেশত্যাগের নামে হাজার হাজার মানুষকে মরুভূমির মধ্যে নিয়ে হত্যা করা হয়। প্রায় ১৫ লাখ আর্মেনিয়ান মারা যায়। বলা হয় তুরস্কের ৫০ শতাংশ আর্মেনিয়ানকে হত্যা করা হয়। সেসময় সাড়ে সাত লাখ গ্রিককেও হত্যা করা হয়।
জাতিগত হত্যা, এথনিক ক্লিনজিংয়ের বীভৎস রূপ দেখা গেছে আরও অনেক দেশে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপের উপনিবেশ স্থাপনের সময় স্থানীয় অধিবাসীদের উপর চলে বর্বর নির্যাতন। আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনের সময় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে দাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয় ইউরোপ ও আমেরিকায়। হত্যা ও ধর্ষণ চলে নির্বিচারে।
মধ্যযুগে বাংলাদেশে পর্তুগিজ জলদস্যু, মগ দস্যু, বর্গিরা গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে। ত্রিপুরা ও কুমিল্লার অনেক অংশে স্থানীয় অধিবাসীদের উপর মগদের আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞ চলে। ফরিদপুরের মগ জলদস্যুদের হামলা ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। পর্তুগিজ হার্মাদদের আক্রমণের শিকার হয়েছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।
১৭৫৫ থেকে ১৭৫৮ সালে পশ্চিম মঙ্গোলিয়ায় চুংঘরদের উপর চলা এথনিক ক্লিনজিংয়ের সময় ছয় লাখ চুংঘর জনগোষ্ঠির মৃত্যুও হয়। ১৮৬৪ সালের দিকে ককেশাসে সিরকাশিয়ান জনগোষ্ঠির প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এথনিক ক্লিনজিংয়ের নামে। সেসময় ১৫ লাখ লোককে হত্যা করা হয়। শিশু ও নারীরাও রেহাই পায়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপ জুড়ে ইহুদিদের উপর চলে হত্যা, নিপীড়ন, ধর্ষণের স্রোত। জার্মানিতে নাৎসি ও ইতালিতে মুসোলিনির বাহিনী এই হত্যাকাণ্ড চালায়। এই মহাযুদ্ধে ইউরোপে প্রায় দুই কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। আর সোভিয়েত ইউনিয়নে নাৎসি বাহিনীর আক্রমণের কারণে আরও দুই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনে নানচিং শহরে জাপানি বাহিনী নজিরবিহীন ধর্ষণ ও গণহত্যা চালায়।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরবাহিনী গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের যে কলংকজনক অধ্যায় রচনা করে তা বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতম বলে চিহ্নিত। নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা আর তিন থেকে চার লাখ নারীকে ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
নব্বইয়ের দশকে বসনিয়া হার্জেগোভেনিয়াতে চলে এথনিক ক্লিনজিং। সে সময় প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। নির্বিচারে ধর্ষণ করা হয় নারীদের। ৮ বছরের মেয়ে থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত সকলেই ধর্ষণের শিকার হয়। কম্বোডিয়ায় খেমাররুজ শাসনামলে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে পরিচালিত গণহত্যাও ছিল ভয়াবহ। প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় সে সময়।
১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় হুতু আর তুতসিদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গায় রুয়ান্ডার ৭০ শতাংশ তুতসির মৃত্যু হয়। দশ লাখ মানুষ নিহত হন। সেসময়কার ধর্ষণের বীভৎস বিবরণ যে কোন হরর কাহিনীর ভয়াবহতাকে অনায়াসে হারাতে পারে। বর্তমানে আমরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর তাণ্ডবের শিকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখছি। তাদের উপরও চলছে ভয়াবহ বর্বরতা। বিভিন্ন পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে অহরহ দেখছি খবর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একেকটি ছবি দেখছি আর বুক হিম হয়ে যাচ্ছে। নারীদের উপর চলছে ধর্ষণের তাণ্ডব। শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে নির্বিচারে। গণহত্যা চলছে সেখানে। এথনিক ক্লিনজিংয়ের নামে ভয়াবহ নিপীড়ন চলছে রাখাইন রাজ্যে।
বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় কখনও এথনিক ক্লিনজিং, কখনও ধর্ম প্রচার, কখনও উপনিবেশ স্থাপন, রাজ্য বিস্তার, কখনও রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণের নামে যুগে যুগে দেশে দেশে মানুষের উপর চলেছে নির্যাতন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদিসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষকে কখনও নিপীড়িত আবার কখনও নিপীড়কের ভূমিকায় দেখা গেছে। ধর্মের নামে নির্যাতন চললেও পিছনে লুকিয়ে থাকে ধর্ম নয়, অন্য কারণ। ভূমি দখল, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, সম্পদ হরণসহ অনেক কারণ একযোগে কাজ করে গণহত্যার পিছনে। শাসকদের পোড়ামাটি নীতির কারণে ভূমি থেকে উচ্ছেদের জন্য হত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয় দুর্বলতর অবস্থানে থাকা জনগোষ্ঠিকে।
রোহিঙ্গাদের উপরে চলা বর্তমান গণহত্যা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে সভ্যতার আদিকাল থেকে সত্যিই কতদূর এগিয়েছি আমরা? একুশ শতকেও যদি বিশ্বে এ ধরনের গণহত্যা চলতে থাকে, এইভাবে বেসামরিক জনগণের উপর নিপীড়ন চলে, গণধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় নারী, শিশুর মৃতদেহ ভাসে সাগরে তাহলে এই বিশ্বকে কি আদৌ সভ্য বলা চলে? মানুষের উপর চলমান এই বর্বরতা আর কতকাল দেখতে হবে বিশ্ববাসীকে?
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম