শুচিবায়ু আপনার সন্তানের সাফল্যের অন্তরায়
অনেকেই তার সন্তানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন। টুকিটাকি জিনিসপত্র সে পাটেপাটে গুছিয়ে রাখে। কেউ কেউ এ কাজ বেশ সময় নিয়েই করে থাকে। অনেক সময় বিকেলের খেলা বন্ধ করে ঘর গোছানোর কাজ করে। সরাসরি বাবা-মায়ের এমন প্রশংসা তাদের এ তৎপরতাকে আরো বাড়ায়। সন্তানের এসব কাজ এবং অভিভাবকের অযাচিত বাহবা, উভয়ই শিশুর জন্য নেতিবাচক।
লেখাপড়া ও টুকিটাকি কাজের পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি শিশুরা মনোযোগী হবে, এমনটাই স্বাভাবিক। খেলাধুলার আনন্দদায়ক মুহূর্ত ছেড়ে সময় নিয়ে টুকিটাকি জিনিসপত্র গোছানোকে কোন কোন বাবা-মা প্রশংসা করলেও সেটা শুচিবায়ু বা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারের (ওসিডি) অন্যতম একটি লক্ষণ হতে পারে। ২০০৯ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- হু যৌথভাবে একটি জরিপ চালায়। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৮.৪ শতাংশ শিশু বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে ১.৩ শতাংশ হলো শুচিবায়ু বা ওসিডি।
শুচিবায়ু একটি মানসিক সমস্যা। সাধারণত এই সমস্যা ২৫ বছর বয়সের মধ্যেই শুরু হয়। অনেকের ক্ষেত্রে শৈশব, কৈশোর কিংবা যৌবনের শুরুতেও সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে। ওসিডি এমন এক ধরনের মানসিক সমস্যা, যার ফলে সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তির মাঝে কাজের পুনরাবৃত্তি, অবাঞ্ছিত চিন্তাভাবনা, ধারণা বা অনুভূতি তৈরি হয়, যা তাদের পুনরাবৃত্তিমূলক কিছু করতে চালিত করে। এ ধরনের রোগীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন ভীষণভাবে ব্যহত হয়।
শুচিবায়ু বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি, খুব বেশি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বা অনেক সময় নিয়ে গোছল করা। কিন্তু শুচিবায়ুর আরো কয়েকটি লক্ষণ রয়েছে। যেমন- একটি বিষয় নিয়ে ক্রমাগত দুশ্চিন্তা হতে থাকা এবং কোনভাবেই সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। এর জন্য সে অতিরিক্ত কিছু কাজ করে থাকে। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে থাকে এবং খেয়াল করে দেখে যে পরিস্কার হলো কি-না। একই জিনিস বারবার গণনা করা। এ সব কাজকে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় বুঝতে পারলেও সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তি নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না।
আমাদের দেশে শুচিবায়ু সমস্যার আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায়। অনেকেই অতিরিক্ত সাবান দিয়ে কাপড় কাচেন। কেউ কেউ লেখালেখির ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে হন, যেমন- এক লাইন লেখার পর তার কাছে মনে হয়, লাইনটি ঠিক হয়নি। তখন তিনি ঐ লাইন পুরো মুছে আবার প্রথম থেকে শুরু করেন। এমনকি কম্পিউটারে কম্পোজ করার সময়ও এটা করে থাকেন। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ে কাজটি শেষ হয় না।
ধর্মকর্ম পালনের ক্ষেত্রে একজন ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্যা অনেক সময় আরো প্রকট হয়। পাক পবিত্রতা ঠিকঠাক অর্জন হচ্ছে না মনে করে বারবার অজু করতে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায়, অজু করতে গিয়ে তিনি ঐ নামাজের ওয়াক্তই পার করে দিচ্ছেন। অনেকে আবার নামাজে ভুল হচ্ছে ভেবে একই নামাজ বেশ কয়েকবার পড়েন। এরপরও তিনি মনে করেন যে, তার নামাজ ভুল হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পরিবারের লোকজন ঐ ব্যক্তির সমস্যাকে শয়তানের অসওয়াসা মনে করে তা এড়িয়ে যান। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন না। অনেকে আবার একই কাজ নির্দিষ্ট সংখ্যকবার করে থাকেন। কেউ কাজটি করতে তিন সংখ্যাকে প্রাধান্য দেন। যেমন- তিনি তিন, তেরো, ত্রিশ, তেত্রিশ এমনকি উনচল্লিশ বার কাজটি করে থাকেন। আবার যিনি সাত সংখ্যাকে প্রাধান্য দেন, তিনি কাজটি সাত, সতেরো, সাতাশ বার করে থাকেন। অনেকে এত ধীরে কাজ করেন যে, সকালের রান্না করতে সন্ধ্যা লেগে যায়।
স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া শিশুদের মধ্যে ওসিডি বা শুচিবায়ু সমস্যাটি থেকে গেলে তার জীবনকে সুন্দর করা সম্ভব হয় না। তাই পরিবারের লোকজনের সহযোগিতাই এখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমাদের দেশে বাবা-মা’রা সাধারণতঃ ছেলেমেয়েদের রেজাল্ট খারাপ হলেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। তারা মনে করেন, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে চায় না অথবা মনোযোগ দিচ্ছে না। তাদের রেজাল্ট যাতে খারাপ না হয় বা তারা যেন মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে, সেজন্যই বাবা-মা’রা বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হন। কিন্তু ওসিডির কারণেই যে ঐ শিশুর এমনটা হচ্ছে, তা বুঝতে চান না অনেক অভিভাবক।
তাই বাবা-মা বা অভিভাবকরা এ ব্যাপারে সচেতন হলে শিশুদের ভবিষ্যত আরো সুন্দর ও তাদের চলার পথ আরো মসৃণ হবে। ঔষধ ও সাইকোথেরাপি নিয়ে ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, সাইকোথেরাপিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
লেখক : চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী।
[email protected]
এইচআর/আইআই