মুসলিম রোহিঙ্গাদের পাশে বাংলাদেশই দাঁড়িয়েছে
যুক্তির চেয়ে বরাবরই আমাদের মধ্যে কাজ করে বেশি আবেগ। এক ধরনের দার্শনিক দারিদ্র আমাদের রয়েছে, এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই কোনও। কোনও ঘটনাকে আমরা তল থেকে স্পর্শ করি না, দেখি না। উপরের বুদবুদ, ফেনা দেখেই মন্তব্য করে বসি। প্রবেশ করতে চাই না ঘটনার ভেতরে। ফলে উপরি কাঠামো বা ‘সারফেস লেভেল’ থেকে যে মন্তব্য করি তা অনেক সময়ই যা তৈরি করে তা রীতিমত- বিভ্রান্তি।
তুরস্কের ফাস্টলেডি এমিনে এরদোগান মাথায় হিজাব পরে রোহিঙ্গাদের দেখতে এসেছেন। দু’চারজন রোহিঙ্গাকে জড়িয়ে ধরে তার কান্নাকাটির ছবি পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে। এই ‘চোখের জল’ দেখে অনেকের প্রেম বেড়ে গেছে তুরস্কের প্রতি। আহা! তুরস্ক এত ভালো, তারচেয়ে আরো ভালো এরদোগানের স্ত্রী এমিনে। এরদোগানের দেশে কি রোহিঙ্গাদের নেবে? নেবে না একজনকেও। নিলে খুশি হতাম অনেক বেশি। বুঝতাম, তার ‘চোখের জলের’ মূল্য আছে। এ জল কেবল রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জল নয়। লোক দেখানো জল নয়। এ জল মানবিক জল। মানুষের জন্য জল। কিন্তু তা তো নয়, বাস্তবতা ভিন্ন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশই বরং সবচেয়ে মানবিক দেশ। ভুলে গেলে চলবে কেন, আমরা ৩০ বছর ধরে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। বরং অন্যদুনিয়া চুপ হয়ে আছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। ‘রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাঁচান, রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাঁচান’ বলে রব উঠেছে কিন্তু কোথায় অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র? তারা কে কতটা এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছে, কী আসেনি তা তো আর অস্পষ্ট নয়।
৬৫০,০০০ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। তারপরও বাংলাদেশকে গাল দিতে চান অনেকে। এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশের উপরে যে চাপ সৃষ্টি করেছে তা অবিশ্বাস্য। এত সবকিছুর পরেও বিপন্ন রোহিঙ্গাদের খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা দিতে কার্পণ্য করেনি বাংলাদেশ। একমাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া পৃথিবীর আর কোন রাষ্ট্রনায়ক সমকালে বা নিকট অতীতে এতবড়, অত বিশাল সংখ্যায় শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াননি। পৃথিবীর অন্য মুসলিম-অমুসলিম দেশের নেতারা যখন ‘এইসব নির্যাতিত পোড়ো মানুষদের’ গা বাঁচিয়ে চলছেন, দায় এড়াতে চাইছেন, তখন বাংলাদেশের শেখ হাসিনাই একমাত্র, যিনি এত বড় ঝুঁকি নেবার সাহস দেখিয়েছেন।
গাল যদি দিতে হয়, তবে তা না জেনে, না বুঝে, বাংলাদেশকে নয়, মিয়ানমারকে গাল দিন। এরদোগানের ‘তথাকথিত সমব্যথি’ স্ত্রীকে বলুন, তুরস্ক যাতে ন্যাটোকে বলে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। মিয়ানমারতো ন্যাটোভুক্ত, সদস্য। বলুন, ইউরোপ থেকে ত্রাণ দিতে। বলুন, এরদোগানকে তাদের জাহাজে করে কিছু শরণার্থীকে তুরস্কে নিয়ে যেতে, দেখবেন সব কান্না তখনই থেকে গেছে। মনে আছে নিশ্চয়ই তুরস্কের কথা, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে কেমন আহাজারি করেছিল? তুরস্ক কাদের নেটওয়ার্ক, কোন সিন্ডিকেট তা মনে রাখতে হবে। জঙ্গিবাদের অন্যতম ব্রিডিং গ্রাউন্ড তুরস্ক। দুনিয়াজুড়ে তরুণরা তুরস্ক হয়েই যেত, যোগ দিতে আইএসএ।
ভূমিপুত্র হয়েও রোহিঙ্গারা আজ নিজ দেশে পরবাসী। এক সময় মিয়ানমারের সংসদেও রোহিঙ্গা জনপ্রতিনিধি ছিল। কিন্তু ৬২’ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর থেকে সেই ইতিহাস ভিন্ন খাতে প্রবাহিত। কেড়ে নেয়া হয় তাদের ভোটাধিকার। প্রকাশ্যে নামাজ পড়তেও বাধা প্রদান করা হয় তাদের। বেড়ে যায় অত্যাচার, নিগ্রহ আর নারী যারা তাদের উপর নেমে আসে যৌন নির্যাতনের খড়গ। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ায় তাদের জীবনে। তাই ভুলে গেলে চলবে না, এ সমস্যা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ, একান্ত নিজস্ব, অন সাং সু চি যতই অস্বীকার করুক।
জাতিসংঘ কতটা ‘জাতিসংঘ’ কতটা ‘রাষ্ট্রসংঘ’ তা আজ বিশাল এক প্রশ্ন। রাষ্ট্র মানবিকতার এক সুমহান ধারণা। রাষ্ট্র কোষের ভেতর মানবিকতা যদি না থাকে, তবে সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রত্ব খারিজ হওয়া উচিত। মিয়ানমারের অমানবিকতা দেখছে সারা দুনিয়া। রাষ্ট্রের এমন অমানবিকতায় সারা বিশ্বের মানুষ হতবাক, বিহ্বল। বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যে উদারভাবে, মানবিকভাবে এই নির্যাতিত মুসলিম রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশই দুনিয়াজুড়ে মানবিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
[email protected]
এইচআর/পিআর