ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ভয়াবহ গণধর্ষণ: এ কোন তমসা?

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ০৪:০৮ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আসুন, প্রথমেই আমরা এক মিনিট নীরবতা পালন করি সেই মেয়েটির স্মরণে যে সকল বাধা তুচ্ছ করে জীবনে বিকশিত হতে চেয়েছিল। ঘাতকরা যাকে চলন্ত বাসে গণধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি। নির্মমভাবে হত্যাও করেছে। সেই সঙ্গে স্মরণ করি কয়েকটি সংবাদ।

ঈদের দিনে বাউফলে তরুণীকে গণধর্ষণ। রাজধানীতে ঘরে ঢুকে গৃহবধূকে গণধর্ষণ। গাইবান্ধায় ঈদের আগের দিন ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা। স্কুলঘরে স্বামীর সামনে শিক্ষক স্ত্রীকে গণধর্ষণ। এমন খবরের কোন শেষ নেই।

প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে নারীর প্রতি ভয়াবহ সহিংসতার সংবাদ। ভয়াবহতা ও নৃশংসতার দিক থেকে একটি ঘটনা যেন আরেকটির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। চলন্ত বাসে কর্মজীবী এক নারীকে গণধর্ষণ ও হত্যার যে বিবরণ ধর্ষক-খুনিরা পুলিশের কাছে দেয় এবং যেমন নির্বিকারভাবে তারা অপরাধটি ঘটায় তাতে যে কোন বিবেকবান মানুষের স্তম্ভিত ও আতংকিত হয়ে পড়ার কথা। সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই আরেকটি বিষয় খেয়াল করেছেন যে, একটি সংবাদের আড়ালে হারিয়ে যায় বা চাপা পড়ে যায় আরেকটি সংবাদ। যেমনভাবে চাপা পড়ে গেছে তনু হত্যা, মিতু হত্যা, নার্গিস হত্যা, নিতু মণ্ডলের হত্যাসহ আরও অনেক হত্যাকাণ্ড। অপরাধীরা ধরা পড়লো কিনা, ধরা পড়ার পর তারা জামিনে আবার বেরিয়ে এলো কিনা, তাদের বিচার প্রক্রিয়া কি অবস্থায় রয়েছে, বিচারের রায় কি হলো, নাকি মামলাটির অপমৃত্যু হলো, এবং বিচারের চূড়ান্ত রায়ের পর শাস্তি কার্যকর হলো কি না এসব অনেক কিছুই আর জানা যায় না। কোন ফলোআপও হয় না।

একটু চোখ বুলানো যাক কয়েকটি পরিসংখ্যানের দিকে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নিয়মিত জরিপে জানা যায়, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মোট ৫৪৪ জন নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তারা এই জরিপ চালায়। এতে দেখা যায় ১২৩টি ধর্ষণ ঘটেছে। তার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ১৫ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১১ জনকে।

এর আগে প্রকাশিত আরেকটি জরিপে জানা যায় ২০১৬ সালে ১ হাজারের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৪২ জন।

বলা যায় দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠি আজ নিরাপত্তাহীনতা ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশংকায় আতংকিত। পথে-ঘাটে, গণপরিবহনে, ঘরে, কর্মক্ষেত্রে, হাসপাতালে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বত্র ঘটছে ধর্ষণ-নির্যাতন।

একটি কথা বলা যায় যে, নারীর প্রতি সহিংসতা মধ্যযুগ থেকে সমাজে রয়েছে। প্রাচীন বাংলায় নারীর স্বাধীন চলাচলের ও অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পরিচয় সাহিত্যে ও অন্যান্য সামাজিক ইতিহাসের অনুষঙ্গে পাওয়া গেলেও মধ্যযুগে নারীর উপর নির্যাতনের প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়। এদেশে মগ ও বর্গির হাঙ্গামায়, নীলকরদের দ্বারা অসংখ্য নারী ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে সম্মানহানির ভয়ে তাদের নাম নিশানাই মুছে ফেলা হয়েছে, বিচার তো অনেক দূরের কথা। অনেক শিশুকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে, অনেক গৃহবধূর মৃত্যু ঘটেছে পারিবারিক নির্যাতনে। কিন্তু তার বিচার হয়নি। বরং চেপে যাওয়া হয়েছে তাদের হাহাকার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নির্মম ও বীভৎস নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতি ‘সম্ভ্রমহানি’ নামের একটি বিশেষণ দিয়ে তাদের সমাজে ব্রাত্য করে ফেলা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের শিকার এই নারীরা তাদের ত্যাগের উপযুক্ত স্বীকৃতি কখনও পাননি।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে নারী বিরোধী ও নির্যাতনমূলক অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশও ঘটেছে এদেশে। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে দমন করার জন্য কিছু অপপ্রচারও এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে নারীর প্রতি নির্যাতনকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে নারী নির্যাতনকারী সন্ত্রাসী, বখাটে অপরাধীদের। গণমাধ্যমের সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকার কারণেই কিন্তু নারীর প্রতি নির্যাতনের চিত্র ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়েছে। গণমাধ্যমের কারণে আমরা এখন নির্যাতনের এই খবরগুলো পাচ্ছি। উপলব্ধি করতে পারছি এর বীভৎসতাকে।

নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণগুলো লুকিয়ে আছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো, পুরুষের মনোজগত এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, ধর্ষণ হলো নারীর উপর পুরুষের ক্ষমতা প্রকাশের একটি বীভৎস রীতি। একজন পুরুষ শুধুমাত্র তার জেন্ডারগত পরিচয়ের কারণে নিজেকে যে কোন অবস্থান ও শিক্ষাগত যোগ্যতার নারীর চেয়ে ক্ষমতাবান বলে মনে করে। এই মনোভাবেরই প্রকাশ হলো ধর্ষণ ও অপরাপর নির্যাতন। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত যে কোন বয়সের নারী তাই ধর্ষণের এবং শুধু নারী হওয়ার কারণে অন্যান্য বিশেষায়িত অপরাধের শিকার হচ্ছেন।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রথমেই প্রয়োজন হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এবং জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা। নারী নির্যাতনকারীদের কোন রকম আশ্রয় প্রশ্রয় না দেওয়া। কোন প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধেও যদি নারী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তাহলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে আইনের শাসন যদি প্রতিষ্ঠা হয় তাহলে অপরাধের পরিমাণ কমতে বাধ্য। নারী ও শিশু নির্যাতনকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। অপরাধীদের দ্রুত বিচার এবং দ্রুত দণ্ডাদেশ কার্যকর করা দরকার। ধর্ষণের দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

এখন পর্যন্ত আমাদের আইনে ভিকটিমকেই প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অথচ প্রয়োজন হলো অভিযুক্তকে যেন নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে হয় সেই ব্যবস্থা করা। রেপ ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষার বিষয়টিও নারীর জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর ও আতংকজনক। অবশ্যই নারী পুলিশের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের এবং নারী চিকিৎসক দ্বারা ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার দাবি জানানো দরকার অবিলম্বে।

যে কোনভাবে ধর্ষণকে রুখতেই হবে। সকল সচেতন নাগরিককে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর /এমএস

আরও পড়ুন