ধর্ষণের বিচারেও ধর্ষণের হাতছানি
ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে পদে পদে ধর্ষণের শিকার হওয়ার হালনাগাদ উদাহরণ বগুড়ায়। নিজে ধর্ষণের পর যুবতীকে বন্ধুদের হাতে তুলে দেয় প্রতারক প্রেমিক লিমন। তারা করে গণধর্ষণ। এসব ধর্ষণের বিচারের আশায় বগুড়ার ধুনটে ইউপি চেয়ারম্যান লাল মিয়ার কাছে গিয়ে আবারো ধর্ষণের শিকার হয় বেচারি। চেয়ারম্যান বলেছেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এরইমধ্যে তিনি ঘটনাকে মিথ্যা প্রমাণের যাবতীয় আয়োজন শেষ করে এনেছেন।
বরগুনার বেতাগীতে শ্রেণিকক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকাকে গণধর্ষণের অভিযোগও মিথ্যা প্রমাণের তেমন বাকি নেই। শেষ হাসি হাসছে গণধর্ষকরাই। বেতাগীর হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের হিরন বিশ্বাসের ছেলে সুমন বিশ্বাস, আব্দুল বারেক মিয়ার ছেলে রাসেল, কুদ্দুস কাজীর ছেলে সুমন কাজী, সুলতান হোসেনের ছেলে রবিউল, রহমানের ছেলে হাসান, রহমান হাওলাদারের ছেলে জুয়েল শিনা টান করে ঘুরছে। জানান দিচ্ছে তাদের হিম্মত। পাবনার সুজানগরে দুই স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের পর সেই দৃশ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার বিচারের আলামতও দুর্বল। ধর্ষণের বিচারের কেস স্টাডি কম-বেশি এমনই।
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে ক্যাচাল আর বন্যার তোড়ে বর্ষণের মতো ঘটে চলা ধর্ষণের খবরগুলো অনেকটা ঢাকাই পড়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে এগুলোর জায়গা হচ্ছে বন্যা-বিচারালয়ের মূল সংবাদের আশপাশে, পেছনে-ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নইলে বগুড়ার তুফান বা রাজধানীর বনানীতে দুই ছাত্রী ধর্ষণের মতো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষিকাকে বা মাকে বেঁধে রেখে মেয়েকে ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে হয়তো আরো জায়গা পেতো। অবশ্য গণমাধ্যমে গরম সংবাদ হলেই বা কি?
এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে তোলপাড় হয়ে যাওয়া ধর্ষণ-গণধর্ষণের খবরগুলোর ফলো আপ কী? ধর্ষণের এমন বর্বরতা নিত্য ঘটে চললেও শাস্তির খবর নগণ্য। বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবনসহ কারাদণ্ড ও জরিমানা। কিন্তু ক’টা ধর্ষকের তা হয়? সোজা হিসাবে শতে একজন ধর্ষকেরও শাস্তি হয় না। পুলিশ সদর দপ্তর এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে ধর্ষণ মামলায় সাজা হয় হাজারে বড় জোর ৪ জনের। শতকরা .৪০। বিচারের যাবতীয় পর্ব পরতে পরতে ধর্ষকেরই পক্ষে। এর প্রধান কারণ আইনের ত্রুটি। দ্বিতীয়ত ফরেনসিক টেস্টের সীমাবদ্ধতা, প্রভাবশালীদের চাপসহ সামাজিক বাস্তবতা।
অধিকাংশ সমাজেই পুরুষ নিজেদের দুর্দান্ত ক্ষমতাবান ভাবে। তার গায়ে জোর বেশি, পকেটে পয়সাও বেশি। ভাবনা মতোই কাজ। নারী দেহের ওপর তার একচেটিয়া অধিকার বোধ তার শৈশবাবধি। তা পরিবারে, পরিবারের বাইরেও। অপরাধ করেও পার পাওয়ার সত্যের সাথে পরিচিত। তা সে ১৩ বছরের শিশু, ৩১ বছরের যুবক বা ৬২ বছরের প্রৌঢ় যা-ই হোক। এটি তার পৌরুষের প্রকাশ। অবিভাজ্য অধিকার।
অন্যদিকে, এখনো ধর্ষণের যতো দোষ নারীদের ওপরই বর্তায়। এতো রাতে বাইরে কেন, পোশাক কেন এতো উত্তেজক- এমন প্রশ্নের জবাব দেয়া ধর্ষিতার পক্ষে কঠিন। ধর্ষণের পর হরহামেশাই শুনতে হয় এমন প্রশ্ন। পুলিশের কাছে গেলেও এ ধরনের প্রশ্নের পর প্রশ্ন। সেইসাথে মুখ টিপে হাসি, লোলুপ দৃষ্টি, কাছে যাওয়ার ইশারা। প্রমাণ হিসেবে সাক্ষী হাজির করার তাগিদ। আর ধর্ষকের অনুকূলে টাকার খেলা, জোর তদ্বির। এ অবস্থায় অবশিষ্ট ইজ্জত-সম্ভ্রমের ভয়ে সব ধর্ষণের অভিযোগ পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় না। এরপরও যারা জেদের চোটে অগ্রসর হন তাদের পরিণতি বড় নির্মম। শাস্তির ব্যাপারে সংশয় নিয়েই আইন-আদালতে ছোটাছুটি। সেইপথের ঘটনাগুলোর তথ্য বড় ভয়ানক। বগুড়ার ঘটনা তারই একটা নমুনামাত্র।
কেবল এ দেশে নয়, গোটা দুনিয়াতে ক্ষমতাবানেরা চিরকালই ধর্ষণের ব্যাপারটা মামুলি ব্যাপার। শান্তি রক্ষার নামে কম্বোডিয়ায় ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে জাতিসংঘের এক উপমহাসচিব বলেছিলেন,‘বয়েজ উইল বি বয়েজ।’ যার বাংলা তরজমা: পোলাপাইনে এমনই করে, করবেই। আমেরিকায় এক সিনেটর ধর্ষণের ব্যাপারে বলেছিলেন, ধর্ষণ বৃষ্টির মতো। আর ধর্ষণের শিকার মেয়েদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, অভিযোগ না করে তা উপভোগ করতে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নারীদের ওপর ধর্ষণের অভিযোগ নিয়েও কথাবার্তা এমনই। তদন্ত কমিশনের তার প্রধান বলেছেন, ‘আমাদের সৈনিকেরা কখনোই ডার্টি রোহিঙ্গা মেয়েদের ধর্ষণ করার কথা নয় ।’
একাত্তরে এ অঞ্চলেও ছিল প্রায় এমন মূল্যায়নই। ধর্ষকদের পক্ষ নিয়ে বলা হয়েছিল, গনিমতের মাল নিয়ে একটু-আধটু নাড়াচাড়া করাই যায়। রাজধানীর বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের শিরোমনি শাফাতের বাবা স্বর্ণব্যবসায়ী দিলদার সাহেবের প্রতিক্রিয়াও ছিল এমনই। ঘটনার পর গণমাধ্যমে হৈচৈয়ের জবাবে তিনি বলেছেন, ছেলেরা এমন করেই থাকে। তিনিও করেন।
ধর্ষকরা গড়ে কোনো কোনোভাবে প্রভাবশালী। দু’একটা নিজে অক্ষম হলেও প্রভাবশালীর দোয়া বা দয়া হাছিল করতে সক্ষম। ধর্ষিত, তার পরিবার ও মামলাকে আয়ত্ত্বে এনে সমঝোতার ঠকবাজিতে সফল হয়। অন্যদিকে, ধর্ষণের শিকার নারী অথবা শিশুর পরিবার সামাজিক কারণে ঘটনাটি চেপে যেতে চায়। এতে সুযোগ পুরোটাই ধর্ষকের। শাস্তির ধারেকাছেও যেতে হয় না তাকে। আইনের ফাঁকটা ছিদ্র বা সুড়ঙ্গের মতো নয়। বেশ মোটাসোটা। গণধর্ষক বা ধর্ষকগণের র্যা লি করে যাতায়াতের মতো। মামলায় তাদের প্রমাণ করতে হয় না সে বা তারা ধর্ষণ করেছে। বরং মামলা দায়ের থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় নারীকেই প্রমাণ দিতে হয় যে তিনি ধর্ষিত হয়েছেন। এ প্রমাণ দিতে গিয়ে ওই বেচারিকে দফায় দফায় 'ধর্ষিত'ই হতে হয়।
ধর্ষিত কোনো নারীর পক্ষে এতে মনোবল থাকা বা রাখা অসম্ভব। আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে কারণ দেখিয়ে বাড়তি সময় নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে মামলা শেষ হতে ১০-২০ বছরও লেগে যাচ্ছে। আর তদ্দিনে ধর্ষিতকে ধর্ষণের বিবরণ ও প্রমাণ দিতে দিতে বারবার ধর্ষণের দিকেই এগুতে হয়। শারীরিক পরীক্ষায়ও ধর্ষণ প্রমাণ করা কঠিন। সেখানেও টাকার খেলা। আসামীর ধর্ষণের ক্ষমতাই নেই- এমন প্রমাণও দাঁড় করানো সম্ভব হয় টাকার জোরে।
থানায় পুলিশের পর আদালতে আসামি পক্ষের আইনজীবীর প্রশ্নের তীরে ওই নারীকে আবারও ধর্ষণের বীভৎস অভিজ্ঞতাই নিতে হয়। তা করতে গিয়ে অনেকে একঘরে হয়ে পড়েন। একটা সময় বিচার নিয়ে হতাশার সঙ্গে অস্বাভাবিকও হয়ে পড়েন। কখনো কখনো ধর্ষণের অভিযোগ তুলে নিয়ে নিজেই আসামী হয়ে যান। মামলার মাঝপথে ধর্ষিতপক্ষ আদালতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নও করে দেয়। তখন পুলিশেরও আর করার কিছু থাকে না। বাদি আর আসামির বিয়ে বা আর্থিক লেনদেনে ধর্ষণের ফয়সালা করার বহু ঘটনাও রয়েছে। পেনাল্টির মতো জয়ী হয়ে গোলটা দেয় ধর্ষকই।
নীলফামারীর ডিমলায় মাকে বেঁধে মেয়েকে তুলে নিয়ে ৭/৮ জন মিলে ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ডাক্তার। তাতেই বিচার কি নিশ্চিত? সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে যমুনার চরে এক ছাত্রীকে ছাত্রলীগের পাঁচ কর্মীর গণধর্ষণ চেষ্টাসহ বেশিরভাগ ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের লোকরাই জড়িত। বগুড়ার তুফান সরকার সরকারি দল শ্রমিক লীগের নেতা। টাঙ্গাইলের সখীপুরে তরুণীকে ৬ মাসেরও বেশি সময় আটকে রেখে ধর্ষণের হোতা বাদল মিয়া প্রথমত, ওই কিশোরীর চাচা, দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দলের হোমরা-চোমরা। পাবনার সুজানগরের ধর্ষকরা পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা আবদুল ওয়াহাবের কর্মী-সমর্থক। বগুড়া বা সিরাজগঞ্জের ঘটনাদৃষ্টে ক্ষমতাসীন দল এগিয়ে থাকলেও এই পশুত্বের স্টিয়ারিংয়ে পুলিশ বা শিক্ষকরাও পিছিয়ে নেই।
রাজধানীতে সহকর্মী নারী পুলিশ কনস্টেবলকে ধর্ষণের অভিযোগ কনস্টেবল আরিফুল ইসলামকে সহকর্মীরা গ্রেফতার করেছে। এর পর কি হবে? আরিফের শাস্তি হবে সেই নিশ্চয়তা কদ্দূর? এর আগে, এর আগে গত ২ এপ্রিল ময়মনসিংহের গৌরীপুর থানার ব্যারাকে শরীরে আগুন দিয়ে মহিলা কনস্টেবলের আত্মহত্যার কারণ তারই সহকর্মী পুলিশ অফিসার। সে হালিমাকে ধর্ষণ করে ১৭ মার্চ মধ্যরাতে। মহিলা কনস্টেবল আত্মহত্যার আগে নোট লিখে যান ওসি তার অভিযোগ গ্রহণই করেননি। নিজ ব্যারাকে ধর্ষণের পর উল্টো সহকর্মীরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। এই অপমান সইতে না পেরে এবং বিচার না পাওয়ার নমুনা দেখেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় এই নারী কনস্টেবল।দলের না হলেও এ ধরনের আজাবের দায়ভার রাষ্ট্রের ওপরই পড়ে। দোষী সাব্যস্ত হয় সরকার ও দল।
সরকার বা ক্ষমতাসীন দল এ ব্যাপারে নেতাকর্মীদের কোনো প্রণোদনা বা ছাড় দেয় এমনটি নয়। এদেশে খরা, অতিবৃষ্টির জন্যেও সরকারকে দোষারোপের বাজার বরাবরই ভালো। সেই চর্চায় ধর্ষণের দায়ও পড়ছে সরকারের ঘাড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতাকর্মীর কাণ্ড বাদ দিয়ে বাকি ধর্ষণগুলোর দায়ও কেন টানছে সরকার? মানুষ সাদাচোখে আইনের ফাঁকফোকর দেখে না। দেখে এলাকার ‘হিরো’র মতো ধর্ষকদের অধরা দৃশ্য।
বাংলাদেশে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণের চেষ্টা হয় ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার ভিত্তিতে। এতে ধর্ষণের শিকার নারীর স্বভাব-চরিত্র এবং ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু ধর্ষকের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। ধর্ষকের আইনজীবী এই সুযোগটা ষোলোআনাই নেন। ধর্ষণের শিকার নারীর নৈতিক চরিত্র হরণ করে তার ছোঁড়া প্রশ্নগুলো ওই নারীকে আরেকবার ধর্ষণের মতোই। এই উপধারাটি বাতিলের পক্ষে বহুবার বহু মতামত দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতিসহ আইন–সংশ্লিষ্টরা এটি বাতিলের সুপারিশও করেছেন। বিদ্যমান আইন ও বিধির মধ্যে হয়রানি থেকে নারীকে রক্ষা আদালত এবং বিচারকের পক্ষে সহজ নয়। এরপরও তা অক্ষতভাবে বহাল রাখায় কী উপকার পায় সরকার? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য আইনের এ ধরনের ধারা বাতিল করা হয়েছে। এই ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করা কি বেশি কঠিন?
লেখক: বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর