সুস্থ দেহে মেতে উঠি ঈদ আনন্দে
ঈদ মোবারক। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ঈদুল আজহা যেন সত্যিকার অর্থেই লোভ-লালসামুক্ত একটা সমাজ উপহার দিতে পারে, শান্তিময় দেশগঠনে ভূমিকা রাখতে পারে- সকলের মতো আমিও আমার লেখার শুরুতেই সেই আশা হৃদয়ে পোষণ করি। ধনী-গরীব, জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ মিলেমিশে এমন উৎসব পালন বাঙালির চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির অংশ। এ কারণে ধর্মীয় বা জাতিগত উৎসব—সেটা যাই হোক না কেন- আমাদের কাছে তা হয়ে ওঠে সার্বজনীন আনন্দ উৎসব পালনের একটা অনন্য উপলক্ষ্য। এ কারণে দেখা যায় নানা ধরনের উৎসব পালনে আমাদের মাঝে উৎসাহের বিন্দুমাত্র কমতি থাকে না।
যদিও এবারের বন্যায় আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ তাদের স্থাবর এবং অস্থাবর সহায় সম্পদ হারিয়ে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। ঈদের আনন্দ তাই তাদের কাছে এবার উপভোগ্য হয়ে ওঠার কথা না। সেই সাথে এ মাসের শেষে যে সার্বজনীন দুর্গাপূজা উদযাপনের সময় আসছে সেটাও এবার তাদের কাছে আনন্দের তেমন কোনো উৎস হয়ে উঠবে বলে মনে হয় না। এ কষ্টের মাঝেও তবু ঈদ উদযাপিত হবে হৃদয়ের যাতনা কমানোর জন্যেই। কারণ আনন্দের মাঝে মানুষ কিছুটা হলেও তার হতাশা ভুলে যায়। ভুলে যায় তার আক্ষেপের কথা।
ঈদুল আজহার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে কোরবানি শেষে সে মাংস ভাগ বাটোয়ারা করা। সেটা বিতরণ করা হয় গরীব মেহনতি মানুষ এবং আত্মীয় স্বজনের মাঝে। এর ফলে ঈদ পায় তার সার্বজনীন পরিপূর্ণতা। হয়ে ওঠে আনন্দের এক মিলনমেলা। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, যে কোনো উৎসব বা আনন্দের সময় আমরা অনেক সময় ভুলে যাই আমাদের শারীরিক অসুস্থতার কথা। ভুলে যাই খাবার এবং ওষুধ খাওয়ার নিয়ম কানুন মেনে চলা বা বিধি নিষেধ যদি কিছু থাকে তা পালনের কথা। মনে হয়, মাত্র দু’একদিনই তো! দুই একদিন নিয়ম না মানলে বা এদিক ওদিক করে ওষুধ খেলে কি আর এমন ক্ষতি হবে! আর উৎসবের সময় এরকম একটু আধটু তো হয়ই!
কিন্তু মনে রাখবেন, এটা এমন এক মারাত্মক রকমের ভুল ধারণা যার ফলে আপনার বা আপনার প্রিয়জনের শারীরিক জটিলতা তৈরির আশংকা কিন্তু বেড়ে যায়। এমন অবহেলাজনিত ভুলের কারণে ( যাকে আমরা ছোটেখাটো বলে মনে করছি!) কিন্তু জীবন সংশয়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই এ ব্যাপারে অন্যান্য দিনের মতোই কিন্তু খাবার দাবার গ্রহণের বাধ্যবাধকতা যতটা সম্ভব পারা যায় সেটা মেনে চলতে হবে। আর ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু বিন্দুমাত্রও ঢিলেমি করা যাবে না। কারণ, তাতে আপনার ঈদ আনন্দ আয়োজন কিন্তু পণ্ড হয়ে যেতে পারে।
যেমন ধরুণ, একজন ডায়াবেটিসের রোগী। তিনি সকালে ওষুধ খেলেন না। বা ইনসুলিন নিলেন না। আবার ইচ্ছেমতো মিষ্টি, সেমাই , কোল্ড ড্রিংক্স এসব খেলেন। তাহলে খুব দ্রুত কিন্তু রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। তাতে কিন্তু আপনার অস্বস্তিও হঠাৎ করেই বেড়ে যেতে পারে। অথবা ডায়াবেটিসের রোগী প্রয়োজনীয় ওষুধ খেয়েছেন বা ইনসুলিন নিয়েছেন কিন্তু যথাসময়ে যদি খাবার না খেলেও অবস্থা কিন্তু ভয়াবহ হতে পারে। কারণ, এতে রক্তে চিনির পরিমাণ অতিরিক্ত কমে গিয়ে প্রাণহানির সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তাহলে এবার বুঝুন, এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকাটা কত গুরুত্বপূর্ণ!
আবার একজন হৃদরোগী কিন্তু দিনে বেশকিছু ওষুধ খান। যেখানেই ঘুরতে যান না কেন বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করলে জিহ্বার নিচে এক ধরনের স্প্রে ব্যবহার করে থাকেন। কোনো কারণে সেটা সময়মতো কাছেপিঠে না থাকলে কিন্তু বড়সড় রকমের বিপদ ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়। তাছাড়া হৃদরোগীরাও যতটা সম্ভব তেল, চর্বি জাতীয় খাবার, কোল্ড ড্রিংক্স, আইসক্রিম এগুলো এড়িয়ে চলুন। অন্ততপক্ষে একবারে বেশি খাবেন না। হাই প্রেশারের রোগীরা নিয়মিতভাবে প্রেশারের ওষুধ খান। যে সকল খাবার খেতে চিকিৎসক নিষেধ করেছেন – সেগুলো পারলে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। যাদের হজমে সমস্যা হয় তারাও মসলাদার খাবার গ্রহণে সতর্ক থাকুন। পারলে কম তেল, মসলা দিয়ে আপনার খাবার আলাদাভাবে রান্না করুন।
আমরা অধিকাংশ মানুষই ঈদে “নাড়ির টানে বাড়ি ফিরি”; মানে গ্রামে ফিরে যাই। গ্রামের এমন নির্মল পরিবেশ, সবুজ প্রকৃতি আমাদেরকে আপ্লুত করে। এমন পরিবেশ কিন্তু হাঁটাহাঁটি করার জন্য খুবই উপযুক্ত। তাই অল্প স্বল্প দূরত্বে কোথাও যেতে হলে হেঁটেই যান। বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে গেলে যেহেতু কিছু না কিছু মুখে দিতেই হয় তাই আসার সময় সেখান থেকে সম্ভব হলে হেঁটেই বাড়ি ফিরুন। যাওয়ার সময়ও হেঁটেই যান। তাহলে রক্তে চিনির পরিমাণ কিন্তু অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
এটা ঠিক, ঈদের সময় আমরা তেল, মসলাজাতীয় খাবার, মাংস এসবই বেশি করে খাই। সেটা খাবেন নিশ্চয়ই। সেটা খাওয়া ঠিকই আছে। তবে, গ্রামে শাকসবজি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় তাই এসব খাবারের সাথে সালাদ এবং সবজিও খান। এতে খাবার দাবার হজম করাও কিন্তু সহজ হয়। অনেকে গ্রামে গিয়ে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেন কিন্তু পানি খেতে ভুলে যান। বা পরিমাণে কম খান। এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকুন।
এ সময়ে তাই প্রচুর পানি পান করুন। গ্রামের পরিবেশে বুক ভরে শ্বাস নিন। হাঁটাহাঁটি করুন। বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিলে আগামীতে নিজের গ্রামে অন্তত ভালো কোনো কিছু শুরু করা যায় কিনা সে ব্যাপারে আলোচনা করুন। পারলে পাঠাগার তৈরি করুন সকলে মিলে। এসবই করবেন অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে। আগ্রহ ভরে।
কিন্তু শরীরের দিকেও খেয়াল রাখতে ভুলবেন না। নিজের এবং পরিবারের অসুস্থ মানুষটির কথা ভুলে যাবেন না। প্রয়োজনীয় ওষুধ তিনি খাচ্ছেন কিনা সেটা নিশ্চিত করুন। পরিবার, প্রতিবেশি এবং আত্মীয়স্বজন সকলে মিলেমিশে সুন্দর পরিবেশে এবং সুস্থ দেহে ঈদ আনন্দ উদযাপন করুন- সে কামনা করছি। আবারও ঈদ মোবারক।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।
এইচআর/জেআইএম