ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সবার পাশে দাঁড়াতে পারার নামই ঈদ

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ০৩:৫৫ এএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

কোরবানি ঈদ শেষ হলো। ঈদের বেশ আগে থেকে শুরু হওয়া ঢাকা শহরের ভয়ংকর জ্যাম, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটকে আরও সংকীর্ণ করে এখানে সেখানে পশুর হাট, হয়তো হাটও নয়, রাস্তার ওপর দশটি গরু, পাঁচটি ছাগল বেঁধে রেখে পথচারীদের দুর্ভোগ বাড়ানো, লঞ্চ, ট্রেন, বাসে অকল্পনীয় ভিড়, ট্রেনের ছাদে মানুষের মেলা, ডুবু ডুবু জলযান, বাসের টিকেট উধাও এসবের পালা সমাপ্ত প্রায়।

প্রাণ হাতে করে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছানো হয়েছে। এখন ফেরার পথের ঝক্কি রয়েছে। তবু যাওয়ার সময় যত ভোগান্তি ফেরার সময় ততো নয়। ঢাকা অন্তত কিছুটা হলেও ফাঁকা। ডাস্টবিনে ও গলিঘুচিতে পশুর বর্জ্যর দুর্গন্ধ রয়ে গেছে যদিও। এ বছর এমন এক পরিস্থিতিতে পালিত হয়েছে ঈদ বন্যায় যখন তলিয়ে গেছে অনেক অঞ্চল, অভাব রয়েছে ঘরে ঘরে, বানভাসিদের দুর্ভোগের সীমা নেই। প্রকৃতির বৈরিতার পাশাপাশি মানুষের নির্মমতারও শেষ ছিল না। রাস্তায় চাঁদাবাজি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, ছিনতাই দৌরাত্ম সহ্য করতে হয়েছে হাটে পশু বিক্রি করতে আসা বিক্রেতাদের। ক্রেতাদেরও গেছে ঝক্কি ঝামেলা।

ঈদ উদযাপন শেষে যারা ফিরছেন গ্রামের বাড়ি থেকে বা ফেরা শুরু করবেন এ সপ্তাহেই তাদের কথা ভাবছি আর কয়েকটি দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে। বৃদ্ধ মা বাবা, যারা সারা বছর থাকেন সন্তানের বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষায় তাদের অপেক্ষার পালা আবার শুরু হবে। আগামী বছরের জন্য। ঈদের দিনগুলোতেই তো কাছে পাওয়া যায় শহরবাসী হয়ে যাওয়া ব্যস্ত সন্তানকে। কিন্তু এই বড় হয়ে যাওয়া সন্তানদের মধ্যে কয়েকজন ঈদের সময় বৃদ্ধ বাবা মা কিংবা আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে ঈদ কাটানোকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় বলে ভাবেন না।

হয়তো ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে ব্যাংকক, সিংগাপুরে তাদের জন্য ছুটি কাটানোর আকর্ষণ থাকে আরও বেশি মাত্রায়। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি পর্যটনের বিরোধী নই মোটেই। কিন্তু বড় উৎসবগুলো আমি বাবা-মা আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কাটাতে বেশি ভালোবাসি। বিশেষ করে উৎসবগুলো প্রবীণ বাবা মায়ের জন্য উৎসর্গ করাটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত পছন্দ। আমার প্রায়ই মনে পড়ে সেই বিখ্যাত কবিতাটি, ‘আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি, খোকা তুই কবে আসবি, কবে ছুটি?’ বাবা-মা কত আশা করে থাকেন সন্তানের ছুটির- একথা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। এই ছুটি কাটানো নিয়েও অবশ্য অনেক দাম্পত্য ঝগড়ার সূত্রপাত হয়। বাবার বাড়িতে ও শ্বশুর বাড়িতে ঈদের ছুটি কাটানোর মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে চাপা ক্ষোভ ও অভিমান। দুই ঈদ দুই পরিবারের সঙ্গে কাটালে অবশ্য বিষয়টি ব্যালেন্স করা সম্ভব।

দাদা-দাদী, নানা-নানীরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন ঈদের এই ক’টি দিন প্রিয় নাতি-নাতনিদের দেখার জন্য। বৃদ্ধ বয়সে এটুকুই তাদের চাওয়া। শিশুদেরও পরিচয় করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন শিকড়ের সঙ্গে, বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রকৃতির সঙ্গে। সারা বছর কোচিং আর হোমওয়ার্কের চাপে ওরা তো ভুলেই যাচ্ছে ঘাসের রঙ, আকাশের মেঘ, জোনাকির আলো, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরার আনন্দ। ঈদের ছুটির সুযোগে গ্রামের জীবনের সঙ্গে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়।

গ্রামে শুধু আপনজনরাই নন পাড়া প্রতিবেশিও আছেন। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা এক সময় নিবিড় ছিল। যৌথ পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু প্রতিবেশি, কুটুম নিয়ে এক সময় আমাদের একটি নিজস্ব সমাজ কাঠামো ছিল। সেখানে আমরা একে অন্যের পাশে দাঁড়াতাম। পরস্পরের খোঁজ খবর নিতাম। উৎসবগুলো তখন সত্যিকারের উৎসব ছিল। শুধু আনন্দে নয়, দুঃখেও। অন্তত চোখের জল মোছার জন্যও তো কারও হাতের প্রয়োজন হয়।

এখন নাগরিক জীবনে আমরা বড় বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছি। আমাদের শিশুরা আরও বেশি নিঃসঙ্গ। টিভি আর কম্পিউটার ছাড়া ওদের বন্ধু নেই। যারা ঈদ কাটাচ্ছেন ঢাকায় তারা এই ছুটিতে শিশুকে সময় দিন। টিভি দেখতে দেখতে বা ফেস বুকিং করতে করতে দেওয়া সময় নয়। দরকার কোয়ালিটি টাইম। যেখানে তাকে বই পড়ে শোনানো যায়, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া যায় কোথাও।

আমার ছোটবেলায় দেখেছি ঢাকায় চকবাজারে ঈদের মেলা বসতো। সেখানে মাটির খেলনা, নাগরদোলা, মুরলি, বাতাসা, কটকটি, কুলফি মালাইকে ঘিরে শিশুদের উল্লাসধ্বনি শোনা যেত। একালে থিম পার্কের ভিড়ে ঈদের মেলার সেই প্রাণের স্পর্শ পাওয়া মুশকিল। এরপরও ঈদ এলে চোখে ভাসে সেই পথ শিশুদের মুখ যারা কোরবানির একটুকরো মাংস সংগ্রহের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে সারাটা দিন। ওদের ঈদটাকে একটু সুন্দর করার জন্য আমরা কে কতটুকু কি করেছি তা জানি না।
বানভাসি মানুষদের প্রতিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি কতজন? কোরবানির ঈদ মানেই মাংস খাওয়া আর নিত্য নতুন রেসিপির ঘটা নয়। বরং সবার পাশে দাঁড়াতে পারার নামই ঈদ। ঈদের এই মূল সত্যটা আমরা আর কতদিন ভুলে থাকবো কে জানে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন