শুকনো কথায় চিড়ে ভিজবে না
ভিনি ভিডি ভিসি। এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। বলতে দ্বিধা নেই, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি আমার হৃদয় জয় করেছেন। যারা আমার লেখা ফলো করেন, তারা জানেন, আমি কট্টর মোদিবিরোধী মানুষ ছিলাম। গত বইমেলায় তাম্প্রলিপি থেকে প্রকাশিত আমার বই ‘স্বৈরাচারের দালাল বলছি’র শেষ নিবন্ধ ‘দিল্লীতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরবেন না’তেও মোদির ব্যাপারে আমার নেতিবাচক মনোভাবে তুলে ধরেছি। তাতে মোদিকে দাঙাবাজ, উগ্র সাম্প্রদায়িক, বাংলাদেশবিদ্বেষী হিসেবে অভিহিত করেছিলাম। নির্বাচনী প্রচারণায়ও তিনি প্রকাশ্যে বাংলাদেশবিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন। সে লেখায় আমি তার জন্য ঘৃণা প্রকাশ করেছিলাম।
আমি স্বীকার করছি, আমার হৃদয়ে মোদি সম্পর্কে যে বিদ্বেষ ছিল, ঘৃণা ছিল, নেতিবাচক ধারণা ছিল; তা মুছে গেছে, ঘৃণা বদলে গেছে ভালোবাসায়। চরম হতাশা নিয়ে সে লেখায় আশার জায়গা একটাই ‘বিজেপির বিশাল বিজয় আমার শঙ্কা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বিশাল বিজয় মোদিকে আরো আত্মবিশ্বাসী করবে, যা তাকে আরো বেপরোয়াও করতে পারে। আশার জায়গা একটাই, বড় দায়িত্ব মানুষকে উদার করে, বড় করে। ভারতের মত বড় গণতন্ত্রের দায়িত্ব যদি করপোরেটদের নেতা নরেন্দ্র মোদিকে সত্যিকারের জাতীয় নেতায় বদলে দেয়, তাহলেই সবার জন্য মঙ্গল।’ আমি খুবই আনন্দিত যে আমার সকল শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সত্যি হয়েছে, আমার ছোট্ট আশাবাদটাই। তবে সত্যি হয়েছে, আমার প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে।
আমি প্রত্যাশা করেছিলাম, নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের আঞ্চলিক নেতা থেকে জাতীয় নেতায় বদলে যাবেন। কিন্তু মোদি এখন আর শুধু ভারতের নেতাও নন, ইতিমধ্যে মোদি নিজেকে আঞ্চলিক নেতায় পরিণত করেছেন। দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছেন, বিশ্ব নেতৃত্বের দিকে। মোদি যেভাবে এগুচ্ছেন, তাতে একশবছর পর ভারতের তিনজন প্রধানমন্ত্রীকেই মানুষ মনে রাখবে- জওহারলাল নেহেরু, ইন্ধিরা গান্ধী ও নরেন্দ্র মোদি।
পয়ষট্টি বছরেও টগবগে তরুণের মত উচ্ছল নরেন্দ্র মোদি গত একবছরে বাংলাদেশসহ মোট ১৯টি দেশ সফর করেছেন। সব জায়গাতেই মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন মোদি। সবখানেই উষ্ণ আন্তরিক হৃদয়ের ছোঁয়া ছিল, যা উপেক্ষা করা যে কারো জন্য কঠিন। দেশ শাসনের জন্য, প্রতিপক্ষের হৃদয় জয় করার জন্য মোদি প্রচলিত রাজনীতি, প্রচলিত কূটনীতি ঝেড়ে ফেলে নতুন করে চিন্তা করছেন। বারাক ওবামাকে তিনি চায়ের কাপ এগিয়ে দেন। এতে হয়তো প্রচলিত কূটনীতির ব্যত্যয় হয়। কিন্তু যে আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটে, তা প্রতিপক্ষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
তারুণ্যের উচ্ছলতায় চীনের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সেলফি তুলে তা আবার সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে কূটনীতিতে ঝড় তুলেছেন তিনি। ফেসবুক আর টুইটারে যে কোনো তরুণের চেয়ে বেশি সক্রিয় মোদি। কেউ যদি মোদির ফেসবুক পেজ ফলো করেন, তাহলে তাকে আর আলাদা করে পত্রিকা পড়তে হবে না। বাংলাদেশে আসার দুদিন আগেই ফেসবুক পেইজে সফর সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন। বিমানে বসেই বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভালোবাসা নিয়ে এসেছেন। তারপর একের পর এক স্ট্যাটাসে সব আপডেট করে গেছেন ছবিসহ। চীন গিয়ে চীনা ভাষায় স্ট্যাটাস হৃদয় কেড়েছেন সে দেশের জনগণের। বাংলাদেশে এসেও স্ট্যাটাস দিয়েছেন বাংলায়। আমি খালি মুগ্ধ হয়ে একজন দাঙাবাজের অমন একজন আন্তর্জাতিক নেতায় বদলে যাওয়া দেখি আর অবাক হই।
সব সফরেই মোদি কোনো না কোনো একটা চমক দেন। কিন্তু বাংলাদেশ সফরে কোনো চমক নেই। ৩৬ ঘণ্টার বাংলাদেশ সফরে যা হয়েছে সবই পূর্বনির্ধারিত। নতুন কিছু হওয়ার কথা ছিল না, হয়ওনি। চমক বলতে, নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য। সফরের শেষ কর্মসূচি হিসেবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এক ঘণ্টার এক ম্যাজিকেল বক্তৃতায় বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছেন নরেন্দ্র মোদি। সব সফরেই মোদি এমন একটি বক্তব্য দেন। এবারের সফরসূচি দেখে আগেই আমার ধারণা ছিল, শেষ অনুষ্ঠানেই মোদি মেলে ধরবেন নিজেকে। তাই এটা আমার জন্য চমক হয়ে আসেনি। তবে তার বক্তৃতা যতটা ভালো হবে ভেবেছিলাম, তারচেয়েও ভালো হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই ভারত একটি বড় ইস্যু। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সহায়তার কথা আমরা বরাবরই কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। কিন্তু এত বড় ত্যাগের পরও খুব শিগগিরই আমাদের দেশে ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। এতে যতটা দায় আমাদের, ততটাই ভারতের। তাদের দাদাগিরিটা কখনোই আমার ভালো লাগেনি। এই প্রথম ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে দাদাগিরি নয়, ভারত সত্যিই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে। কয়েকদিন আগে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের সময় ভারতের লোকসভায় সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তার দেশকে বাংলাদেশের ‘এলডার ব্রাদার’ না হয়ে ‘বিগ ব্রাদার’ হওয়ার কথা বলেন। নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য এলডার ব্রাদারসুলভ ছিল না, ছিল বিগ ব্রাদারসুলভ।
আমার ভালো লাগাটা এই জন্যই। তার বক্তব্যে আন্তরিকতা ছিল, উষ্ণতা ছিল, বিদ্বেষ ছিল না। তিনি শুধু পাশে পাশে নয়, সাথে সাথে চলার অঙ্গীকার করেন। মোদির এবারের সফরের মূল এজেন্ডা ছিল আসলে স্থলসীমান্ত চুক্তি। ৬৮ বছর ধরে বাংলাদেশ আর ভারতের পেটের ভেতরে বুদবুদের মত জিইয়ে থাকা ১৬২টি ছিটমহলের মানুষ নিজ দেশে পরবাসী ছিলেন। তাদের কোনো পরিচয় ছিল না। ৪১ বছর আগে মুজিব-ইন্দিরা এই চুক্তিতে সই করেছিলেন। বাংলাদেশ অনেক আগেই এই চুক্তি অনুমোদন করেছে। ভারত অনুমোদন করতে অনেক সময় নিয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে ভারত অনেক সময় নিয়েছে। কিন্তু বেটার লেইট দ্যান নেভার। সবুরে মেওয়া ফলে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ভারতের লোকসভায় সর্বসম্মতভাবে বিলটি পাশ হয়েছে এবং সেদিন লোকসভায় বাংলাদেশের প্রতি ভারতের ভালোবাসার যে নজির স্থাপিত হয়েছে, তা সত্যিই বিরল। সব দলকে আস্থায় নিয়ে এত বড় কাজটি করার কৃতিত্ব অবশ্যই মোদির।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই ভারত একটা বড় ইস্যু। কিছু লোক অন্ধের মত ভারতের পক্ষে রাজনীতি করেছে, কিছু লোক ভারতের বিরুদ্ধে। একটা কথা কেউ কখনো ভাবেনি, ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী। তিন দিক থেকে ভারত আমাদের ঘিড়ে রেখেছে। অন্ধের মত ভারত বিরোধিতা করে, ভারতকে চটিয়ে আমাদের পক্ষে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার এটাও সত্যি, আমাদের চটিয়ে ভারতের পক্ষেও স্থিতিশীল থাকা সম্ভব নয়। এটা প্রমাণিত। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকার সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের জ্ঞাতসারেই ১০ ট্রাক অস্ত্র যাচ্ছিল ভারতে। একটি চালান ধরা পড়েছে, কে জানে আরো কটি চালান যেতে পেরেছে। তাই ভারত বুঝে গেছে, বাংলাদেশকে আস্থায় না রেখে তাদের পক্ষে স্থিতিশীল থাকা সম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে সে আশ্বাস দিতে পেরেছে, তাই ভারতও আওয়ামী লীগকে শর্তহীন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি দেরিতে হলেও বুঝেছে, অন্ধ ভারতবিরোধিতার রাজনীতি দিয়ে আর এগুনো যাবে না। জামায়াতের ডাকা হরতালের অজুহাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাত বাতিল করার খেসারত অনেক দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া, এখনও দিচ্ছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতিকে অপমানের খেসারত হিসেবে এবার নরেন্দ্র মোদির সাথে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের বিষয়টি ঝুলে ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। এটাও ঠিক খালেদা জিয়া এখন প্রধানমন্ত্রী নন, বিরোধী দলীয় নেত্রী নন, এমনকি এমপিও নন। তাই মোদির সাথে তার সাক্ষাতের বিষয়টি নিতান্তই ভারতের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছিল। এই সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করতে বিএনপি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে, আমরা কখনো ভারতবিরোধী রাজনীতি করিনি। তারপরও পর্দার পেছনে অনেক দেনদরবার করে সফরের আগের দিন বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষায় রেখে ভারত সাক্ষাতের সময় নিশ্চিত করেছে। সাক্ষাতের সময় ছিল রোববার বিকাল ৪টায়। কিন্তু অতি সতর্ক খালেদা জিয়া আধঘণ্টা আগেই কারওয়ানবাজারে চলে আসেন।
শেষ পর্যন্ত কারওয়ানবাজারেরই একটি অফিসে তিনি অপেক্ষা করেছেন। আর বেগম জিয়া মোদির সাথে দেখা করেছেন পয়েন্টস লেখা কাগজের টুকরা হাতে। রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব আর কাকে বলে! বেগম জিয়া মোদির কাছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার কথা বলেছেন। আর মোদি বলে দিয়েছেন, তারা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে তারা থাকবেন না। শেষ বক্তৃতায় মোদি বারবার শেখ হাসিনার সাথে সুর মিলিয়ে উন্নয়নের কথা বলেছেন, একবারও গণতন্ত্রের কথা বলেননি। তার মানে আওয়ামী লীগ এখন যে সুর তুলেছে, আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র, মোদি তাকেই অনুমোদন দিয়ে গেলেন। যদিও আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন অর্থহীন।
মোদির এবারের সফর আমাদের রাজনীতির একটি স্থায়ী ক্ষতি করেছে। বঙ্গবন্ধুর সময় থেকেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের উৎস একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভারতকে কোনো ছাড় দেননি। মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসে প্রথমেই ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে নিতে বলেছেন। যা তখন ভারতকে বিস্মিত করেছে। সিনিয়রদের কাছে শুনেছি, ভারতের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হলে বঙ্গবন্ধু কৌশলে মাওলানা ভাসানী বা বিরোধী দলকে দিয়ে রাজপথে মিছিল-সমাবেশ করাতেন। তারপর ভারতকে বলতেন, এটা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। কারণ বিরোধী দল ক্ষেপে গেছে। এখন বাংলাদেশে সরকারি দলের সাথে বিরোধী দলের সেই সদ্ভাব নেই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির এই সফরের পর কাগজে-কলমে বাংলাদেশ থেকে ভারতবিরোধী রাজনীতির ইতি ঘটেছে। এখন যদি ভারত অন্যায় কিছু করে কে প্রতিবাদ করবে, আওয়ামী লীগ না বিএনপি? দুই দলই তো ভারতের কাছে নিজেদের তুলে ধরতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বাংলাদেশের রাজনীতির এই ভারসাম্যহীনতা আমাকে শঙ্কিত করছে। ভারত যদি এই দুর্বলতাটা টের পেয়ে যায় তাহলেই বিপদ।
তবে একসময়ের দাঙাবাজ, এখন বদলে যাওয়া মোদি যা বলেছেন, তা যদি তার মনের কথা হয়, তাহলে আমার শঙ্কাটা ভুল হতে পারে। ভারতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে আমি মোটেই অন্ধ নই। আমার কোনো ভারতপ্রীতিও নেই, অন্ধের মত বিরোধীও নই। আপনি বন্ধু বদলাতে পারবেন, কিন্তু প্রতিবেশী বদলাতে পারবেন না। তাই ভারতের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এত বড় প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব রেখে চলাই ভালো। তবে তা যেন নিজেদের সম্মান, স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে না হয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, ভারতও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। ব্যাপারটা যদি ভারত মাথায় রাখে, তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি বন্ধু হলে আমি বন্ধু, তুমি শত্রু হলে আমি খুব খারাপ। কথা হবে চোখে চোখ রেখে। যদি চোখ রাঙাতে আসো, আমি চেষ্টা করবো চোখ তুলে ফেলতে। হিসাব বরাবর, তুমি এলডার ব্রাদার হলে, আমি সম্মান জানাবো; তুমি বিগ ব্রাদার হলে আমি পুছবোও না।
আশার কথা হলো, মোদি তার শেষ কর্মসূচিতে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা বন্ধুসুলভ, এলডার ব্রাদারসুলভ। তিনি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের শুধু পাশে পাশে নয়, সাথে সাথে চলবে। চীন সফরের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সাফল্য তাকে আনন্দিত করে। প্রতিবেশীর দেয়াল কাচা থাকলে আপনিও কিন্তু ঝূঁকিতে থাকেন। এই সহজ জিনিসটা যদি আপনি বুঝেন, তাহলে সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ হয়। মোদি বুঝেছেন কিনা জানি না, কিন্তু মুখে বলেছেন, বাংলাদেশে সূর্য উঠলে, সেই আলো তো ভারতও পাবে। তিনি বলেছেন, জমি নিয়ে সবসময় যুদ্ধ হয়। আর বাংলাদেশ-ভারত জমি সমস্যা মিটিয়ে সেতুবন্ধন গড়েছে।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বছরের পর বছর বাংলাদেশে চিহ্নিত ছিল গোলামি চুক্তি হিসেবে। আর আজ সেই চুক্তির বাস্তবায়নে উৎফুল্ল সবাই। এখানেই দৃষ্টিভঙ্গিরও পার্থক্য। চাইলে আপনি একটা সমস্যা বছরের পর বছর জিইয়ে রাখতে পারবেন। তাতে দুইপক্ষেরই লস। আর যদি আলোচনায় বসে দুই পক্ষই ছাড় দিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে সমস্যা মিটে যায়, দুইপক্ষেরই লাভ। অনেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একপাক্ষিক মনে করেন। ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। ভারতের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখাটা যেমন আমাদের স্বার্থ। তেমনি আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখাটাও ভারতের স্বার্থেই। আলোচনার সময় মাথায় রাখতে হবে, আমাদের স্বার্থটা। ভারতও নিশ্চয়ই স্বার্থহীনভাবে আমাদের কিছু দেবে না। তাদের স্বার্থটা ষোল আনা বুঝেই দেবে। আমরাও যেন আমাদের ষোল আনা বুঝে নেই। এটা নিশ্চিত করতে হবে।
ভারতের সাথে আমাদের অনেক সমস্যা মিটেছে। গঙ্গার পানি চুক্তি হয়েছে, সীমান্ত সমস্যা মিটেছে। কানেক্টিভিটি বেড়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর আশ্বাস দিয়েছেন মোদি। এখন ঝুলে আছে তিস্তার পানি। এটা ঠিক এবারের সফরে নিয়ে কোনো চুক্তি হওয়ার কথা ছিল না। বরং এর আগেরবার মনমোহন সিংএর সফরের সময় চুক্তিটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতার আপত্তির কারণে হয়নি। আর এবারের এজেন্ডাতেই ছিল না বিষয়টি। তবে মোদি আশ্বাস দিয়েছেন, তার ওপর বিশ্বাস রাখতে। স্থল সীমান্ত চুক্তির মত তিস্তা চুক্তিটিও তিনি করতে চান সবাইকে সাথে নিয়ে। আমরা আস্থা রাখছি। কিন্তু সেটা কতদিন? বছরের পর বছর পানিশূন্যতায় আমাদের নদী মরে যাবে, আমাদের ভূমি মরুভূতি হয়ে যাবে। আর আমরা কথার ফুলঝুরিতে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকবো, তা হবে না। মি. নরেন্দ্র মোদি আপনি যত ভালোই বলুন, খালি কথায় চিড়ে ভিজবে না, পানি লাগবেই। সেটা কবে দেবেন বলুন। মমতা ব্যানার্জির সাথে ঢাকায় বৈঠক করেছেন। নয়াদিল্লীতে আবার বসুন। কিন্তু আমাদের পানি চাই, যতদ্রুত সম্ভব।
পুনশ্চ: আরেকটা ছোট সমস্যা, কিন্তু ঝুলে আছে অনেক বড় হয়ে- ভিসা। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকার ভিসা পাওয়া অনেক সহজ, ভারতের নয়। কিন্তু পর্যটন, চিকিৎসা, পড়াশোনা, ব্যবসাসহ নানা কারণে বাংলাদেশের অনেককে নিয়মিত ভারতে যাওয়া আসা করতে হয়। কিন্তু একবার ভিসা নিতে গেলে কট্টর ভারতপ্রেমিকও ভারতবিদ্বেষী বনে যাবেন। অনেক আগে একবার ভিসা নিলেও আমি কখনো ভারতে যাইনি, তাই আমার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু অন্যদের কাছে ভোগান্তির যে গল্প শুনি তাতে জীবনে একবার কাশ্মির যাওয়ার আকাঙ্খাটা মনের মধ্যেও লুকিয়ে রাখি। কানাঘুষা ছিল মোদি তার শেষ বক্তৃতায় ভিসা সংক্রান্ত কোনো একটা চমক দেবেন। কিন্তু তা দেননি। বন্ধু হতে চাইলে আপনাকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সফরের শেষ কর্মসূচিতে মোদি বলেছেন, এটা সফরে আমার শেষ কর্মসূচি। কিন্তু আসল সফর শুরু হচ্ছে এখন। আমরাও বিশ্বাস করতে চাই, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন যাত্রা শুরু হলো। শুধু কথায় নয়, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে আন্তরিকতার।
৮ জুন, ২০১৫
এইচআর/এমএস