ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় আমরা কতটা প্রস্তুত?

ডা. পলাশ বসু | প্রকাশিত: ০৪:১৩ এএম, ৩০ আগস্ট ২০১৭

জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে বর্তমানে আমরা সহজেই অনেক প্রতিকূল অবস্থাকে জয় করতে সক্ষম হয়েছি। খাবার দাবার, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, তথ্য প্রযুক্তি, যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী দারুণ উন্নতি সাধিত হয়েছে। তবে, অগ্রযাত্রার এ গল্প সরলরৈখিক নয়। এর এক হাতে আছে উন্নয়নের গল্প অন্য হাতে আছে জীবন বিধ্বংসী নানা উপাদানের দানবীয় বিচরণ।

বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলেই সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। মাতৃ মৃত্যুর হার কমেছে। শিশু মৃত্যুও কমেছে। ফলে আমরা সহজেই মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জন করতে পেরেছি: যার শেষ সময় ছিলো ২০১৫ সাল, তার আগেই। এখন আমরা কাজ করছি সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জনে; যা ২০১৬ সালে শুরু হয়েছে এবং শেষ হবে ২০৩০ সালে। এসডিজিতে ১৭টি লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে কর্মতৎপরতা শুরু হয়েছে। সেখানে সকলের জন্য সুস্বাস্থ্যকে একটা অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

তবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো হলেও রোগ-শোক ও মৃত্যুর নানা ক্ষেত্রও কিন্তু সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে চলেছে। তবে এটা ঠিক যে, আমরা সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে অনেকাংশেই সফল হয়েছি। কিন্তু এ সময়ে অসংক্রামক রোগের বিস্তার বেড়েছে বহুগুণ। তাই, অসংক্রামক রোগের নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বারোপ না করলে সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জনের যে অন্যতম লক্ষ্যমাত্রা “সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য” অর্জন করা- তা কঠিনই হবে।
চাঁদপুরের মতলব উপজেলায় চালানো এক গবেষণায় অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৬ থেকে ২০০৬ সাল, মাত্র ২০ বছরের মধ্যে সংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার ৫২ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশে নেমে আসলেও অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৮ শতাংশ হয়েছে। বর্তমানে অসংক্রামক রোগগুলোই সবচেয়ে বড় ঘাতক। দেশে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার ৫৯ শতাংশই এখন মারা যাচ্ছে নানা রকম অসংক্রামক রোগে। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার ইত্যাদি হচ্ছে অসংক্রামক রোগের কয়েকটা উদাহরণ। খালি চোখে তাকালেই আমাদের দেশে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব চোখে পড়বে।

অন্যদিকে, ‘বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ রিপোর্ট-২০১৬’ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ৮ লাখ ৮৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এ মৃত্যুর ৫৯ শতাংশই ( ৫ লাখ ২২ হাজার ) ঘটে অসংক্রামক ব্যাধিতে। এর মধ্যে হৃদরোগে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ১৭ শতাংশ। এছাড়া দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টজনিত কারণে ১১ শতাংশ, ক্যান্সারে ১০, ডায়াবেটিসে ০৩ ও অন্যান্য অসংক্রামক রোগে ১৮ শতাংশ মানুষ মারা যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, আমাদের দেশে ২০৫০ সালের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ফলে এ সময়ের মধ্যে দেশে অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এবং তা থেকে নিরাময়ের জন্য ব্যয়ের পরিমাণ- দুটোই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।

অন্যদিকে, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের সহযোগিতায় “কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার” বাংলাদেশের জন্য ভিশন ২০২১ অর্জনে গবেষণা ও পরামর্শ–বিষয়ক প্রকল্প “বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ” গঠন করেছে। তারা সেখানে বলছে,বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় যে সকল কৌশল তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন তার ভেতরে সবচেয়ে সাশ্রয়ী সমাধান হলো উচ্চরক্তচাপ (হাইপারটেনশন) ও তামাক সেবন হ্রাস করা।

তারা বলছে, আমাদের দেশে ৩৫ বছরের বেশি বয়স্ক প্রতি তিনজন নারীর একজন এবং প্রতি পাঁচজন পুরুষের মধ্যে একজনের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। আর, প্রতিবছর ৭০ হাজার মানুষ তামাক–সংশ্লিষ্ট রোগের কারণে মৃত্যুবরণ করে। তারা বলছেন জরায়ুমুখের ক্যান্সার বাংলাদেশের নারীদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ রোগগুলোর একটি। এ রোগে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার নারীর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুই বড় কথা নয়; বড় বিষয় হচ্ছে মৃত্যুর আগ অবধি যে আর্থিক এবং মানসিক চাপ পরিবারটাকে সামাল দিতে হয় তা দারুণ উদ্বেগজনক।

এই যখন অসংক্রামক রোগের সার্বিক আগ্রাসী অবস্থা তখন তা মোকাবেলায় আমরা কতটা প্রস্তুত? উত্তর হচ্ছে, আমরা এখনও নিজেদেরকে সে অর্থে প্রস্তুত করতে পারিনি। সরলভাবে বললে বলা যায় অপ্রস্তুত অবস্থায়ই আছি। কারণ এ অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রথমেই দরকার সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কিন্তু সেটা পরিকল্পিত এবং সমন্বিতভাবে এখন অবধি শুরু হয়নি। নানাভাবে সেটা ছড়িযে ছিটিয়ে হচ্ছে হয়ত। কিন্তু তার সামাজিক ফলাফল তাই সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না।

প্রথমেই, খাবার খাওয়ার ব্যাপারে জনগণের ভেতরে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেই সাথে ফাস্ট ফুডসহ প্রসেসড ফুড, চিপস, কোমল পানীয়, চিনি এবং মিষ্টিসহ অন্যান্য মুখোরোচক খাবার তৈরি, বাজারজাত এবং বিক্রির ব্যাপারেও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে হবে। যত্রতত্র এখন ফাস্টফুডের দোকান গড়ে উঠছে। এ ধরনের খাবারের দোকান যত কম হবে ততই মঙ্গল।

দ্বিতীয়ত, দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। বলতে খারাপ লাগলেও বলতেই হচ্ছে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই এখন অনেকক্ষেত্রে আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে শহরে বিশেষ করে ঢাকাতে যেভাবে বায়ুদূষণ হচ্ছে তা সুস্বাস্থ্যের প্রধানতম অন্তরায়।

ঢাকার বাতাস এখন ধূলিময় এক বিষবাস্প যেন। কিন্তু উপায়হীন আমরা সেটাই নীরবে প্রতিনিয়ত শ্বাসের সাথে নিয়ে চলেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে যত মানুষ হৃদরোগ, স্ট্রোক বা দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসকষ্টে ভুগছে তার প্রধানতম কারণ হচ্ছে এ বায়ুদূষণ। আর আমরা সে নরককুন্ডে বসবাস করে চলেছি অসহায়ের মতো। এমন দূষণ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে তাই রাষ্ট্রকেই সবার আগে উদ্যোগী হতে হবে। কিন্তু কেন যেন সেটাই দেখতে পাচ্ছি না!

তৃতীয়ত, অপরিকল্পিত নগর উন্নয়নের কারণে এখন শহুরে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করার মোটেই সুযোগ পাচ্ছে না।তার উপর আছে ক্লাস, পরীক্ষার নানমুখি চাপ। জিপিএ ৫ পাওয়ার মাতাল হুজুগ। এভাবে ছেলেমেয়েগুলো একটা অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। পরীক্ষা নামক বিষফোঁড়ার হাত থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের রক্ষা করে তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আনন্দের সাথে পড়াশুনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। স্বাস্থ্যকর জীবনের পাঠ এ সময়ই তাদেরকে দিতে হবে। তা না করে আমরা পড়াশোনার চাপে তাদেরকে জর্জরিত করে ফেলছি। কেউ কি বলতে পারবেন, ছোট অবস্থাতেই পড়াশোনার এত এত চাপ বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা ?

প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া, জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম এবং অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। অসংক্রামক রোগের বিস্তার যদি ঠেকানো না যায় তাহলে স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। শারীরিক অসুস্থতাসহ কর্মক্ষম অল্প বয়সের মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে; যা আমাদের জন্য বিরাট অশনি সংকেত।

এ সংকেতকে তাই এখনই আমলে নিয়ে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ কর্ম পরিকল্পনা তৈরিসহ তার বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করতে হবে। কারণ এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে যত দেরি হবে সমস্যা ততই বাড়তে থাকবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/আইআই

আরও পড়ুন