ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দশ হাজার কোটি নিউরন

প্রকাশিত: ০৪:৪৭ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সপ্তাহ দু’য়েক আগে একজন আমাকে লিখে জানিয়েছে চারপাশের সবকিছু দেখে তার খুব মন খারাপ—আমি কী এমন কিছু লিখতে পারি যেটা পড়ে তার মন ভালো হয়ে যাবে? চিঠিটি পড়ে আমি একটু দুর্ভাবনায় পড়ে গেলাম, কারণ ঠিক তখন এই দেশের লেখাপড়া নিয়ে আমি খুব দুঃখের একটা ‘গল্প’ লিখেছি। সেটা লিখেছি রেগে-মেগে, লেখা শেষ করে পড়ে আমার নিজেরই মন খারাপ হয়ে গেছে। আমার নিজের জন্যেই এমন কিছু একটা লেখা দরকার যেটা আমাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করবে।

সেটা করার জন্যে আমি সবসময়ই এই দেশের ছেলে-মেয়েদের কাছে ফিরে যাই। আমাদের দেশের লেখকেরা ছেলে-মেয়েদের জন্যে লিখতে চান না, আমি লিখি। আমার খুব সৌভাগ্য এই দেশের ছেলে-মেয়েরা আমার ছোটখাটো লেখালেখি অনেক বড়-সড় ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করেছে। আমার জন্যে এই ভালোবাসা প্রকাশ করতে তারা কার্পণ্য করে না। যখন বিজ্ঞান কংগ্রেস, গণিত বা পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে যাই, আমাকে যখন স্টেজে তুলে দেয়া হয়, সেই স্টেজে বসে আমি যখন সামনে বসে থাকা শিশু-কিশোরদের বড় বড় উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি মুহূর্তে আমার মনের ভেতরকার সব দুর্ভাবনা দূর হয়ে যায়। আমাদের কী সৌভাগ্য, আমাদের দেশে এতো চমৎকার একটা নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে!

আমাদের দেশে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি কিংবা কে জানে হয়তো আরো বেশি হতে পারে! পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে ছেলে-বুড়ো সব মিলিয়েও তিন কোটি দূরে থাকুক এক কোটি মানুষও নেই। আমাদের এই তিন কোটি ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ছে, তারা যদি শুধু ঠিক করে লেখাপড়া করে তাহলে এই দেশে কী সাংঘাতিক একটা ব্যাপার ঘটে যাবে কেউ কল্পনা করতে পারবে?

এই সহস্রাব্দের শুরুতে পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা সম্পদের একটা নূতন সংজ্ঞা তৈরি করেছেন, তারা বলেছেন জ্ঞান হলো সম্পদ। তার অর্থ একটা বাচ্চা যখন ঘরের মাঝে হ্যারিকেনের আলো জ্বালিয়ে একটা অংক করে তখন আমার দেশের সম্পদ একটুখানি বেড়ে যায়। যখন একটি কিশোর বসে বসে এক পাতা ইংরেজি অনুবাদ করে আমার দেশের সম্পদ বেড়ে যায়। এখন একজন কিশোরী রাতের আঁধারে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদটা কেমন করে বড় হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে তখন আমার দেশের সম্পদ বেড়ে যায়। মাটির নিচে খনিজ সম্পদ তৈরি হতে কোটি কোটি বছর লাগে, কল-কারখানায় শিল্প সম্পদ তৈরি করতে যুগ যুগ লেগে যায়। কিন্তু লেখাপড়া করে জ্ঞানের সম্পদ তৈরি হয় মুহূর্তে মুহূর্তে। আমাদের দেশের লেখাপড়া নিয়ে আমার অভিযোগের শেষ নেই সেটা এখন সবাই জানে— কিন্তু আজকে আমি অভিযোগ করব না। আজকে আমি শুধু সবাইকে মনে করিয়ে দেব এই দেশের তিন কোটি বাচ্চা প্রতিবছর নূতন বই হাতে নিয়ে লেখাপড়া করতে শুরু করে। শুধু এই বিষয়টা চিন্তা করেই আমাদের সবার মনের সব দুশ্চিন্তা, সব দুর্ভাবনা দূর হয়ে যাবার কথা!

লেখাপড়া বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে কোনো একটি শিশু বই সামনে নিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুর করে পড়ছে। শুধু তাই না, ‘পড়া মুখস্থ’ করা বলে একটা কথা মোটামুটি সবাই গ্রহণ করেই নিয়েছে। কিন্তু মুখস্থ করাই যে লেখাপড়া না, বোঝা, ব্যবহার করা কিংবা নিজের মত বিশ্লেষণ করাও যে লেখাপড়া করার একটা অংশ সেটা মাত্র অল্প কয়দিন হল আমরা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। যে জিনিসটা এখনো আমরা কাউকে বোঝাতে শুরু করিনি কিংবা বোঝাতে পারিনি, সেটা হচ্ছে- শুধু জিপিএ-ফাইভ পাওয়া মোটেই লেখাপড়া না!

আমাদের অনেক ধরনের বুদ্ধিমত্তা আছে। আমরা শুধু এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মাথা ঘামাই— সেটা হচ্ছে ক্লাসরুমে লেখাপড়া করে পরীক্ষার হলে সেটা উগলে দেয়ার বুদ্ধিমত্তা! কিন্তু আমরা সবাই জানি লেখাপড়ার বাইরে যে বুদ্ধিমত্তাগুলো আছে সেগুলো কিন্তু লেখাপড়ার মতই, এমনকী অনেক সময় লেখাপড়া থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যারা শিক্ষকতা করি তারা সবাই দেখেছি, আমাদের ক্লাসে যে ছেলেটি বা মেয়েটি সবচেয়ে তুখোড়, সবচেয়ে বুদ্ধিমান সে কিন্তু অনেক সময়ই পরীক্ষায় সেরকম ভালো করতে পারে না। দোষটি মোটেও তার নয়— দোষ আমাদের, আমরা ঠিক করে পরীক্ষা নিতে পারি না। সারা পৃথিবীতেই মনে হয় এই সমস্যাটা আছে। একজনের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করার পদ্ধতি মনে হয় এখনো ঠিক করে আবিষ্কার করা যায়নি। যখন আমাদের ছাত্রছাত্রীরা বাইরের বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করতে চায়, তখন আমাদের তাদের সম্পর্কে লিখতে হয়। আমি দেখেছি সেই ফর্মগুলোতে প্রায় সবসময়ই আমাদের একটা প্রশ্ন করা হয়: “এই ছেলেটির পরীক্ষার ফলাফল কী তার সঠিক মেধা যাচাই করতে পেরেছে?” আমাকে প্রায় সময়েই লিখতে হয়, “না, পারেনি! পরীক্ষার ফলাফল দেখলে মনে হবে সে বুঝি খুবই সাধারণ— কিন্তু বিশ্বাস কর, এই ছেলেটি বা মেয়েটি আসলে কিন্তু অসাধারণ!”

বুদ্ধিমত্তা অনেক পরের ব্যাপার, আমরা কিন্তু জিপিএ-ফাইভ নামের একটা কানাগলি থেকেই বের হতে পারিনি! আমরা ধরেই নিয়েছি, যেকোনো মূল্যে আমাদের ছেলেমেয়েদের জিপিএ-ফাইভ পেতে হবে— দরকার হলে প্রশ্ন ফাঁস করে হলেও। কিন্তু যে ছেলেটি বা মেয়েটি প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার পরও সেই প্রশ্ন না দেখে পরীক্ষা দিয়ে ভালো করেছে সে কী অন্য সবার থেকে আলাদা নয়? তার বুদ্ধিমত্তাটা কী আমরা আলাদাভাবে ধরতে পেরেছি? পারিনি! কিংবা যে ছেলেটি বা মেয়েটি ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখার সুযোগ পেয়েও দেখেনি— সেজন্যে পরীক্ষা এত ভালো হয়নি— তার ভেতরে যে এক ধরনের অন্যরকম শক্তি রয়েছে আমরা কী কখনো সেটা যাচাই করে দেখেছি? সেটাও দেখিনি।

প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র একটা পরিবারের একটা মেয়ে যখন সারাদিন তার ছোট ভাইকে কোলে করে মানুষ করে, তার ফাঁকে ফাঁকে লেখাপড়া করে পরীক্ষায় টেনেটুনে পাস করেছে। আমরা কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব মেয়েটির বুদ্ধিমত্তা কম? শহরের সচ্ছল পরিবারের একটি মেয়ে যে গাড়ি করে স্কুলে যায়, ফেসবুক ইন্টারনেট করে সময় কাটায়, সুন্দর করে ইংরেজি বলে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে— আমরা কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব তার বুদ্ধিমত্তা গ্রামের মেয়েটি থেকে বেশি?

আসলে সেটি পারব না। কাজেই আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে শুধু পরীক্ষায় রেজাল্ট কিংবা জিপিএ-ফাইভ দেখে একজন ছেলে বা মেয়ের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করাটা নেহায়েতই বোকামি। আমাদের চোখ-কান খোলা রেখে দেখতে হবে একটা শিশুর মাঝে আর কোন্ কোন্ দিকে তার বিচিত্র বুদ্ধিমত্তা আছে। আমাদের নিজেদের ভেতর যদি বিন্দুমাত্র বুদ্ধিমত্তা থাকে তাহলে আমরা কখনোই শুধু পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে একটা ছেলে বা মেয়েকে যাচাই করে ফেলার চেষ্টা করব না। আমার সেইসব ছেলেমেয়ের জন্যে খুব মায়া হয় যাদের বাবা-মায়েরা শুধু পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়ানোর প্রতিযোগিতায় নিজেদের সন্তানদের ঠেলে দিয়ে তাদের শৈশবের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছেন! তাদের থেকে বড় দুর্ভাগা মনে হয় আর কেউ নেই!

২.
মাও সে তুংয়ের একটা খুব বিখ্যাত উক্তি আছে। উক্তিটি হচ্ছে এরকম: প্রত্যেকটা মানুষ একটা সুখ নিয়ে জন্মায় কিন্তু সেই সুখে অন্ন জোগানোর জন্যে তার রয়েছে দু’ দু’টি হাত! যার অর্থ এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই অসহায় নয়, খেটে খাওয়ার জন্যে সবারই দুটি হাত রয়েছে, কাস্তে কিংবা কুঠার ধরে সেই হাত তার মুখে অন্ন জোগাবে। আমি মাও সে তুং নই, তাই আমার উক্তিকে কেউ গুরুত্ব দেবে না। কিন্তু আমাকে সুযোগ দিলে আমি মাও সে তুংয়ের উক্তিটাকে অন্যরকম করে বলতাম। আমার উক্তিটি হতো এরকম: প্রত্যেকটা মানুষ একটি সুখ আর মাত্র দুটি হাত নিয়ে জন্মায়। কিন্তু ভয় পাবার কিছু নেই কারণ সব মানুষের মাথার মাঝে রয়েছে দশ হাজার কোটি নিউরন!

যতই দিন যাচ্ছে আমি আমাদের মস্তিষ্কের দশ হাজার কোটি নিউরনকে তত বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে শুরু করেছি। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি তোমার শিক্ষকতা জীবনের কোন্ অভিজ্ঞতাটুকুকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে কর? আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলব যে, সেটি হচ্ছে একজন মানুষের মাথার ভেতরকার সোয়া কেজি ওজনের মস্তিষ্ক নামের রহস্যময় জিনিসটির অসাধারণ ক্ষমতা!

প্রায় সময়েই আমি অনেক ছেলে-মেয়েকে হতাশ হয়ে বলতে শুনি, ‘আমি আসলে গাধা, আমার মেধা বলতে কিছু নেই।’ তাদের অনেকের কথার সত্যতা আছে। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে এবং পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে পেতে তাদের অনেকেই আসলে খানিকটা ‘গাধা’ হয়ে গেছে কিন্তু সত্য কথাটি হচ্ছে কাউকেই কিন্তু সেটা মেনে নিতে হবে না। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি যে কেউ যদি সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে চেষ্টা করে তাহলে কতো দ্রুত সে নতুন মানুষ হয়ে যেতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার নামে একটা ভয়ংকর অমানবিক প্রক্রিয়া ঘটানো হয়। সেই প্রক্রিয়া দিয়ে আমরা ‘মেধাবী’ সীল দিয়ে কিছু ছেলে-মেয়েকে ভর্তি করি। তার মাঝেও আবার জনপ্রিয় আর অজনপ্রিয় বিভাগ আছে। যারা জনপ্রিয় বিভাগে ঢুকতে পারে সবাই তাদের দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায়, যারা ঢুকতে পারে না তারা গভীর দুঃখে লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা-মায়ের গালাগাল শুনে।

অথচ মজার বিষয় হল, আমি খুব পরিষ্কার এবং স্পষ্টভাবে জানি এই পুরো বিভাজনটি আসলে অর্থহীন। বিজ্ঞানের জন্যে গভীর ভালোবাসা কিন্তু বাবা-মা জোর করে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বানানোর জন্যে তাদের সন্তানদের একটা কষ্টের জীবনে ঠেলে দেন। আবার উল্টোটাও সত্যি যে, ছেলেটি অসাধারণ একজন ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার হতে পারত, ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে না পেরে সে হয়তো জোর করে অপছন্দের একটা বিভাগে ভর্তি হয়ে অপছন্দের কিছু বিষয় পড়ে সময়টা অকারণে নষ্ট করছে।

এই মুহূর্তে কম্পিউটার সায়েন্স খুব জনপ্রিয় একটা বিষয়। চাকরি পাবার জন্যে এটা সবসময়েই একটা জনপ্রিয় বিষয় হিসেবে থাকবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগ থেকে পাস করে ছেলে-মেয়েরা অনেকেই নিজেদের সফটওয়্যার ফার্ম খুলেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই সফটওয়্যার ফার্মে কিন্তু শুধু কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছেলে-মেয়েরা নেই অন্য অনেক বিভাগের ছেলে-মেয়েও সমানভাবে আছে। তারা কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের পাস করা ছেলে-মেয়ে থেকে কোনো অংশে কম নয়— তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছে। যার অর্থ পছন্দের বিভাগে ভর্তি হতে না পারলেই একজনের জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে মনে করার কোনো কারণ নেই।

ছেলে-মেয়েদের আগ্রহ এবং দেশ কিংবা পৃথিবীর প্রয়োজনীয় কথা মনে রেখে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা অন্যান্য বিভাগের ছেলে-মেয়েদের জন্যে দ্বিতীয় মেজর (second Major) হিসেবে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার সুযোগ করে দিয়েছি (সত্যি কথা বলতে কী সব বিভাগেই দ্বিতীয় মেজর নেয়ার সুযোগ আছে)। আমার ধারণা, সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে পড়ালেখা কেমন করে হয় এটি তার একটা চমৎকার উদাহরণ! ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের সব পড়ার পাশাপাশি শুধু আগ্রহের জন্যে বাড়তি পড়াশোনা করছে বিষয়টি দেখলেই এক ধরনের আনন্দ হয়।

একটা সময় ছিল যখন আমি মেধাবী শব্দটাকে ব্যবহার করতাম। আমার চারপাশে অনেক “মেধাবী” ছেলেমেয়েকে দেখে ভাবতাম, সত্যিই কিছু মানুষ “মেধাবী” হয়ে জন্মায় অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা সত্যিই বুঝি কিছু মানুষকে বেশি মেধা দিয়ে পাঠান। সেই ছাত্রজীবনেই আবিষ্কার করেছিলাম যে, আসলে বাড়তি মেধা বলে কিছু নেই, চারপাশের অনেক মেধাবী মানুষই জীবনযুদ্ধে ঝরে পড়েছে। আবার যাদেরকে নেহায়েতই সাধারণ একজন বলে ভেবেছিলাম অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি তারা উৎসাহ আগ্রহ আর পরিশ্রম করে “মেধাবী”দের পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে! সেগুলো দেখে দেখে আজকাল আমার নিজের ডিকশনারী থেকে “মেধাবী” শব্দটাকে তুলে দিয়ে সেখানে “উৎসাহী” শব্দটা ঢুকিয়েছি। আমি দেখেছি উৎসাহ থাকলে সবই সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কী, আমি আমার পরিচিত জগতের সব মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছি। এক ভাগ হচ্ছে যারা উৎসাহী; অন্য ভাগ হচ্ছে যাদের কিছুতেই উৎসাহ নেই, যাদেরকে ঠেলাঠেলি করে নিয়ে যেতে হয়! উৎসাহীরা পৃথিবীটাকে চালায়, বাকিরা তার সমালোচনা করে।

আমার চারপাশে অসংখ্য উদাহরণ আছে যেখানে একজন ছেলে বা মেয়ে শুধু নিজের উৎসাহটুকু দিয়ে এগিয়ে গেছে। এরকম মানুষের সাথে কাজ করাতেও আনন্দ। উৎসাহ বিষয়টা ছোঁয়াচেও বটে। একজনের থেকে আরেকজনের মাঝে সেটা সঞ্চারিত হয়ে যায়। আমি পৃথিবীর অনেক বড় বড় স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি দেখেছি। তাদের সুযোগ-সুবিধে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি আমরা। আমাদের ছেলে-মেয়েদের কিছুই দিতে পারি না, মাঝে মাঝে শুধু একটুখানি উৎসাহ দিই। সেই উৎসাহকে ভরসা করেই তারা কত কী করে ফেলে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই! তাই আজকাল সুযোগ পেলেই আমি ছেলে-মেয়েদেরকে বলি, তোমরা যেটুকু প্রতিভা বা মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছো সেটুকুতে সন্তুষ্ট থাকার কোনো কারণ নেই। তুমি ইচ্ছে করলেই সেটাকে শতগুণে বাড়িয়ে ফেলতে পারবে। কাজেই আমি মনে করি পৃথিবীতে আসলে প্রতিভাবান বা মেধাবী বলে আলাদা কিছু নেই, যাদের ভেতরে উৎসাহ বেশি আর যারা পরিশ্রম করতে রাজি আছে তারাই হচ্ছে প্রতিভাবান, তারাই হচ্ছে মেধাবী।

সেজন্যে আমি মাও সে তুংয়ের উক্তিটিতে ‘হাত’ থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেই মস্তিষ্কের দশ হাজার কোটি নিউরনকে। দুটি হাত দিয়ে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ নেই কিন্তু মস্তিষ্কের দশ হাজার কোটি নিউরন দিয়ে অচিন্তনীয় ম্যাজিক করে ফেলা সম্ভব। দুটি হাত দিয়ে খুব বেশি হলে এক দু’জন মানুষের মুখে অন্ন জোগানো সম্ভব। দশ হাজার কোটি নিউরন দিয়ে লক্ষ মানুষের মুখেও অন্ন জোগানো যেতে পারে!

৩.
আমি জানি, আমাদের সমস্যার শেষ নেই। আমি জানি, সব সমস্যার সমাধান চট করে হয়ে যাবে না। আমাদের দীর্ঘদিন এই সমস্যাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু সেটি নিয়ে হতাশ হবার কিছু নেই, কারণ বাংলাদেশ এখন ধীরে ধীরে নিজের পায়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের দেশের খেটে-খাওয়া মানুষ তাদের শক্ত দুটি হাত দিয়ে এই দেশকে ধরে রেখেছে। এই দেশের নতুন প্রজন্মকে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে দশ হাজার কোটি নিউরনকে নিয়ে!

জিপিএ-ফাইভের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, প্রশ্ন ফাঁস, কোচিং গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য কোনো কিছুই এই দশ হাজার কোটি নিউরনকে পরাজিত করতে পারবে না।

লেখক :কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
- See more at: http://www.priyo.com/blog/2014/09/12/105486.html#sthash.abl6Hfdt.dpuf

সপ্তাহ দু’য়েক আগে একজন আমাকে লিখে জানিয়েছে চারপাশের সবকিছু দেখে তার খুব মন খারাপ—আমি কী এমন কিছু লিখতে পারি যেটা পড়ে তার মন ভালো হয়ে যাবে? চিঠিটি পড়ে আমি একটু দুর্ভাবনায় পড়ে গেলাম, কারণ ঠিক তখন এই দেশের লেখাপড়া নিয়ে আমি খুব দুঃখের একটা ‘গল্প’ লিখেছি। সেটা লিখেছি রেগে-মেগে, লেখা শেষ করে পড়ে আমার নিজেরই মন খারাপ হয়ে গেছে। আমার নিজের জন্যেই এমন কিছু একটা লেখা দরকার যেটা আমাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করবে।

সেটা করার জন্যে আমি সবসময়ই এই দেশের ছেলে-মেয়েদের কাছে ফিরে যাই। আমাদের দেশের লেখকেরা ছেলে-মেয়েদের জন্যে লিখতে চান না, আমি লিখি। আমার খুব সৌভাগ্য এই দেশের ছেলে-মেয়েরা আমার ছোটখাটো লেখালেখি অনেক বড়-সড় ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করেছে। আমার জন্যে এই ভালোবাসা প্রকাশ করতে তারা কার্পণ্য করে না। যখন বিজ্ঞান কংগ্রেস, গণিত বা পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে যাই, আমাকে যখন স্টেজে তুলে দেয়া হয়, সেই স্টেজে বসে আমি যখন সামনে বসে থাকা শিশু-কিশোরদের বড় বড় উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি মুহূর্তে আমার মনের ভেতরকার সব দুর্ভাবনা দূর হয়ে যায়। আমাদের কী সৌভাগ্য, আমাদের দেশে এতো চমৎকার একটা নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে!

আমাদের দেশে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি কিংবা কে জানে হয়তো আরো বেশি হতে পারে! পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে ছেলে-বুড়ো সব মিলিয়েও তিন কোটি দূরে থাকুক এক কোটি মানুষও নেই। আমাদের এই তিন কোটি ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ছে, তারা যদি শুধু ঠিক করে লেখাপড়া করে তাহলে এই দেশে কী সাংঘাতিক একটা ব্যাপার ঘটে যাবে কেউ কল্পনা করতে পারবে?

এই সহস্রাব্দের শুরুতে পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা সম্পদের একটা নূতন সংজ্ঞা তৈরি করেছেন, তারা বলেছেন জ্ঞান হলো সম্পদ। তার অর্থ একটা বাচ্চা যখন ঘরের মাঝে হ্যারিকেনের আলো জ্বালিয়ে একটা অংক করে তখন আমার দেশের সম্পদ একটুখানি বেড়ে যায়। যখন একটি কিশোর বসে বসে এক পাতা ইংরেজি অনুবাদ করে আমার দেশের সম্পদ বেড়ে যায়। এখন একজন কিশোরী রাতের আঁধারে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদটা কেমন করে বড় হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে তখন আমার দেশের সম্পদ বেড়ে যায়। মাটির নিচে খনিজ সম্পদ তৈরি হতে কোটি কোটি বছর লাগে, কল-কারখানায় শিল্প সম্পদ তৈরি করতে যুগ যুগ লেগে যায়। কিন্তু লেখাপড়া করে জ্ঞানের সম্পদ তৈরি হয় মুহূর্তে মুহূর্তে। আমাদের দেশের লেখাপড়া নিয়ে আমার অভিযোগের শেষ নেই সেটা এখন সবাই জানে— কিন্তু আজকে আমি অভিযোগ করব না। আজকে আমি শুধু সবাইকে মনে করিয়ে দেব এই দেশের তিন কোটি বাচ্চা প্রতিবছর নূতন বই হাতে নিয়ে লেখাপড়া করতে শুরু করে। শুধু এই বিষয়টা চিন্তা করেই আমাদের সবার মনের সব দুশ্চিন্তা, সব দুর্ভাবনা দূর হয়ে যাবার কথা!

লেখাপড়া বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে কোনো একটি শিশু বই সামনে নিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুর করে পড়ছে। শুধু তাই না, ‘পড়া মুখস্থ’ করা বলে একটা কথা মোটামুটি সবাই গ্রহণ করেই নিয়েছে। কিন্তু মুখস্থ করাই যে লেখাপড়া না, বোঝা, ব্যবহার করা কিংবা নিজের মত বিশ্লেষণ করাও যে লেখাপড়া করার একটা অংশ সেটা মাত্র অল্প কয়দিন হল আমরা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। যে জিনিসটা এখনো আমরা কাউকে বোঝাতে শুরু করিনি কিংবা বোঝাতে পারিনি, সেটা হচ্ছে- শুধু জিপিএ-ফাইভ পাওয়া মোটেই লেখাপড়া না!

আমাদের অনেক ধরনের বুদ্ধিমত্তা আছে। আমরা শুধু এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মাথা ঘামাই— সেটা হচ্ছে ক্লাসরুমে লেখাপড়া করে পরীক্ষার হলে সেটা উগলে দেয়ার বুদ্ধিমত্তা! কিন্তু আমরা সবাই জানি লেখাপড়ার বাইরে যে বুদ্ধিমত্তাগুলো আছে সেগুলো কিন্তু লেখাপড়ার মতই, এমনকী অনেক সময় লেখাপড়া থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যারা শিক্ষকতা করি তারা সবাই দেখেছি, আমাদের ক্লাসে যে ছেলেটি বা মেয়েটি সবচেয়ে তুখোড়, সবচেয়ে বুদ্ধিমান সে কিন্তু অনেক সময়ই পরীক্ষায় সেরকম ভালো করতে পারে না। দোষটি মোটেও তার নয়— দোষ আমাদের, আমরা ঠিক করে পরীক্ষা নিতে পারি না। সারা পৃথিবীতেই মনে হয় এই সমস্যাটা আছে। একজনের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করার পদ্ধতি মনে হয় এখনো ঠিক করে আবিষ্কার করা যায়নি। যখন আমাদের ছাত্রছাত্রীরা বাইরের বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করতে চায়, তখন আমাদের তাদের সম্পর্কে লিখতে হয়। আমি দেখেছি সেই ফর্মগুলোতে প্রায় সবসময়ই আমাদের একটা প্রশ্ন করা হয়: “এই ছেলেটির পরীক্ষার ফলাফল কী তার সঠিক মেধা যাচাই করতে পেরেছে?” আমাকে প্রায় সময়েই লিখতে হয়, “না, পারেনি! পরীক্ষার ফলাফল দেখলে মনে হবে সে বুঝি খুবই সাধারণ— কিন্তু বিশ্বাস কর, এই ছেলেটি বা মেয়েটি আসলে কিন্তু অসাধারণ!”

বুদ্ধিমত্তা অনেক পরের ব্যাপার, আমরা কিন্তু জিপিএ-ফাইভ নামের একটা কানাগলি থেকেই বের হতে পারিনি! আমরা ধরেই নিয়েছি, যেকোনো মূল্যে আমাদের ছেলেমেয়েদের জিপিএ-ফাইভ পেতে হবে— দরকার হলে প্রশ্ন ফাঁস করে হলেও। কিন্তু যে ছেলেটি বা মেয়েটি প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার পরও সেই প্রশ্ন না দেখে পরীক্ষা দিয়ে ভালো করেছে সে কী অন্য সবার থেকে আলাদা নয়? তার বুদ্ধিমত্তাটা কী আমরা আলাদাভাবে ধরতে পেরেছি? পারিনি! কিংবা যে ছেলেটি বা মেয়েটি ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখার সুযোগ পেয়েও দেখেনি— সেজন্যে পরীক্ষা এত ভালো হয়নি— তার ভেতরে যে এক ধরনের অন্যরকম শক্তি রয়েছে আমরা কী কখনো সেটা যাচাই করে দেখেছি? সেটাও দেখিনি।

প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র একটা পরিবারের একটা মেয়ে যখন সারাদিন তার ছোট ভাইকে কোলে করে মানুষ করে, তার ফাঁকে ফাঁকে লেখাপড়া করে পরীক্ষায় টেনেটুনে পাস করেছে। আমরা কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব মেয়েটির বুদ্ধিমত্তা কম? শহরের সচ্ছল পরিবারের একটি মেয়ে যে গাড়ি করে স্কুলে যায়, ফেসবুক ইন্টারনেট করে সময় কাটায়, সুন্দর করে ইংরেজি বলে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে— আমরা কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব তার বুদ্ধিমত্তা গ্রামের মেয়েটি থেকে বেশি?

আসলে সেটি পারব না। কাজেই আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে শুধু পরীক্ষায় রেজাল্ট কিংবা জিপিএ-ফাইভ দেখে একজন ছেলে বা মেয়ের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করাটা নেহায়েতই বোকামি। আমাদের চোখ-কান খোলা রেখে দেখতে হবে একটা শিশুর মাঝে আর কোন্ কোন্ দিকে তার বিচিত্র বুদ্ধিমত্তা আছে। আমাদের নিজেদের ভেতর যদি বিন্দুমাত্র বুদ্ধিমত্তা থাকে তাহলে আমরা কখনোই শুধু পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে একটা ছেলে বা মেয়েকে যাচাই করে ফেলার চেষ্টা করব না। আমার সেইসব ছেলেমেয়ের জন্যে খুব মায়া হয় যাদের বাবা-মায়েরা শুধু পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়ানোর প্রতিযোগিতায় নিজেদের সন্তানদের ঠেলে দিয়ে তাদের শৈশবের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছেন! তাদের থেকে বড় দুর্ভাগা মনে হয় আর কেউ নেই!

২.
মাও সে তুংয়ের একটা খুব বিখ্যাত উক্তি আছে। উক্তিটি হচ্ছে এরকম: প্রত্যেকটা মানুষ একটা সুখ নিয়ে জন্মায় কিন্তু সেই সুখে অন্ন জোগানোর জন্যে তার রয়েছে দু’ দু’টি হাত! যার অর্থ এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই অসহায় নয়, খেটে খাওয়ার জন্যে সবারই দুটি হাত রয়েছে, কাস্তে কিংবা কুঠার ধরে সেই হাত তার মুখে অন্ন জোগাবে। আমি মাও সে তুং নই, তাই আমার উক্তিকে কেউ গুরুত্ব দেবে না। কিন্তু আমাকে সুযোগ দিলে আমি মাও সে তুংয়ের উক্তিটাকে অন্যরকম করে বলতাম। আমার উক্তিটি হতো এরকম: প্রত্যেকটা মানুষ একটি সুখ আর মাত্র দুটি হাত নিয়ে জন্মায়। কিন্তু ভয় পাবার কিছু নেই কারণ সব মানুষের মাথার মাঝে রয়েছে দশ হাজার কোটি নিউরন!

যতই দিন যাচ্ছে আমি আমাদের মস্তিষ্কের দশ হাজার কোটি নিউরনকে তত বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে শুরু করেছি। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি তোমার শিক্ষকতা জীবনের কোন্ অভিজ্ঞতাটুকুকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে কর? আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলব যে, সেটি হচ্ছে একজন মানুষের মাথার ভেতরকার সোয়া কেজি ওজনের মস্তিষ্ক নামের রহস্যময় জিনিসটির অসাধারণ ক্ষমতা!

প্রায় সময়েই আমি অনেক ছেলে-মেয়েকে হতাশ হয়ে বলতে শুনি, ‘আমি আসলে গাধা, আমার মেধা বলতে কিছু নেই।’ তাদের অনেকের কথার সত্যতা আছে। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে এবং পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে পেতে তাদের অনেকেই আসলে খানিকটা ‘গাধা’ হয়ে গেছে কিন্তু সত্য কথাটি হচ্ছে কাউকেই কিন্তু সেটা মেনে নিতে হবে না। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি যে কেউ যদি সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে চেষ্টা করে তাহলে কতো দ্রুত সে নতুন মানুষ হয়ে যেতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার নামে একটা ভয়ংকর অমানবিক প্রক্রিয়া ঘটানো হয়। সেই প্রক্রিয়া দিয়ে আমরা ‘মেধাবী’ সীল দিয়ে কিছু ছেলে-মেয়েকে ভর্তি করি। তার মাঝেও আবার জনপ্রিয় আর অজনপ্রিয় বিভাগ আছে। যারা জনপ্রিয় বিভাগে ঢুকতে পারে সবাই তাদের দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায়, যারা ঢুকতে পারে না তারা গভীর দুঃখে লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা-মায়ের গালাগাল শুনে।

অথচ মজার বিষয় হল, আমি খুব পরিষ্কার এবং স্পষ্টভাবে জানি এই পুরো বিভাজনটি আসলে অর্থহীন। বিজ্ঞানের জন্যে গভীর ভালোবাসা কিন্তু বাবা-মা জোর করে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বানানোর জন্যে তাদের সন্তানদের একটা কষ্টের জীবনে ঠেলে দেন। আবার উল্টোটাও সত্যি যে, ছেলেটি অসাধারণ একজন ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার হতে পারত, ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে না পেরে সে হয়তো জোর করে অপছন্দের একটা বিভাগে ভর্তি হয়ে অপছন্দের কিছু বিষয় পড়ে সময়টা অকারণে নষ্ট করছে।

এই মুহূর্তে কম্পিউটার সায়েন্স খুব জনপ্রিয় একটা বিষয়। চাকরি পাবার জন্যে এটা সবসময়েই একটা জনপ্রিয় বিষয় হিসেবে থাকবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগ থেকে পাস করে ছেলে-মেয়েরা অনেকেই নিজেদের সফটওয়্যার ফার্ম খুলেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই সফটওয়্যার ফার্মে কিন্তু শুধু কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছেলে-মেয়েরা নেই অন্য অনেক বিভাগের ছেলে-মেয়েও সমানভাবে আছে। তারা কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের পাস করা ছেলে-মেয়ে থেকে কোনো অংশে কম নয়— তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছে। যার অর্থ পছন্দের বিভাগে ভর্তি হতে না পারলেই একজনের জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে মনে করার কোনো কারণ নেই।

ছেলে-মেয়েদের আগ্রহ এবং দেশ কিংবা পৃথিবীর প্রয়োজনীয় কথা মনে রেখে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা অন্যান্য বিভাগের ছেলে-মেয়েদের জন্যে দ্বিতীয় মেজর (second Major) হিসেবে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার সুযোগ করে দিয়েছি (সত্যি কথা বলতে কী সব বিভাগেই দ্বিতীয় মেজর নেয়ার সুযোগ আছে)। আমার ধারণা, সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে পড়ালেখা কেমন করে হয় এটি তার একটা চমৎকার উদাহরণ! ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের সব পড়ার পাশাপাশি শুধু আগ্রহের জন্যে বাড়তি পড়াশোনা করছে বিষয়টি দেখলেই এক ধরনের আনন্দ হয়।

একটা সময় ছিল যখন আমি মেধাবী শব্দটাকে ব্যবহার করতাম। আমার চারপাশে অনেক “মেধাবী” ছেলেমেয়েকে দেখে ভাবতাম, সত্যিই কিছু মানুষ “মেধাবী” হয়ে জন্মায় অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা সত্যিই বুঝি কিছু মানুষকে বেশি মেধা দিয়ে পাঠান। সেই ছাত্রজীবনেই আবিষ্কার করেছিলাম যে, আসলে বাড়তি মেধা বলে কিছু নেই, চারপাশের অনেক মেধাবী মানুষই জীবনযুদ্ধে ঝরে পড়েছে। আবার যাদেরকে নেহায়েতই সাধারণ একজন বলে ভেবেছিলাম অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি তারা উৎসাহ আগ্রহ আর পরিশ্রম করে “মেধাবী”দের পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে! সেগুলো দেখে দেখে আজকাল আমার নিজের ডিকশনারী থেকে “মেধাবী” শব্দটাকে তুলে দিয়ে সেখানে “উৎসাহী” শব্দটা ঢুকিয়েছি। আমি দেখেছি উৎসাহ থাকলে সবই সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কী, আমি আমার পরিচিত জগতের সব মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছি। এক ভাগ হচ্ছে যারা উৎসাহী; অন্য ভাগ হচ্ছে যাদের কিছুতেই উৎসাহ নেই, যাদেরকে ঠেলাঠেলি করে নিয়ে যেতে হয়! উৎসাহীরা পৃথিবীটাকে চালায়, বাকিরা তার সমালোচনা করে।

আমার চারপাশে অসংখ্য উদাহরণ আছে যেখানে একজন ছেলে বা মেয়ে শুধু নিজের উৎসাহটুকু দিয়ে এগিয়ে গেছে। এরকম মানুষের সাথে কাজ করাতেও আনন্দ। উৎসাহ বিষয়টা ছোঁয়াচেও বটে। একজনের থেকে আরেকজনের মাঝে সেটা সঞ্চারিত হয়ে যায়। আমি পৃথিবীর অনেক বড় বড় স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি দেখেছি। তাদের সুযোগ-সুবিধে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি আমরা। আমাদের ছেলে-মেয়েদের কিছুই দিতে পারি না, মাঝে মাঝে শুধু একটুখানি উৎসাহ দিই। সেই উৎসাহকে ভরসা করেই তারা কত কী করে ফেলে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই! তাই আজকাল সুযোগ পেলেই আমি ছেলে-মেয়েদেরকে বলি, তোমরা যেটুকু প্রতিভা বা মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছো সেটুকুতে সন্তুষ্ট থাকার কোনো কারণ নেই। তুমি ইচ্ছে করলেই সেটাকে শতগুণে বাড়িয়ে ফেলতে পারবে। কাজেই আমি মনে করি পৃথিবীতে আসলে প্রতিভাবান বা মেধাবী বলে আলাদা কিছু নেই, যাদের ভেতরে উৎসাহ বেশি আর যারা পরিশ্রম করতে রাজি আছে তারাই হচ্ছে প্রতিভাবান, তারাই হচ্ছে মেধাবী।

সেজন্যে আমি মাও সে তুংয়ের উক্তিটিতে ‘হাত’ থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেই মস্তিষ্কের দশ হাজার কোটি নিউরনকে। দুটি হাত দিয়ে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ নেই কিন্তু মস্তিষ্কের দশ হাজার কোটি নিউরন দিয়ে অচিন্তনীয় ম্যাজিক করে ফেলা সম্ভব। দুটি হাত দিয়ে খুব বেশি হলে এক দু’জন মানুষের মুখে অন্ন জোগানো সম্ভব। দশ হাজার কোটি নিউরন দিয়ে লক্ষ মানুষের মুখেও অন্ন জোগানো যেতে পারে!

৩.
আমি জানি, আমাদের সমস্যার শেষ নেই। আমি জানি, সব সমস্যার সমাধান চট করে হয়ে যাবে না। আমাদের দীর্ঘদিন এই সমস্যাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু সেটি নিয়ে হতাশ হবার কিছু নেই, কারণ বাংলাদেশ এখন ধীরে ধীরে নিজের পায়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের দেশের খেটে-খাওয়া মানুষ তাদের শক্ত দুটি হাত দিয়ে এই দেশকে ধরে রেখেছে। এই দেশের নতুন প্রজন্মকে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে দশ হাজার কোটি নিউরনকে নিয়ে!

জিপিএ-ফাইভের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, প্রশ্ন ফাঁস, কোচিং গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য কোনো কিছুই এই দশ হাজার কোটি নিউরনকে পরাজিত করতে পারবে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট