ত্যাগ এবং ট্যাগ
কোরবানি ঈদে গ্রামে যাওয়া হতো এক-দুদিন আগে। লঞ্চ ঘাটে ভিড়তেই লাফিয়ে পড়তাম টার্মিনালে। মেঘনা তখন প্রমত্তা। আমি বুঝি তার চেয়েও বেশি। দৌড়ে হিজল, তমাল, কাফিলা, মান্দার আর বাঁশঝাড়ের ছায়া মাড়িয়ে উঠোনে। ধানের ক্ষেত, পাটের ক্ষেত কিংবা শর্ষে আমার দুরন্তপনায় মুগ্ধ।
এতো গেল পৌষ-চৈত্রের ঈদের কথা। ভরা বর্ষায় খালের পর খাল পেরিয়ে আমি যখন বাড়ির ঘাটে, আমাকে বরণে মেঘরঙা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে দিদু। পেছনে দাদুর হাসিটা ছিল এই শরতের আকাশের মতোই। দিদু আর দাদুর সঙ্গে উঠোন পেরিয়ে সোজা গোয়াল ঘরে। সারি সারি গরু। কোনটা লাল, কোনটা সাদা, লাল-কালো, সাদা-কালো রঙের গরু দাঁড়িয়ে আছে। কেউ মলিন চোখে। আবার কেউ বিষণ্ণতায় বাইরের আকাশ দেখছে। কোনটির কোন দিকেই মন নেই, শুধু খর খেয়ে যাচ্ছে আপন মনে।
ওদের কাজল কালো চোখ দেখে আমি প্রেমে পড়ে যাই। কার কথা বলি। প্রতিবারের মতো দাদুকে বলতেই হবে, কোন গরুটি আমার ভালো লেগেছে। কোনটি আমার প্রিয়। সেই প্রিয় গরুটিই ঐ ঈদে কোরবানি করা হতো। এটাই নাকি সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রতীকী ত্যাগ। সেই প্রিয় পশুর মূল্য কতো, কে কতো টাকা দিয়ে পশুটি কিনেছেন বা তার বাজার মূল্য কতো এমন আলাপ আমি গ্রামে শুনিনি। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতাম কীভাবে মাংস বিতরণ হচ্ছে। নিজেও যেতাম বাড়ি বাড়ি বিলি করতে। দাদুকে দেখেছি কোরবানির মাংসের যে অংশটুকু বিতরণ করার, সেই অংশটুকু ঠিক মাপজোখ করে দিচ্ছেন। অন্যদেরও তাই দেখেছি।
কোরবানির আগে পরে ঈদের জামাতে বা পরে হাটে-বাজারে কাউকে আর এনিয়ে কথা বলতে শুনিনি। তখন কোরবানির মাংস সংরক্ষণ করা হতো স্থানীয় জ্ঞান অনুসরণে। কেউ কেউ অবশ্য মাংস শুকিয়ে রাখতেন কিছুটা। মহরমে খাবেন বলে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই কোরবানির মাংস ফুরিয়ে যেত।
গ্রামে যখন যেতাম, তখন দু-একবার ঢাকায় কোরবানির ঈদ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কেউ একা বা সম্মিলিত ভাবে কোরবানি দিয়েছেন। দেখেছি প্রতিবেশী এবং গরিবদের মাঝে মাংস বিতরণ করতে। তখন খুব কম পরিবারেই ফ্রিজ ছিল। ফলে মাংস সংরক্ষণের কায়দাটি ছিল গ্রামের মতোই।
এখানেও দেখেছি কে কতো মূল্যে কোরবানির পশু কিনলেন তা নিয়ে বড়াই ছিল না। ধর্মীয় আচার পালন করতে পারাতেই ছিল সন্তুষ্টি। একসময় শহরের ঘরে ঘরে ফ্রিজ প্রবেশ করতে থাকে। সাধারণ ফ্রিজের সঙ্গে যোগ হয় ডিপ ফ্রিজ। এই ফ্রিজের উপকারিতা বেশি। এখানে বিপুল পরিমাণ মাংস সংরক্ষণ করা যায়। এবং দেখা গেল প্রতিবেশী এবং গরিবদের মধ্যে বিতরণে ভাটা পড়ে গেল। গরিবদের হাতে শুধু হাড্ডি-চর্বি। আর বিশেষ আত্মীয় বা স্বার্থের মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে শিনা বা রান।
সেই বিশেষ বিতরণ কার্যক্রম গত প্রায় এক দশকে ফেসবুকে দেখতে হচ্ছে। যেমন প্রদর্শনী দেখে যাচ্ছি কোরবানির পশুরও। কে কোন রঙ এবং আকারের গরু-ছাগল-উট কিনছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা দেখে যেতে হচ্ছে। কোন আত্মীয়ের বাড়িতে রান গেল, কোথায় গেল কলিজা-সেই ছবি দেখছি। সঙ্গে দেখতে হচ্ছে আহার পর্বও। বলছিলাম দেখতে চাইছি না। তবুও দেখতে হচ্ছে। কারণ যারা এই প্রদর্শনী করে যাচ্ছেন, তারা আমার ইচ্ছের পরোয়া না করে আমাকে ট্যাগ করছেন। ফলে আমি বিরক্ত হয়েও তাদের সেই প্রদর্শনী দেখে যাচ্ছি।
শুরুতে বলছিলাম এক সময় যে ধর্মীয় উৎসব ছিল ত্যাগে সুন্দর, পবিত্র। এখন সেই উৎসব ট্যাগে বিরক্তিকর এবং প্রদর্শনী সর্বস্ব হয়ে উঠছে। শুধু কোরবানি ঈদ কেন, সব ধর্মের উৎসব এখন ট্যাগে আক্রান্ত। এই মূহূর্তে দেশের পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চলের মানুষ বন্যায় বিধ্বস্ত। দেখতে পাচ্ছি বন্যার ত্রাণ বিতরণেও চলছে ট্যাগের প্রদর্শনী। ট্যাগিদের উদ্দেশ্যে ঈদ উপলক্ষে বলতে চাই, ত্যাগেই আনন্দ, ট্যাগে বিরক্তি। আমাদের দিন শুভমুক্তি !
লেখক : বার্তা প্রধান, সময় টিভি।
এইচআর/এমএস