মহাপ্লাবনে বাংলাদেশ
সুমেরিয়ান সভ্যতার পুরাণকাহিনিতে রয়েছে মহাপ্লাবনের ঘটনা। মহাপ্লাবনের কথা রয়েছে মিশরীয় পুরাণেও। গ্রিক পুরাণ, বাইবেল, ভারতীয় পুরাণেও মহাপ্লাবনের উল্লেখ রয়েছে। সব পুরাণেই প্লাবনকে বিবেচনা করা হয়েছে মহাদুর্যোগ হিসেবে। এইসব পুরাণকাহিনি থেকে বোঝা যায় প্রাচীন পৃথিবীর মানুষদের জন্য প্লাবন ছিল মহা বিধ্বংসী। সিন্ধুসভ্যতা বিষয়ক সাম্প্রতিক আবিষ্কার থেকে পণ্ডিতরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, জলাবদ্ধতা, জল সংরক্ষণ বাঁধ নিয়ে দুই দলভুক্ত মানুষের মধ্যে সংঘাত সেখানে ছিল। বাঁধভাঙা নদীর স্রোতেই পরে সম্ভবত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এই সভ্যতা। এর আগে এবং পরেও প্লাবনে ধ্বংস হয়েছে অনেক সভ্যতা। আটলান্টিস তলিয়ে গিয়েছিল মহাসাগরে। সাগরের পানির স্তরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়াতেই এই বিপর্যয়।
আধুনিক বিশ্বেও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। গ্রিন হাউজ এফেক্টের কারণে বাড়ছে তাপমাত্রা। গলে যাচ্ছে জমাট বরফ। দক্ষিণমেরু, উত্তর মেরু সব জায়গাতেই বরফগলন বাড়ছে। সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশসহ নিচু দেশগুলো তাই রয়েছে মহাবিপদের মুখে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
বিশ্বে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এবারের বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে দেশের সিংহভাগ। প্রতিদিন পত্রিকায়, টিভিতে দেখছি বন্যার্ত মানুষের অসহায় মুখ। এই অসহায় মুখই কিন্তু শেষ নয়, আরও অনেক অসহায়ত্ব দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণটা বুঝিয়ে বলছি। আমার মতো যারা শৈশবে বা আরও বড় বয়সে ১৯৮৮ এর মহাবন্যা দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বিপদটা কত ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। হিমালয়ের বরফগলা পানি ধেয়ে আসছে। ঢল নামছে। নদীগুলো কূল ছাড়িয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জনপদ, ফসল। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে এবারের অতিবর্ষা। ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ।
এই বন্যার আগেই হাওরের ফসল পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বন্যায় সবজি, ধান, গবাদি পশু সব তলিয়ে যাচ্ছে, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, হাঁস-মুরগি। উত্তরবঙ্গ প্রায় পুরোটাই পানির নিচে। বন্যা নেমে আসছে ঢাকার দিকেও। বিপর্যয়টা প্রাকৃতিক। কিন্তু মানুষের হাত রয়েছে এর জন্য। আর মানুষের কিছু করণীয়ও রয়েছে। আমাদের নদীগুলো যদি ড্রেজিং করা হতো উপযুক্তভাবে তাহলে বন্যা এত ভয়াবহ রূপ নিতে পারতো না। বেড়িবাঁধগুলোর মেরামত প্রয়োজন ছিল সঠিক সময়ে। বাঁধ নিয়ন্ত্রণে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতারও প্রয়োজন ছিল। এই করণীয়গুলো মনে রাখতে হবে এবং পালন করতে হবে ভবিষ্যতেও। কারণ পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার বাংলাদেশ ভবিষ্যতে যে আরও বড় বিপদের মুখে পড়বে না সেটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না।
‘ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকার নামই সভ্যতা। বর্বরতা পৃথিবীর সকল বিষয়েই অপ্রস্তত’। শেষের কবিতার নায়ক অমিত রায়ের এ কথাটি মনে রাখতে হবে। ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নিতে হবে। আর মোকাবেলা করতে হবে বর্তমান মহাসংকটের।
বন্যায় দুর্গত মানুষের জন্য এখন সবচেয়ে বড় সংকট খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপদ পানি, ওষুধ। এই বন্যায় গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের অবস্থা তো অবর্ণনীয়। শিশু, বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বাদের দুর্ভোগ কল্পনাও করা যাচ্ছে না। এই সময় নারীর নিরাপত্তার বিষয়টিও চিন্তার। কারণ আশ্রয়কেন্দ্রে যখন থাকতে হচ্ছে নারী ও শিশুদের তখন যেখানে হয়রানি, ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে। শিশুদের পড়ালেখাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিদারুণভাবে। স্কুল-কলেজগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। বন্ধ রয়েছে শিক্ষাদানের কার্যক্রম। বইখাতা ভেসে গেছে অসংখ্য শিশুর। স্যানিটারি টয়লেটের সমস্যাও এখন বড় সমস্যা। প্রজনন স্বাস্থ্য পুরো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বন্যাদুর্গত অবস্থায় প্রসব হচ্ছে যাদের তাদের তো নিরাপদ প্রসবের সুযোগ নেই। ফলে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে প্রসবজনিত জটিলতা, ফিস্টুলার মতো সমস্যা। সবমিলিয়ে বন্যার ক্ষতি যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে। পুরো দেশের অর্থনীতির ওপর এই বন্যা প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে, করছে এবং করবে। অর্থনৈতিক ক্ষতি সামলাতে বাংলাদেশের অনেক চাপ সহ্য করতে হবে।
দুর্গত মানুষের কাছে এখন ত্রাণ পৌঁছানো প্রথম কাজ। এরপর অন্যান্য কাজও রয়েছে। যে বানভাসি মানুষরা তাদের সহায় সম্বল সব হারালেন তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাটাও অতি জরুরি। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর তারা যেন বসতভিটায় আবার ঘর তুলতে পারেন, আবার চাষের জন্য টাকা ব্যয় করতে পারেন, গবাদি পশু কিনতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য এখনি পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় । নইলে দেখা যাবে, বন্যা চলে গিয়ে আরেক বন্যা আসার সময় হয়ে গেছে যখন, তখন হয়তো পাশ হচ্ছে বানভাসিদের সাহায্য সহায়তার প্রস্তাব।
বন্যা আর মহামারী হাত ধরাধরি করে চলে। ডায়রিয়া, কলেরাসহ বিভিন্ন প্রাণঘাতী বন্যাসংশ্লিষ্ট অসুখের মোকাবেলার সময়ও কিন্তু এখনি। আমাদের দেশে ত্রাণ ও সহায়তা বিতরণে অব্যবস্থাপনাই কিন্তু সকল সমস্যার মূল। বানভাসি মানুষের জন্য আসা ত্রাণ লুটপাটের ঘটনা আমদের দেশে নতুন নয়। প্রতিবছরই ত্রাণের সামগ্রী ও টাকা ব্যবহার করে নিজের প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করে গ্রামেগঞ্জে একশ্রেণির টাউট, মাস্তান ও পাতিনেতা গোছের কিছু লোক। এদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে সাধারণ মানুষকে। কাজটি সরকারের। কাজটি প্রশাসনের। কিন্তু সর্ষের ভিতরে যেন ভূত বাসা না বাঁধে সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
সরকারের কর্তব্য তো আছেই। সেই সঙ্গে নাগরিকদেরও কিছু কর্তব্য রয়েছে। এইসময়টায় ভোগ বিলাস, জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকী, নিমন্ত্রণ, পার্টি , দেশবিদেশ বেড়ানো, উচ্চহারে শপিং ইত্যাদি কমিয়ে সেই টাকাটা দুর্গতদের দান করলে ক্ষতি নেই বরং লাভ। কারণ দেশের অর্থনীতির উপর চাপ কমাতে পারলে সেটা সকল নাগরিকের জন্যই শুভ ফল বয়ে আনে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/আরআইপি