ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

খুন আর রক্তমাখা বাংলাদেশের রাজনীতি (১)

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ০৭:০৯ এএম, ২২ আগস্ট ২০১৭

বাংলাদেশের রাজনীতিকে কেমন দেখেন আপনি? এরকম একটি প্রশ্ন দিয়েই যদি শুরু করি তাহলে প্রথমেই বলতে হবে যে, এদেশের রাজনীতি এখনও কেবল রক্ত পিপাসু। যদি পাল্টা প্রশ্ন করেন কেন এমন মনে হয় তাহলে আসলে একেবারে শুরু থেকেই শুরু করতে হবে। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর এদেশে একদল রক্তপিপাসু খুনি ক্ষমতায় বসে।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে শুরু করে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত খুন হওয়া ব্যক্তিদের তালিকার দিকে একবার নজর দিন, দেখবেন, এদেশের জাতীয় বীর ও তাদের পরিবার-পরিজনের রক্তে এদেশ ভেসে যাচ্ছে। তারপর বন্দুকের নলের মুখে প্রধান বিচারপতিকে দিয়ে সামরিক আইন জারি করে এই রক্তপাতের ওপর যে ব্যক্তির বুটের চিহ্ন আমরা দেখতে পাই তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমান। আত্মস্বীকৃত খুনিরাই তাদের দোসর হিসেবে জিয়াউর রহমানকে আমাদের চিনিয়ে দিয়ে গেছে, ফলে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের আর কোনো পথ খোলা নেই, যতোই তার অনুসারীরা চিৎকার করে গলা নষ্ট করুন না কেন। কিন্তু ক্ষমতায় বসেই বা জিয়াউর রহমান কী করেছিলেন? তিনি মূলতঃ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ক্যু-দমনের নামে দেদারছে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছিলেন আর পাকিস্তান-ফেরৎদের পুনর্বাসিত করছিলেন।

এসব কথা বার বার বলার প্রয়োজন হতো না, যদি না এদেশে এই কুৎসিৎ সত্যকে সকলে স্বীকার করে নিয়ে সামনের দিকে তাকাতেন। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন, টেলিভিশন টকশো-তে, বক্তৃতাবাজিতে অনবরত এই ভয়ঙ্কর সত্যকে বদলে ফেলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কর্নেল তাহেরের মতো মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার পরও জিয়াউর রহমানকে এদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, এবং অ-রাজনৈতিক সুশীলদের গুরুস্থানীয়রা সে দাবিও প্রায়ই তোলেন তাদের বক্তব্যে, তাদের প্রিয় পত্রিকায় কলাম লিখে কিংবা টেলিভিশনে টক শো’য়।

তারা মূলতঃ গণতন্ত্রের জন্য কান্না করেন, বলতে চান যে, জেনারেল জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকার করে নিলে সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়, তার দলকে আর একটু বাড়তি সুযোগ দিলেই এদেশের রাজনীতিতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। কিন্তু যারা নতুন চোখে বাংলাদেশকে দেখছে তারা হয়তো এই সুশীলদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ভাবতেই পারেন যে, আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা কতো খারাপ যে, একজন সেক্টর কমান্ডারকে মেনে নিতে চায় না, তার দলকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী আখ্যা দিতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কারণেই, বাংলাদেশের রক্তাক্ত রাজনৈতিক ইতিহাসটা একটুখানি হলেও আলোচনার প্রয়োজন, এবং সেটা যতোবার সম্ভব ততোবারই, কারণ প্রতিবারই এসব কথা আপনার কাছে নতুন মনে হবে এবং প্রতিবারই আপনার গা শিউরে উঠবে এই রক্তাক্ত রাজনীতির গল্প শুনতে শুনতে।

আমার নিজেরও মনে হতো যে, আওয়ামী লীগ কেন এতো বার বার ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কথা বলে? কেন বলে যে, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশিদূর যেতে হয় না আমাদের, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং তারপর একই সালের ৩রা নভেম্বর জেলের ভেতর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর জাতীয় চারনেতাকে হত্যার ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এদেশে যে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল সেটা বোঝার জন্য আমাদের রাজনীতিতে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারপরে কী হয়েছিল?

খন্দকার মুশতাকের ৮০ দিনের নবাবীর পর প্রধান বিচারপতির মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দেশে সামরিক আইন জারির পর কী হয়েছিল? জেনারেল জিয়া, যিনি কিনা বঙ্গবন্ধু সরকারের সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান ছিলেন তিনিই হয়ে বসেছিলেন দেশের সর্বেসর্বা। খুনিদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, বাকি জেনারেল বা অফিসার যাদেরকেই পথের কাঁটা মনে হয়েছে তাদেরকেই হয় খুন করেছেন না হয় বন্দী করেছিলেন। নিজে যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা পুরোপুরি দখল করলেন তখন খুনিদের দিলেন ইনডেমনিটি, কোনো সভ্য জগতের ইতিহাসে এরকম নজির নেই। শুধু কি তাই? খুনিদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বাড়তি সুযোগ-সুবিধে দিয়ে বড় বড় পদও দিয়েছিলেন এই জিয়াউর রহমানই।

ধরুন, জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্র ক্ষমতাকে পুরোপুরি ব্যবহার করে নতুন রাজনৈতিক দল খুলছেন, তখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগ দিয়েছিল বেশ ক’টি রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দূরত্ব খুব বেশি ছিল না, থাকলে তারা বাকশালে যোগ দিতো না। ফলে জিয়াউর রহমান যে রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটি তৈরি করলেন সেখানে মূলতঃ তিনি জায়গা করে দিলেন আওয়ামী-বিরোধী সকল মানুষকে জড়ো করলেন। এবং সে জন্য তিনি প্রথমেই পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনলেন নিষিদ্ধ স্বাধীনতা-বিরোধী, রাজাকার, আল-বদর নেতাদের এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে উন্মুক্ত করে দিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে।

যেহেতু তিনি নিজে রাজনৈতিক দল করবেন সেহেতু তাকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধূয়ো তুলতে হলো এবং রাজনীতিকে একটুখানি উন্মুক্ত করতে হলো, এখন যারা বলেন যে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন, সেটা সম্পূর্ণ ভুল এবং সর্বৈব মিথ্যে একটি তত্ত্ব। এর কোনো রাজনৈতিক ভিত্তিতো নেই-ই, এ দাবিতে নেই কোনো সততাও। জিয়াউর রহমান সম্পর্কে দুর্নীতি না করা বা দক্ষ শাসক হিসেবে যেসব তকমা দেওয়া হয় তার সবটাই আসলে রাজনৈতিক মিথ, এসব মিথ তৈরি না করলে এদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক দল খুলে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিপরীতে দাঁড়াতে পারতেন না। এবং সে জন্য বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের অনুপস্থিতি, সামরিক আইনের জুজুর ভয়, আইন-আদালত-প্রশাসন-মিডিয়া সবকিছুর সর্বোচ্চ ব্যাবহারে যে ইমেজ জিয়াউর রহমানের তৈরি করা হয়েছিল তা আসলে ছিল আসল সত্যকে আড়াল করা। একই কাজ পানামায় হয়েছে, হয়েছে আফ্রিকাসহ দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে, যেখানে সামরিক শাসকদের জননেতা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সত্তর ও আশির দশকে সিআইএ-র প্রেসক্রিপশনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্পর্কে এখন বিস্তর গবেষণাপত্র পাওয়া যায়, আগ্রহীরা দেখে নিলেই বুঝতে পারবেন, এদেশেও জিয়াউর রহমান সেটাই করেছিলেন।

আগেই বলেছি যে, জিয়াউর রহমান যে রাজনৈতিক দলটি গঠন করলেন তা মূলতঃ আওয়ামী-বিরোধী একটি প্ল্যাটফরম যেখানে সেই সব মানুষকে এনে জড়ো করা হয়েছিল যারা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর নামে দু’টো ভাত বেশি খেতেন কিংবা মনেপ্রাণে এদের ধ্বংস চাইতেন। জিয়াউর রহমান খুন হয়েছেন কারণ তিনি সেই খুনের পথ তৈরি করে রেখেছিলেন, যাদেরকে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন তাদেরকে তিনি আগেই সরিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ততোদিনে ক্ষমতা ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে যে, এদেশে ক্ষমতা দখল করা যায় সে প্র্যাকটিস এদেশে হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকেই যখন হত্যা করে পার পাওয়া গেছে, জাতীয় নেতাদের যখন হত্যার পর বিচার হয়নি, সেনাবাহিনীর হাজার খানেকেরও বেশি ছোট-বড় অফিসারকে যখন হত্যা করার পর তা নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি তখন দেশের আরেকজন প্রেসিডেন্টকে হত্যা করাটা কোনো ব্যাপার ছিল না, খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল।

জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ইনডেমনিটি না দিয়ে খুনের বিচার করলে আজকে এ লেখার ভাষাই কেবল নয়, বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো। কিন্তু তিনি শুধু সেখানেই থামেননি, এদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, রাজনীতিসহ গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠানকে যে ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছিলেন এরশাদ শাহী সেই ধ্বংসের ষোলকলা পূর্ণ করেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির স্থায়ী ক্ষতি করেছিলেন জিয়াউর রহমান আর এরশাদ সেই ক্ষতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। এখন বলুন, আওয়ামী লীগ যতোই গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক দল হোক না কেন, তাকে তো রাজনীতি করতে হচ্ছে এই বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে। বাম দলগুলো শক্তিহীন হতে হতে এখন কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে, ফলে তারা কখনও বিএনপি’র কখনও অ-রাজনৈতিক শক্তির তাঁবেদারি করা ছাড়া আর কোনোখানে তাদেরকে দেখা যায় না। সে অর্থে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম খালেদা জিয়া, গোলাম আজম, নিজামী, মুজাহিদ এবং এরশাদ।

এখন আপনিই বলুন, এদের মধ্যে বেগম জিয়া ও এরশাদ দু’জনই চরম ও প্রবলভাবে অরাজনৈতিক ব্যক্তি, আর বাকিদের হাতে লেগে আছে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা বাঙালির রক্ত। এখানে একপক্ষ রাজনীতিবিদ, আরেকপক্ষ ক্ষমতাকামী ও হন্তারক, ক্ষমতা দিয়ে এদেশকে ১৯৭১-এর পূর্ব জমানায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। হয়তো তারা আর পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন চান না কিন্তু তারা মনে মনে পাকিস্তানি সেনাশাসকদের মতোই দেশ চালাতে চান, যা থেকে বঙ্গবন্ধু দেশকে বের করে এনেছিলেন এবং আওয়ামী লীগের হাতে সেই রাজনীতির মশালটিই তুলে দিয়ে গেছিলেন। ফলে সংঘাততো অনিবার্যই হয়ে উঠেছিল এবং এই সংঘাতে আওয়ামী লীগ মার খাওয়ারই দলে ছিল ২০০৮ সাল অবধি, মার দেওয়ার ক্ষমতা আওয়ামী লীগের ছিল না।

আপনি যদি আপনার বিবেকের কাছে স্পষ্ট হন, নিজেকে একটু হলেও সৎ ও সত্যবাদী মনে করেন তাহলে আপনি একটি প্রমাণ আমাকে দিন যেখানে আওয়ামী লীগের হাতে কোনো বিএনপি-নেতা খুন হয়েছেন, বা বিএনপি-জামায়াত নেতাদের ওপর আওয়ামী লীগ কখনও আক্রমণ করতে পেরেছে। ছুটকা মুটকা কিরিচ বা লেঠেল মারামারির ঘটনা নয়, একুশে আগস্ট বা কিবরিয়া হত্যা বা আহসান উল্লাহ্ মাস্টারের মতো হত্যার ঘটনা আমাকে একটি দেখান, যদি পারেন তাহলে আমি করজোরে ক্ষমা চাইবো আপনার কাছে। হুম, জানি, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার কথা তুলবেন, সেটি ২০০৮-এর পরের ঘটনা এবং তার আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনার কথা আমাকে বলতেই হবে। তাই আজকে লেখাটি দীর্ঘায়িত না করে এখানেই ইতি টানি। পরবর্তী লেখায় এ বিষয়টির ইতি টানবো আশা করি।

ঢাকা ২১শে আগস্ট, সোমবার ২০১৭
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন