১৫ আগস্ট চলে যায় শোক থাকে নিরন্তর
আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে এবারো অতিবাহিত করলাম ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম দিন ১৫ আগস্ট। ১৫ আগস্ট সামনে রেখে আমরা শোকগ্রস্ত হই, বেদনায় জর্জরিত হই। আমাদের যার যতটুকু অভিজ্ঞতার সঞ্চয় সে ততটুকু অনুভবে নিঙড়ে নিঙড়ে কাঁদি এই আগস্টে, ১৫ আগস্টে। এবারো কেঁদেছি আমরা। কেঁদেছি নরপিশাচ ঘাতকের বুলেটের আঘাতে একজন মহান নেতার নির্মম পরিণতির কথা ভেবে। আমরা কেঁদেছি মহান এই নেতার সহচররূপে সেদিনের ভযাল রাত্রে যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাদের কথা ভেবে।
দীর্ঘ ৪২টি বছর আমরা কেঁদে চলেছি নিরন্তর। তবু মনে পড়ে, আমাদের কান্নাকাটির ক্ষেত্রটিও এখনকার মতো স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না বহু বছর। রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের শোক ও কান্নার ওপরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল শতভাগ। একদা আমরা কাঁদতেও পারতাম না, বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে পারতাম না দু’ফোটা চোখের জল। কিন্তু আজ আমাদের কাঁদবার অধিকার অর্জিত হয়েছে। তাই কেবল ১৫ আগস্ট নয়, কেবল আগস্ট মাসেই নয়, আমাদের নিরন্তর কান্নার অশ্রু“ধারা বয়ে চলে বারোমাস। বারোমাসি কান্নায় আমাদের অশ্রু“ধারায় বঙ্গোপসাগরও হয়ে উঠেছে অথৈ পাথার।’’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৯৬-এর আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ২১টি বছর বঙ্গবন্ধুর জন্য আমরা কাঁদতে পারিনি, জাতির পিতার জন্য এ জাতি সামান্য শোক প্রকাশের অবকাশ-অধিকার পায়নি। রাষ্ট্র-ক্ষমতায় আসীন ক্ষমতাধরেরা ইতিহাসের বিপরীত চাকায় চলতে চলতে এবং রাষ্ট্র চালাতে চালাতে আমাদের প্রায় ভুলিয়ে দিতে বাধ্য করে ফেলেছিল ১৫ আগস্ট বছরের অন্য যে-কোন মাসের যে-কোন দিনের মতই একটি দিন! একঘেঁয়ে, গতানুগতিক, ক্যালেন্ডারের পাতায় পাতায় বাতাসে বাতাসে উড়া চিহ্নমাত্র! শাসকের চোখ রাঙানি আমাদের অভ্যস্থ করতেও সক্ষম হয়েছিল যে, এই ১৫ আগস্টের বেদনাবোধ কারো মধ্যে বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকলেও তাকে বিপরীতভাবে শোক থেকে সুখে রূপান্তরের খেলা খেলে যাওয়াই আনন্দের। তারা জাতির পিতার হত্যা দিবসটি ঘিরে তথাকথিত আনন্দের খেলাই খেলেছিল।
জনসমর্থনপুষ্ট একটি দলের প্রধান নেত্রী এবং উপর্যুপরি একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হয়েও নিজের পূর্ববর্তী দুই-দইটি জন্ম-তারিখকে নিজেই খারিজ করে দিয়েছেন! আর জাতির পিতার হত্যা দিবসের ন্যায় একটি বেদনা-বিধুর দিন ১৫ আগস্টকেই বানিয়ে তুলেছেন নিজের এক মিথ্যা জন্মদিন! সত্য ইতিহাসকে ছাইচাপা দিয়ে ভ্রান্ত এক ইতিহাস রচনার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী তার জন্মদিনের বয়সের অংক-সংখ্যার অনুপাতে বেড়েছে উৎসবের কেক-এর আয়োজন! কী বিচিত্র এই দেশ! আমরাও পঙ্গপালের মত সেই কেক ভক্ষণের জন্য এবং ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ ম্যাডাম’ গানের সঙ্গে উদ্দাম নৃত্যের জন্য দিলাম ছুট। ছুটলাম রাষ্ট্রের সেরা আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য-উপাচার্য, শিক্ষক, জাতীয় দৈনিকের ডাকসাইটে সম্পাদক, ছুটলেন টেলিভিশন চ্যানেলের বেহিসাবী ক্যামেরাসহ অগণিত চ্যানেল মালিক। সেই মিথ্যা ও বানিয়ে তোলা জন্মদিনে পাগলের মতো ছুটে গেলেন চিকিৎসক, আমলা, সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধানেরা, ছুটলেন গায়ক, নায়ক নর্তকী আহা! প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলো মিথ্যা জন্ম দিন, রচিত হতে থাকলো মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস। আর আমরা সাধারণ মানুষেরা কেবলই ইতি-উতি করি, আর আবারো ভাবি ‘উদ্ভট উটের পিছে চলিছে স্বদেশ!’
মিথ্যা ইতিহাসের সেই স্রোতধারায় একটি প্রজন্ম ১৫ আগস্টকে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা দিবসের শোকগ্রস্ততার চেয়ে ১৫ আগস্টকে বেগম খালেদা জিয়ার মিথ্যা ও ভেজাল জন্মদিনের গোলাপি উল্লাস ও উচ্ছ্বাসকেই বুঝেছে। এই প্রজন্ম নির্দ্ধিধায় ভেবে চলেছে ১৫ আগস্ট মানেই বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন। তাই এই একটি প্রজন্মের কাছে ‘জাতির পিতা’ কিংবা ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্পর্কিত চেতনার জায়গাটি রয়ে গেছে অনেকটাই শূন্যগর্ভ ফাঁপা। ১৫ আগস্ট তারা কীভাবে শোকের প্রকাশ ঘটাবে, হা ঈশ্বর!
১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে গণমাধ্যমের কল্যাণে ধীরে ধীরে ভ্রান্ত ইতিহাসের পাঠে গড়ে ওঠা সেই প্রজন্মের চোখ খুলতে শুরু করে। ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ পাঠ তাদের সম্মুখে ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে। তাদের চোখে প্রতিভাত হতে থাকে ইতিহাসের এক নজির বিহীন এবং ভয়ংকরতম দিন ১৫ আগস্ট। এদিন সুখ নয় এদিনটি কেবলি শোকের অশ্রুতে যাপন করার। এদিনটিতে কেক কেটে আনন্দ-নৃত্যের চেয়ে নিরবে অশ্র“ বিসর্জনই এদেশের সন্তান হিসেবে সকলের কর্তব্য। সেই কর্তব্যবোধের কারণেই আজ সকল প্রজন্মের বাঙালি বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক করে, জাতির পিতার জন্য কাঁদে অবিশ্রান্ত ধারায় বাঙালির সে কান্না শ্রাবণের বর্ষণধারায় একাকার।
তারপরও আত্মসমালোচনার মুখোমুখি আমাদের হতেই হয়। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোকের দিন। শোকের দিন বটে, কিন্তু আমরা প্রকৃতপক্ষে কতটা শোক প্রকাশ করতে পারি এই দিনটিকে ঘিরে, এই দিনটিকে কেন্দ্র করে? কতটুকু শোকই বা আমরা প্রকাশ করি নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালির জন্য, বঙ্গবন্ধুর জন্য, জাতির পিতার জন্য? শোক থেকে শক্তি, শক্তি থেকে সামর্থ আর সক্ষমতায় আমরা জাতির পিতার স্বপ্ন-পূরণে কতটুকুই বা নিজেকে নিবেদন করতে পেরেছি? মনে রাখতে হবে, শোক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শের প্রতি আমাদের নিবেদনের বিষয়টিও স্পষ্ট করার সময় এসেছে।
প্রতি বছর আগস্ট আসে, আসে ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের পর ৪২টি ১৫ আগস্ট আমরা অতিক্রান্ত করেছি। এই ৪২ বছরে আমরা যদি প্রকৃতই শোক পালন করে থাকতাম তবে, শোকের নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে হয়তো লেগে পড়তে পারতাম বঙ্গবন্ধুহীন এই জাতিরাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা যতটা অলস ঠিক ততটাই বোধ করি অকৃতজ্ঞও। তাই আজও সোনার বাংলার বাস্তবায়ন দেখিনা, সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষণ দেখিনা। যে পাকিস্তান এদেশের সমস্ত সম্পদ পাচারের মাধ্যমে নিজেদের বিত্তশালী করার চক্রান্তে সদাতৎপর ছিল সেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা এদেশের সাধারণ মানুষের অর্থ বিদেশে পাচারের মাধ্যমে নিজেদের ‘আখের’ গুছিয়ে নিচ্ছে। দেশমাতৃকার প্রতি সম্পদ পাচারকারীদের কোন মমতা নেই। মানুষের মানবিকতার প্রতি এরা সর্বদা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে যাচ্ছে। এই শ্রেণির লোভী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ঘৃণা ছিল অকপট। এই দেশ আর এই দেশের মানুষই ছিল তাঁর রাজনীতির কেন্দ্রে। এদেশের স্বাধীনতা এবং এদেশের মানুষের মুক্তিই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন-সাধনা। এই ভূখণ্ড, এই জাতিরাষ্ট্র আর এই দেশের খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষের মুক্তি-পিপাসু আকাক্ষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর সজাগ দৃষ্টি ছিল। এদেশের মানুষের নাড়ির ও হাঁড়ির অবস্থাই শুধু নয় এদেশের সকল শ্রেণির মানুষের শারীরিক ভঙ্গিও উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তাঁর রাজনীতির আদর্শ ও দর্শন বিশ্বমুখীন হওয়া সত্ত্বেও স্বদেশমুখীনতায় বেশি আত্মমগ্ন ছিল। সেজন্য আজ তাঁর জন্য সবচেয়ে বেশি শোক এদেশের খেটে-খাওয়া মানুষের। এদেশের খেটে-খাওয়া মানুষই তাঁর জন্য শোক করে, অশ্রু বিসর্জন দেয়। তারা কেবল ১৫ আগস্ট কিংবা শুধু আগস্টেই অশ্রু ঝরায় না তারা বঙ্গবন্ধুর জন্যই কাঁদে, কাঁদে বাঙালির মহান নেতার জন্যই। তারা কেঁদে কেঁদে এই আগস্টের শোক ভুলতে চায়, ১৫ আগস্টের পাপ ও কালিমা থেকে এজাতিকে মুক্ত করতে চায়। যেমনটি কবি আহ্বান করেছিলেন : ‘আগস্ট শোকের মাস, পাপমগ্ন, নির্মম-নিষ্ঠুর,/ তাকে পাপ থেকে মুক্ত করো কান্নায় কান্নায়।’ তাই ১৫ আগস্ট চলে গেলেও বাঙালির শোকের দিন শেষ হয় না, চলে নিরন্তর অশ্রু বিসর্জন।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/পিআর